লকডাউনে ঘরে ফেরার তোড়জোড়। (ইনসেটে) রণবীর সিংহ। ছবি: টুইটার থেকে
‘আসতে পারলে আমাকে নিয়ে যাও, প্লিজ’— ফোনের ও প্রান্ত থেকে এই কথাগুলোই বলতে পেরেছিল রণবীর। দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশের মোরেনার গ্রামের বাড়িতে ফেরার সময় পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া রণবীর সিংহ। ৪২ সেকেন্ডের ফোন কলের বাকি সময়টায় রণবীরের পরিজনরা উদভ্রান্তের মতো কখনও বলেছেন, ‘১০০ নম্বরে ডায়াল কর’, ‘অ্যাম্বুল্যান্সে খবর দাও’, ‘ওরা কি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে পারবে না’, হ্যালো, হ্যালো— এমন সব পরামর্শ। কিন্তু কোনও কিছুই আর করতে পারেননি রণবীর। মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে দিল্লি থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে স্ত্রী, তিন সন্তানের কাছে ফেরার মরিয়া চেষ্টা।
দিল্লির তুঘলকাবাদের একটি রেস্তরাঁয় কাজ করতেন রণবীর। থাকতেন কালকাজি কলোনি এলাকায়। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের মোরেনার বডফরায় গ্রামের বাড়িতে ঋণ নিয়ে পাকা বাড়ি করছিলেন। লকডাউন ঘোষণার পরে দিল্লি থেকে ফিরছিলেন হেঁটে। শুক্রবার ২টোর সময় বড় মেয়ে ১২ বছরের দীপাকে ফোন করেছিলেন। দীপাকে তখন বলেছিলেন, ‘‘কোনও উপায় নেই মা, না বাস চলছে, না ট্রেন। হেঁটেই বাড়ি ফিরছি।’’ এর পর বিকেল ৫টার সময় ফের বাড়িতে ফোন করে কথা বলেন রণবীর। সেই সময়ও হেঁটেই চলেছেন। ‘‘তখনও কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না বাবার গলায়’’— বলছিলেন দীপা।
পরের ফোন আসে রাত ৯টায়। তখনই প্রথম বিপদের আঁচ পেয়েছিল পরিবার। ছোট মেয়ে পিঙ্কির সঙ্গে কথা বলেছিলেন রণবীর। মা, দিদির অবিরাম কান্নায় বিপদের আঁচ করলেও ঠিক কি হয়েছে, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি তিন বছরের পিঙ্কি। সোমবার বলছিল, ‘‘বাবা বলেছিল, একটা ট্রাক একটু আগে পৌঁছে দেবে। কিন্তু বাবা খুব ক্লান্ত ছিল। বলছিল, আমার শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। আমি বলেছিলাম, আমরা তোমাকে বাড়িতে দেখতে চাই বাবা।’’
আরও পড়ুন: ফিরতেই হবে! দিল্লি থেকে ২০০ কিমি হেঁটে মাঝপথেই মৃত্যু
শুক্রবার আর বাড়ির কেউ কার্যত কেউ ঘুমোতে পারেননি। শনিবার ভোরেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন সবাই। বড় মেয়ে পিঙ্কি ফের ফোন করে। রণবীর তখন জানান, আগ্রার সিকান্দ্রা রোডের কাছে রয়েছেন। পিঙ্কি জানায়, কিন্তু ওই সময় শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল বাবার। বেশি কথা বলতে পারেননি। শুধু বলছিলেন, বুকে ব্যথা হচ্ছে।
আতঙ্কে পিঙ্কি পাড়ার লোকজন জড়ো করেন। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ রণবীরের শ্যালক অরবিন্দ সিংহ তাঁকে ফোন করেন। আর সেই ফোনেই ছিল রণবীরের শেষ আর্তি, পরিজনদের সঙ্গে শেষ কথা। অরবিন্দ বলছিলেন, ‘‘কথা বলার মতো শক্তিও ছিল না। আমি পুলিশ, অ্যাম্বুল্যান্স, কাউকে পৌঁছে দেওয়ার কথা বললাম। কিন্তু কোনও কিছুই বলতে পারেননি। প্রচণ্ড হাঁপাতে হাঁপাতে শুধু বলতে পেরেছিল, ‘‘পারলে এসে নিয়ে যাও প্লিজ।’’
আরও পড়ুন: করোনায় মৃত বৃদ্ধ, কোয়রান্টিনে আত্মীয়েরা, সৎকার করলেন স্বাস্থ্যকর্মীরা
যে জায়গার কথা রণবীর বলেছিলেন, তাঁদের গ্রাম বাদফরা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। তখন অরবিন্দ-সহ গ্রামের লোকেরাও কম চেষ্টা করেননি সেখানে পৌঁছনোর। এক দল গ্রামেরই এক চিকিৎসকের কাছে গিয়ে গোটা ঘটনার কথা জানিয়ে তাঁর পরিচয়পত্র চান। চিকিৎসকও দিয়ে দেন পরিচয়পত্র। সেটা নিয়ে বাইকে করে রওনা দেন দু’জন। আবার রণবীরদের শরিকি ভাইদের একটি জিপে মালবহনের কাজ করেন। তাঁরা থানায় গিয়ে ‘পাস’ দিতে বলেন। পুলিশ পাস দিলেও অনেক দেরি করে বলে অভিযোগ। তবু পাস-সহ ওই জিপ নিয়ে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা দেন তাঁরা। কিন্তু পৌঁছনোর আগেই সব শেষ। আগ্রার হাসপাতালে গিয়ে যখন পৌঁছলেন, তখন মর্গে কফিনে মোড়া রণবীরের দেহ। অরবিন্দ বলেন, ‘‘আমি যখন শেষ বার ওঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম, মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।’’ রবিবারই আগ্রার হাসপাতাল থেকে দেহ গ্রামে এনে শেষকৃত্য সারা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনিও দিল্লির গ্রেটার কৈলাস এলাকায় একটি অভিজাত রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন। ‘‘আমি ২২ মার্চ ফিরে এসেছিলাম। তখন যদি ওঁকেও জোর করে নিয়ে আসতে পারতাম!’’— আক্ষেপ অরবিন্দের গলায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy