আম আদমি পার্টির দফতরের বাইরে উচ্ছ্বাস সমর্থকদের। ছবি: পিটিআই।
ধর্ম না উন্নয়ন? এই প্রশ্নে দ্বিতীয় বিকল্পকেই বেছে নিল রাজধানী দিল্লি। তৃতীয়বারের জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে চলেছেন অরবিন্দ কেজরীবাল। আসন কিছুটা কমলেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসছে আম আদমি পার্টি (আপ)। বিজেপির আসন বাড়লেও এ বারও ধর্মীয় মেরুকরণ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টার (এনপিআর)-এর ধাক্কায় এ বারও দিল্লির মসনদ অধরাই থেকে গেল বিজেপির কাছে। কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল কংগ্রেস।
বুথ ফেরত সমীক্ষায় ইঙ্গিত ছিলই। সকালে ইভিএম খোলা শুরু হতেই দিকে দিকে আপের জয়জয়কার। গণনার যা প্রবণতা ৭০টির মধ্যে ৬২টির কাছাকাছি আসন পেয়ে দিল্লিতে ফের ক্ষমতায় আসতে চলেছে আপ। বিজেপি পেতে পারে কম-বেশি ৮টি আসন। ভরাডুবির মধ্যে বিজেপির কাছে একমাত্র সান্ত্বনা, গত বারের চেয়ে আসন বাড়ানো।
কিন্তু কী এমন ম্যাজিক দেখিয়েছেন কেজরীবাল? প্রথম বার ৪৫ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কোজরীবাল কার্যত বোকামিই করেছিলেন বলে অনেকেই কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু সেটা যে লম্বা দৌড়ের প্রস্তুতি ছিল, তা বোঝা গিয়েছে গত পাঁচ বছরে কেজরীবালের উন্নয়নের রাজনীতিতে। গত পাঁচ বছরে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক উন্নয়নমুখী প্রকল্প তৈরি এবং তার বাস্তব রূপায়ণের উপরেই আস্থা রেখেছেন দিল্লিবাসী। জন-প্রিয়তার সেই রাজনীতিই দিল্লির কুর্সি উপহার দিয়েছেন ভোটাররা।
কেমন সেই জনমুখী প্রকল্পগুলি কেমন? এই ২০১৫ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেজরীবাল, সেগুলির প্রায় সবকটি ধরে ধরে বাস্তবায়িত করে দেখানোর রাজনীতিতে কেজরীবালের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে। দিল্লিবাসীর জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল মকুব করেছে আপ সরকার। মহিলাদের জন্য সরকারি বাসে বিনামূল্যে সফর এবং তাঁদের নিরাপত্তায় বাসে মার্শাল নিয়োগ করা, বিনা পয়সায় প্রতিদিন ৭০০ লিটার পর্যন্ত জল দেওয়ার মতো প্রকল্প বাস্তবে করে দেখিয়েছে দিল্লির সরকার। নতুন অনেক স্কুল তৈরি হয়েছে, পুরনো স্কুলগুলির খোলনলচে বদলে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কার্যত যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছে কেজরীবালের মহল্লা ক্লিনিক মডেল। এই ক্লিনিকগুলিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা তো বটেই ওষুধও দেয় সরকার। এই মহল্লা ক্লিনিকগুলি পরিদর্শন করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা। এই সব সংস্থাও এই ক্লিনিকগুলির দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: আপে কেন আপ্লুত? দিল্লিবাসী বলছেন...
আদপে এগুলি সাধারণ মানুষের জন্য প্রকল্প হলেও এটাই ছিল কেজরীবালের সুকৌশলী রাজনৈতিক ইউএসপি। ভোটেপ্রচারেও এই উন্নয়ন মডেলকেই হাতিয়ার করেছিলেন কেজরীবাল। বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের উস্কানিতে পা না দিয়ে প্রচার করে গিয়েছেন শুধু নিজের সরকারের এই সব জনমুখী প্রকল্পের সাফল্য। শাহিন বাগের আঁচ কার্যত গায়ে মাখেননি, জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার ঘটনায় কার্যত মুখ খোলেননি। দিল্লিবাসীকে বোঝাতে পেরেছেন, জাত-পাত, ধর্মীয় বিভেদ নয়, উন্নয়নই তাঁর পাখির চোখ।
ফল স্পষ্ট হতেই দিল্লিতে আপ কর্মীদের উচ্ছ্বাস। ছবি: পিটিআই
অথচ কয়েক মাস আগের লোকসভা ভোটেও ভরাডুবি হয়েছিল আপের। সাতটির একটিতেও জিততে পারেনি আপ। সব কটি আসন ঝুলিতে পুরেছিল বিজেপি। তার উপর নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের মতো ধুরন্ধর রাজনৈতিক জুটির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে কেজরীবালকে। এই দু’জন তো বটেই দলের সব সাংসদ, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের এনে প্রচার করেছে বিজেপি। ধর্মীয় মেরুকরণের তিরে বিঁধলেও তার বিরুদ্ধে কেজরীবাল সে সব গায়ে মাখেননি। সিএএ-এনআরসি নিয়ে কোনও জনসভায় একটি কথাও শোনা যায়নি তাঁর মুখে।
আরও পড়ুন: আপ শিবিরে উচ্ছ্বাসের ঢল, জয়ের পথে কেজরীরা
তার সঙ্গে বিরোধী ভোটকে একমুখী করার কৃতিত্বও কেজরীবালের প্রাপ্য। ভোটের ফলের দিকে নজর রাখলেই দেখা যাবে ভোট হয়েছে কার্যত দ্বিমুখী। এক দিকে বিজেপি। বিপরীতে আপ এবং অবিজেপি। কংগ্রেসের নেতা কর্মীদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন, নিজের দল ছাড়তে হবে না, শুধু এ বারের জন্য আপকে ভোট দিন। সেই আর্জিতেও কাজ হয়েছে। বিজেপি বিরোধী ভোটের প্রায় পুরোটাই পকেটে পুরতে পেরেছেন কেজরীবাল।
কেজরীওয়ালের ছবি নিয়ে নাচ-গানে জয়োল্লাশ আপ সমর্থকদের। ছবি: পিটিআই
পর পর দু’বার ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসার নজিরও খুব কম দলেরই রয়েছে।২০১৫ সালে আপ পেয়েছিল ৫৪.৩ শতাংশ ভোট। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩২.২ শতাংশ ভোট। এ বার আপের আসন কিছু কমলেও ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে খুব বেশি হেরফের হয়নি।
কিন্তু কেজরীবালের যাত্রা এতটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এমনকী, ঘনিষ্ঠ মহলে কেজরীবাল স্বীকার করেছেন, সরাসরি রাজনীতিতে আসার কথা কেরিয়ারের শুরুতে কখনওই ভাবেননি। কিন্তু ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের নিশ্চিন্ত সরকারি চাকরি ছাড়ার পর থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে ভাবে ঘটনা প্রবাহ এগিয়েছে, তাতে ধীরে ধীরে রাজনীতির গণ্ডিতে কার্যত নিজের অজান্তেই পা দিয়ে ফেলেছিলেন খড়গপুর আইআইটির প্রাক্তনী কেজরীবাল।
আরও পড়ুন: গেরুয়া ফাঁদে পা দিতে গিয়েও সামলে নিলেন কেজরী, টেনে কি ধরলেন পিকে?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কেজরীবালের অজান্তেই সেই পথের সূচনা হয়েছিল সমাজকর্মী অন্না হজারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে টানা অনশন-ধর্না আন্দোলন। লোকপাল বিলের দাবিতে যে ভাবে দিনের পর দিন অনশন ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন করেছিলেন কেজরীবাল, তাতে তাঁর মধ্যে এক নতুন নেতার স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলেন দেশবাসী। সেই মাফলার ম্যন কেজরীবালের হাত ধরেই দেশবাসী স্বপ্ন দেখেছিলেন এক নতুন ভারতের। এক দুর্নীতিমুক্ত ভারতের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy