Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
Odisha Train Accident Witness

ভাগ্যিস দরজাটা বন্ধ হল, না হলে আমিও মরতাম! মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলেন ক্যানিংয়ের কৃষ্ণপদ

আমাদের সংরক্ষিত কামরাগুলির আগে ছিল অসংরক্ষিত কামরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই কামরাগুলিই। তাতে যে কত মানুষের প্রাণ গিয়েছে ভাবতেও পারছি না!

Image of the passenger of the coromandel express

প্রশান্ত মণ্ডল (বাঁ দিকে) এবং কৃষ্ণপদ মণ্ডল (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

কৃষ্ণপদ মণ্ডল
বালেশ্বর শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২৩ ০৪:১৮
Share: Save:

কোয়েম্বত্তূরে কাজে যোগ দিতে যাব। কাকার সঙ্গে টিকিট কেটেছিলাম স্লিপার ক্লাসে। এস ৪ কামরায় আমরা ছিলাম। কথা ছিল, শনিবার রাতের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছব। রবিবার থেকেই তা হলে কাজে যোগ। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কেমন ঘোলাটে লাগছে।

বাড়ি থেকে কিছু শুকনো খাবার নিয়ে ট্রেনে ওঠাই আমাদের অভ্যাস। ট্রেন ছাড়লে দু’এক কাপ চা, সঙ্গে বাড়ি থেকে আনা চিঁড়ে, মুড়ি। গল্পগুজব করতে করতেই কখন যে সময় কেটে যায় মালুম হয় না। আজও তেমনই চলছিল। গল্পগুজব আর ঠাট্টা, তামাশা জমে উঠেছিল যাত্রীদের মধ্যে। ওড়িশার বালেশ্বর স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়েছিল কিছু ক্ষণ। হাওড়া থেকে বোতলে যে ঠান্ডা জল ভরে ট্রেনে উঠেছিলাম, খড়্গপুর পেরোতেই তা শেষ। তাই বালেশ্বর স্টেশনে নেমে বোতলে জল ভরে নিই। সহযাত্রীদেরও কয়েকটি বোতলে জল ভরি। তার পর আবার ট্রেনে উঠে যাই। কিন্তু নিজের আসনে না ফিরে দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম দু’চার জনের সঙ্গে। ট্রেন গতি বাড়াতেই খোলা দরজা দিয়ে গরম হাওয়া আসছে। তার মধ্যেই এক বার মুখ বার করে বাইরেটা দেখেছিলাম। আমাদের ক্যানিংয়ের সঙ্গে কত যে মিল... বিঘার পর বিঘা চাষের জমি, গাছপালা।

কোয়েম্বত্তূরে কাকার সঙ্গেই মার্বেল পাথরের কাজ করি। সামান্য আয়। ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে গাঁয়ে ফিরে নিজে কিছু একটা করব। আর যাব না অত দূরে। কিন্তু এ বার তো যেতেই হবে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লোকজনের সঙ্গে তা নিয়েই কথা হচ্ছিল। সাধ করে কে আর যেতে চায় বাড়ি ছেড়ে অত দূরে। হঠাৎই বিকট একটা ঝাঁকুনি। তখন ৭টা মতো বাজে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের কামরা এক দিকে হেলে পড়তে থাকে। এস ৪ কামরা এতটাই কাত হয়ে যায় যে খোলা দরজা গলে বাইরে পড়ে যান দু’তিন জন। ওদের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। বুঝতে পারছি, আমিও হেলে পড়ছি খোলা দরজার দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই লোহার দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যায়। আমি গিয়ে পড়ি সেই দরজার উপর। এক মুহূর্ত আগে পড়লে আমিও ট্রেন থেকে বাইরে পড়ে যেতাম। কী বাঁচা যে বেঁচেছি, তা শুধু আমিই জানি।

মুহূর্তের মধ্যে কী হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার গায়ে তখন এসে পড়েছে আরও কয়েক জন। দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বুঝলাম, আমাদের কামরাটি উল্টে গিয়েছে পুরো। দুর্ঘটনায় পড়েছি। সেই মুহূর্তে চারদিক থেকে কেবল চিৎকার আর আর্তনাদের শব্দ। হঠাৎ খেয়াল হল, কাকা কোথায়? খুঁজতে যে যাব, তারও উপায় নেই। কাঁধে, হাতে, পায়ে, কপালের কোণে চোট পেয়েছি। আর যে ভাবে পড়ে আছি, একা ওঠার সাধ্য নেই।

এ ভাবেই কাটল কিছু ক্ষণ। এর মধ্যে আমাদের কামরা বেশ কয়েক বার দুলে ওঠে। তাতে ভয় আরও বাড়ে। সেই সময় আরও কয়েকটি কানফাটানো আওয়াজ শুনেছিলাম। জানি না কোথা থেকে আসছিল। বেশ কিছু ক্ষণ মড়ার মতো পড়েছিলাম সেখানেই। তার পর শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। তত ক্ষণে বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেকেই দেখলাম মোবাইলের টর্চ জ্বেলে দৌড়চ্ছেন আর চিৎকার করছেন, বাঁচাও, বাঁচাও। কী করব, কোথায় যাব কিছুই মাথায় আসছে না। সত্যি বলতে কী, বুঝেই উঠতে পারছি না, সত্যিই কি বেঁচে আছি?

কোনও মতে উঠে দাঁড়াই উল্টে পড়া কামরায়। তার পর টলতে টলতে কামরার ভিতর দিকে ঢুকতে চেষ্টা করি। কাকা কোথায়? অন্ধকারে কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। কাকা-কাকা বলে বার কয়েক ডাকলাম কিন্তু সাড়া পেলাম না। গোটা কামরায় তখন চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ। অন্ধকারে কিছুই ভাল মতো দেখা যাচ্ছে না। এমন সময় কাকাকে দেখতে পেলাম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম যেন! কাকা বলল, তারও পায়ে চোট লেগেছে, কিন্তু প্রাণে বেঁচে আছে দেখে একটু যেন নিশ্চিত হলাম।

এ বার কাকাকে নিয়ে কামরা ছেড়ে বেরোতে হবে। অনেকেই আমার মতো বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করছেন। আমাদের সঙ্গে থাকা মালপত্রের মায়া ত্যাগ করে তাঁদের দেখাদেখি আমরা দু’জনও কোনও রকমে কামরা ছেড়ে বাইরে বেরোই। আর বেরিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মুহূর্তে হিম হয়ে গেল! চারদিকে ছড়ানো ট্রেনের বিশাল বিশাল সমস্ত কামরা। কোনওটা মালগাড়ির উপরে ঝুলছে। কোনও কামরা আবার অন্য কামরার তলায় ঢুকে গিয়েছে। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে দেহাংশ! তত ক্ষণে আশপাশের লোকজন আসতে শুরু করেছেন। উদ্ধারকাজ শুরু করে দিয়েছেন ট্রেনের যাত্রীরা। কিন্তু অন্ধকারে কিছুই ভাল দেখা যাচ্ছে না।

কিছু ক্ষণ পর অন্ধকারে চোখ সয়ে গেল। অনেকটাই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বুঝলাম, এস ৩ এবং এস ২ কামরা দু’টি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমাদের সংরক্ষিত কামরাগুলির আগে ছিল অসংরক্ষিত কামরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই অসংরক্ষিত কামরাগুলিই। ওই কামরাগুলোতে যে কত মানুষের প্রাণ গিয়েছে, ভাবতেও পারছি না। মাথা কাজ করছিল না। কাকার সঙ্গে আমিও নেমে পড়লাম উদ্ধারে। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে হাত নড়ছিল না। মুখ দিয়ে কথাও ফুটছে না। বাপের জন্মেও এমন দৃশ্য দেখিনি আমি। কাকারও একই অবস্থা।

এ দিকে গলা শুকিয়ে কাঠ। কিন্তু বালেশ্বর স্টেশন থেকে ভরা জলের বোতল যে এখন কোথায়, জানি না। ঘড়ি দেখিনি। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষণ পর রেলের লোকজন পৌঁছয়। বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর লোকজনকেও দেখলাম। চারপাশ থেকেই অ্যাম্বুল্যান্সের আওয়াজ পাচ্ছিলাম গোটা সময় ধরে। হয়তো আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ওইগুলিতে। কাকার মাথা ঘুরছিল। একটু ফাঁকা একটি জায়গায় কাকাকে নিয়ে গিয়ে বসাই। তার পর সেখানে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এসে আমাদের হাতে জল তুলে দেয়। কিছু বিস্কুটও কেউ এনে দিল হাতে। কিন্তু এই অবস্থায় বসে খাবার কি আর গলা দিয়ে নামে!

(লেখক দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসের যাত্রী)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE