মরিয়া: গত ২৪ মার্চ মধ্যরাত থেকে দেশ জুড়ে লকডাউন ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তার কয়েক দিন পরেই গ্রামের বাড়ি ফেরার বাস ধরতে দৌড় এক পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের। উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে। ছবি: পিটিআই
দৈনন্দিন জীবনে এখন টিকে থাকাটাই যেখানে একমাত্র লক্ষ্য, সেই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মন সংক্রান্ত সমস্যা তো বিলাসিতা মাত্র! এমনটাই বলছেন অনেকে। কিন্তু গরিব দিনমজুর, পরিযায়ী শ্রমিক-সহ প্রান্তিক মানুষের জীবনের অনিশ্চয়তার কথা অস্বীকার না করেও বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, খাবারের সংস্থানের পাশাপাশি ওই বিশাল জনসংখ্যার মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটা নজরে রাখা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি।
খরা-সহ একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরবর্তী সময়চিত্র দেখিয়েছে, আর্থিক বিপন্নতা শুরু হলে কী ভাবে আত্মহত্যার মিছিল শুরু হয়। বিশেষ করে যেখানে একাধিক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাস বলছে, কোভিড-১৯ উত্তর পর্বে সারা বিশ্বে কয়েক কোটি মানুষের জীবিকা বিপন্ন হতে চলেছে। সেখানে প্রান্তিক মানুষেরা যে একেবারে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সে কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই। ফলে খরার ঘটনার পুনরাবৃত্তি থামাতে প্রান্তিক মানুষের মানসিক বিপন্নতার দিকটাও অস্বীকার করলে চলবে না বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস (নিমহ্যানস)-এর প্রাক্তন ডিন ভি কুমারাইয়া বলেন, ‘‘ওই সব প্রান্তিক মানুষের জীবনে সব সময়েই একটা অনিশ্চয়তা থাকে। যা এই সময়ে আরও বেড়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তো বটেই, কাউন্সেলিং না হলে এর পরে মানসিক বিপন্নতা তাঁদের আরও বড় বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।’’ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসেব বলছে, ২০০৯-’১০ সালে দেশে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি। এ রাজ্যে তা ছিল দু’কোটি ৪০ লক্ষের মতো। ২০১১-’১২ সালে যে সংখ্যা হয় সারা দেশে প্রায় সাড়ে ২৭ কোটি, রাজ্যে ১ কোটি ৮৫ লক্ষ। ফলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর মানসিক বিপন্নতা সমাজের প্রতিটি স্তরকেই স্পর্শ করতে বাধ্য।
আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্তের মধ্যে উপসর্গ না থাকলেই ভয় বেশি!
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনৈতিক ভাবে বিপন্ন গোষ্ঠীর সকলেরই যে একই মানসিক সমস্যা, তা নয়। এর আগে দেশের ১২টি রাজ্য, ৪৩টি জেলা, ৮০টি তালুক, ৭২০টি ক্লাস্টার নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভে) দেখিয়েছিল, কী ভাবে জীবিকার অনিশ্চয়তা ব্যক্তিবিশেষে আলাদা-আলাদা প্রভাব ফেলে। সমীক্ষার ‘সোশিয়ো-ডেমোগ্রাফিক ডিফারেন্সিয়ালস’-এর লেখচিত্র দেখিয়েছিল, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর প্রায় দেড় শতাংশের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা খুব বেশি মাত্রায় থাকে। শুধু তা-ই নয়, এই বিপন্নতা মদ্যপানে আসক্তি, মানসিক রোগ-সহ আরও নানা রোগ ডেকে আনে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যার সঙ্গেও এই বিষয়গুলি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা। ওড়িশার এস সি বি মেডিক্যাল কলেজের ‘মেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউট’-এর ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের প্রধান যশোবন্ত মহাপাত্র বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই রয়েছে, প্রান্তিক মানুষদের মানসিক স্বাস্থ্য, তাঁদের সমস্যার কথা শুনতে হবে। তার সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। সেই মতোই পরিযায়ী শ্রমিকেরা এখন যে নৈশাবাস, ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন, সেখানে গিয়ে তাঁদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।’’ ইমিউনোলজিস্ট ইন্দিরা নাথের বক্তব্য, ‘‘খাবারের সংস্থান করা প্রয়োজন। পাশাপাশি এটাও বোঝানো প্রয়োজন, বিশেষ করে এই মুহূর্তে যে, এই দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ তাঁরাও। সরকারের তরফে পরিযায়ী শ্রমিকদের বলতে হবে, রাজ্যের অগ্রগতি, বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তোমাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ওঁদের শুধু পেট নয়, মনও রয়েছে— এটা বুঝতে হবে!’’
তবে পেট ও মনের দ্বন্দ্ব যে এ সময়ে প্রবল হয়ে উঠেছে, তা স্বীকার করছেন সকলেই। কারণ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখিয়েছিল, মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করতে মাসে কমপক্ষে এক-দেড় হাজার টাকা খরচ হয়। যেখানে ‘ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া’-র তথ্য বলছে, ওই টাকায় ৩০০ কিলোগ্রাম চাল-গম (৩ টাকা কিলোগ্রাম দরে চাল ও ২ টাকা কিলোগ্রাম দরে গম) কিনতে পারা যায়!
‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টস’-এর ফেলো, অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর তিলোত্তমা মুখোপাধ্যায়ের যুক্তি, যাঁদের বাড়িতে চাল নেই, তাঁদের কাউন্সেলিং করানোর আগে খাবারের সংস্থান সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা একটা খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। যাঁদের রোজ খাবারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে, তাঁদের কাছে মানসিক সমস্যা হয়তো বিলাসিতার মতো! কিন্তু তবু তার মধ্যেও চেষ্টা করতে হবে আমাদের। না-হলে ভবিষ্যতে পরিণাম বিপজ্জনক হতে পারে।’’
আরও পড়ুন: করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মুখ আদিত্য-বিজয়েরা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy