Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
National News

অ্যাকাউন্ট ফাঁকের চক্রে প্রযুক্তিশিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা, পুলিশকে খাবি খাওয়াচ্ছে ‘জামতাড়া গ্যাং’

এটিএম থেকে অন লাইনে লেনদেন— নতুন নতুন পদ্ধতিতে গ্রাহকদের সর্বস্বান্ত করছে ‘জামতাড়া গ্যাং’।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সোমনাথ মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৮:৫০
Share: Save:

ঝাড়খণ্ডের জামতাড়া। মূলত জনজাতি প্রধান জেলা। বিদ্যাসাগর এখানে জীবনের ১৮টি বছর কাটিয়েছিলেন। সেই জামতাড়াই এখন সাইবার অপরাধীদের ‘মক্কা’ হিসাবে পরিচিত। গোটা দেশের কাছে ত্রাসও বটে!

এটিএম থেকে অন লাইনে লেনদেন— নতুন নতুন পদ্ধতিতে গ্রাহকদের সর্বস্বান্ত করছে ‘জামতাড়া গ্যাং’। ওই গ্যাংয়ের ‘কারসাজি’তে কপালে ভাঁজ দেশের তাবড় তাবড় গোয়েন্দা সংস্থার। বিদেশি প্রতারকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা ‘জামতাড়া মডেল’কে রীতি মতো ‘শিল্প’ পর্যায়ে উন্নীত করে ফেলেছে বলে গোয়েন্দাদের মত।

কী রকম ‘শিল্প’, কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

সম্প্রতি কলকাতায় একটি নামী রেস্তরাঁয় ‘টেবিল বুকিং’ করতে গিয়ে সাইবার অপরাধীদের ফাঁদে পড়েছিলেন এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী মানস পাল (নাম পরিবর্তিত)। তিনি ওই রেস্তরাঁর ওয়েবসাইটে গিয়ে তাদের ফোন নম্বর জোগাড় করেন। সেই নম্বরে ফোনও করেন তার পর। ফোনে তাঁকে বলা হয়, টেবিল বুকিং করার জন্য তাঁর মোবাইলে একটি লিঙ্ক পাঠানো হবে। সেখানে ক্লিক করে নির্দেশিকা মেনে কিছু টাকা অগ্রিম হিসাবে পাঠাতে হবে। নির্দেশিকা মেনে ওই ব্যক্তি অগ্রিম হিসাবে কিছু টাকা পাঠিয়ে টেবিল বুকিং করেন। পরে জানা যায়, তিনি যে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পাঠিয়েছিলেন, সেখান থেকে জামতাড়ার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় কয়েক হাজার টাকা ট্রান্সফার হয়ে গিয়েছে। পরে রেস্তরাঁয় পৌঁছে বুঝেছেন আসলে টেবিল বুক হয়নি, বরং ফাঁদে পা দিয়ে খুইয়েছেন টাকা।

আরও পড়ুন: রাতে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা, সকালে সহকর্মীর গুলিতে ঝাঁঝরা, বিশ্বরূপ-সুরজিতের শোকে ডুকরে কাঁদছে পরিবার

তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ওই লিঙ্কটাই ছিল আসল ফাঁদ। নামী রেস্তরাঁর ওয়েবসাইট হ্যাক করে সেখানে নিজেদের ফোন নম্বর ব্যবহার করা এবং সেই নম্বরে ফোন করলে গ্রাহককে লিঙ্ক পাঠিয়ে ফাঁদে ফেলা হয়। সামান্য কিছু টাকা পাঠিয়ে বুক করতে বলা হচ্ছে, কিন্তু তার আড়ালে আসলে চলছে গ্রাহকের সমস্ত তথ্য হাতিয়ে নেওয়া। তার পর সেই হাতানো তথ্য থেকেই অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেওয়া হচ্ছে।

ঠিক যেমন ভাবে ওই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছিলেন হরিদেবপুরের যুবক ঋষভ ঘোষ। মোবাইল থেকে একটি নামী ‘ফুড অ্যাপে’ খাবার অর্ডার দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অনেকটা সময় পার হয়ে গেলেও খাবার না আসায় তিনি গুগ্‌লে গিয়ে খাবার সরবরাহকারী ওই সংস্থার একটি নম্বর খুঁজে পান। ওই নম্বরে ফোন করতেই তাঁকে বলা হয়, মোবাইলে একটি ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) যাবে। সেই ওটিপি তিনি যে নম্বরে ফোন করেছেন, সেখানে ফরোয়ার্ড করতে বলা হয়। আর সেটা করতেই অ্যাকাউন্ট ফাঁকা। তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ওটিপির মাধ্যমে গ্রাহকের মোবাইল থেকে তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সমস্ত তথ্য হাতিয়ে মুম্বই থেকে ওই ব্যক্তির টাকা তোলা হয়েছে।

অন লাইনে লেনদেন নির্ভর জীবনে অনেকেই এখন খাবার থেকে ওষুধ, জামাকাপড় থেকে শাকসব্জি— নানাবিধ জিনিস বাড়িতে আনিয়ে নিচ্ছেন। ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডে চলছে কেনাকাটা। রয়েছে অ্যাপ নির্ভর লেনদেনের ব্যবস্থাও। আর জামতাড়ায় বসে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত নানা ধরনের ফাঁদ পেতে গ্রাহকদের পকেট কাটছে সাইবার অপরাধীরা! গোয়েন্দারা বলছেন— অনেকেই কেনাকাটা, খাওয়াদাওয়ার জন্যে ইন্টারনেটে সার্চ করে প্রয়োজনীয় নম্বর খুঁজে নেন। ‘জামতারা গ্যাং’ মূলত ইন্টারনেটে ওই সব সংস্থার আসল নাম ব্যবহার করে ভুয়ো ফোন নম্বর রেজিস্টার করছে। এমনকি গ্রাহকদের বিশ্বাস অর্জন করতে ওই সংস্থার লোকেশন-সহ ভুয়ো ওয়েবসাইটও বানিয়ে নিচ্ছে। তার পর তাদের পাতা ফাঁদে পা ফেলতে বাধ্য করছে ‘জামতাড়া গ্যাং’।

আরও পড়ুন: পরকীয়ার জের! দিল্লিতে গড়ির মধ্যেই মহিলা চিকিৎসককে গুলিতে খুন করে আত্মঘাতী চিকিৎসক

শুধু তাই নয়, এখন আধারের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল নম্বর সংযুক্তি নিয়েও ওই গ্যাং প্রতারণার ফাঁদ পাতছে। কী ভাবে? গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের মোবাইলে একটি টোল ফ্রি নম্বর ভেসে ওঠে। যা পাঠায় ওই প্রতারকরা। বলা হচ্ছে, ওই নম্বর ব্যাঙ্কের কাস্টমার কেয়ারের। এর পর ফোন করে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে— আধারের সঙ্গে মোবাইল নম্বর, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, প্যান কার্ড লিঙ্ক করানো হয়েছে কি? যদি না হয়, সে ক্ষেত্রে আধার নম্বর জানতে চেয়ে কথার জাল বুনে গ্রাহককে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। বলা হচ্ছে, আধারের সঙ্গে লিঙ্ক করিয়ে নিন। একটি ওটিপি পাঠানো হবে। তা ওই নম্বরে ফরওয়ার্ড করতে হবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বরের সঙ্গে। ওই ওটিপি বা ফোনে আপনি গোপন তথ্যগুলি দিলেই গায়েব হয়ে যাবে টাকা। ঠিক একই ভাবে বিমা কোম্পানির নাম করেও ফোন আসছে।

গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, ভবানীপুরের বাসিন্দা রাধানাথ দত্ত (পরিবর্তিত নাম) সম্প্রতি একটি বহুজাতিক কুরিয়ার সংস্থার নম্বরে ফোন করেন। গুগ্‌ল থেকেই তিনি নম্বরটি পেয়েছিলেন। ব্যাঙ্ক থেকে তাঁর এটিএম কার্ড পাঠানো হয়েছিল ওই সংস্থার মাধ্যমে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে কার্ড না-আসায় তিনি কুরিয়ার সংস্থায় যোগাযোগ করেন। সেখানকার এক ‘প্রতিনিধি’ ওই ব্যক্তিকে মোবাইল ওয়ালেটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট একটি অ্যাকাউন্টে ১০ টাকা জমা করতে বলেন। রাধানাথবাবু সেই মতো ১০ টাকা পাঠালে তাঁর মোবাইল ওয়ালেট থেকে ২৫ হাজার টাকা চলে যায় প্রতারকদের অ্যাকাউন্টে।

এই সব কিছুর পিছনেই ওই ‘জামতাড়া গ্যাং’ রয়েছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। গোয়েন্দাদের দাবি, দিল্লি-কলকাতা-মুম্বই-বেঙ্গালরুর মতো শহরে বসে নয়, সাইবার অপরাধীরা কার্যত পিছিয়ে পড়া জামতাড়াতে বসেই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এই অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে।

কিন্তু এই ‘জামতাড়া মডেল’ চলে কী ভাবে?

মোবাইলে ই-রিচার্জের সময় থেকেই শুরু হয়েছে এই ‘কারবার’। মোবাইল সংস্থার নামে ফোন করে আপনার ব্যাঙ্কের তথ্য জেনে টাকা হাতানোর প্রক্রিয়ার সেই শুরু। ফোন করে ফাঁদে ফেলার মূল বিষয়টি এখনও অপরিবর্তিত থাকলেও নতুন নতুন পন্থা বার করেছে ‘জামতাড়া গ্যাং’। আর তাতেই নাস্তানাবুদ দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।

তদন্তের কাজে জামতাড়ায় যাওয়া কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ল্যাপটপ আর ভুয়ো নামের একাধিক মোবাইল সিম নিয়ে দল বেধে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ফোন করে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে ‘জামতাড়া গ্যাং’। ছোট ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে তারা চালায় কল সেন্টারের মতো অফিসও। সেখানে রয়েছে নানা ভাষার ‘ডেস্ক’। সেখানে কাজ করেন বহু তরুণ-তরুণী। কেউ ফোন করছেন বাংলায়, কেউ ওড়িয়া, কেউ আবার তামিল, মালয়ালামে। যাঁর যে ভাষায় দখল রয়েছে, তাঁকে সেই ডেস্কে ‘নিয়োগ’ করা হয়েছে। মানুষের পকেট ফাঁকা করতেই খোলা হয়েছে ওই কল সেন্টার। বিদেশি বিভিন্ন সফটওয়ার ব্যবহার করে চলেছে তথ্য হাতানোর কাজ। এটিএমে স্কিমার যন্ত্র বসিয়ে যে ডেবিট কার্ড ক্লোন করা হয়, তা-ও জামতাড়ায় হচ্ছে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে রীতিমতো দক্ষ অনেক তরুণ-তরুণী এই চক্রে কাজ করছে।

ঝাড়খণ্ডের জামতাড়ার এই সাইবার অপরাধীদের সঙ্গে নাইজেরীয় এবং রোমানীয় গ্যাংয়ের যোগাযোগ রয়েছে বলেও মনে করছেন গোয়েন্দারা। শুধু কলকাতা নয়, গোটা দেশের পুলিশের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে এই জামতাড়া মডেল।

অন্য বিষয়গুলি:

Cyber Crime ATM Fraud Jharkhand Tech
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy