পাশেই আছি। পার্টি কংগ্রেস শেষে বিশাখাপত্তনম ছাড়ার আগে বিমানবন্দরে বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রের সঙ্গে সিপিএমের নতুন সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সোমবার। ছবি: সন্দীপন চক্রবর্তী।
প্রকাশ কারাটের পরে সীতারাম ইয়েচুরি। নেতৃত্বের হাত বদলেও কিন্তু ‘পরিবর্তন’ হল না সিপিএমে। অব্যাহত রইল দক্ষিণের দাপট। বাংলা সেই দ্বিতীয় সারিতেই!
অথচ রামচন্দ্রন পিল্লাইকে টপকে দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ দখলে ইয়েচুরির ভরসা ছিল আলিমুদ্দিনই। কলকাতা থেকে তাঁর হয়ে প্রবল লড়াই করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যোগ্য সঙ্গত করেছেন বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা। কিন্তু কেরলের পিল্লাই, না অন্ধ্রপ্রদেশের ইয়েচুরি— এই প্রশ্নেই আটকে রইল সিপিএম। পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে ৩৪ বছর রাজ্যে ক্ষমতায় থেকেও কোনও বাঙালিকে শীর্ষ নেতৃত্বে বসাতে ব্যর্থ বাংলা। ফলে, ‘‘আমাদের দল তো এখন কমিউনিস্ট পার্টি অব সাউথ ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট),’’ এমন কটাক্ষ ছাড়া কিছুই করার নেই আলিমুদ্দিনের নেতাদের। সান্ত্বনা বলতে, ইয়েচুরি বাংলা থেকে রাজ্যসভার সাংসদ আর ভাঙা ভাঙা হলেও বাংলাটা বলতে পারেন।
ইতিহাস বলছে, অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘোষের জমানাই শেষ শীর্ষ স্তরে বাঙালি আমল। ছয়ের দশকের গোড়ায় অজয়বাবুর মৃত্যুর পরে দলের চেয়ারম্যান হিসাবে মহারাষ্ট্রের এস এ ডাঙ্গের জমানা শুরু। যাঁর লাইনের প্রতিবাদ করে ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে ভাঙন এবং সিপিএমের জন্ম। অজয়বাবু-ডাঙ্গেদের আগে উত্তর ভারতের পি সি জোশী ও পরে সিপিএমে পঞ্জাবের হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ— দক্ষিণ ভারতের বাইরে কমিউনিস্ট পার্টির রাশ হাতে পেয়েছেন এই ক’জনই! সাধারণ সম্পাদকই নয়, সিপিএমের জন্মলগ্নের পলিটব্যুরোয় পি রামমূর্তি, এম বাসপবুন্নাইয়া, বি টি রণদিভে, এ কে গোপালন থেকে হাল আমলে এস আর পিল্লাই, পিনারাই বিজয়ন, কোডিয়ারি বালকৃষ্ণন, বি ভি রাঘবুলু, এম এ বেবি, এ কে পদ্ননাভন— দক্ষিণীদের আধিপত্যই যেন অলিখিত নিয়ম!
বাংলার ব্যর্থতার পিছনে সিপিএমেরই একাংশের ব্যাখ্যা হল, এর জন্য দায়ী আসলে সেই ‘অনিলায়ন’। সিপিএমের প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের হাত ধরে যে ভাবে শিক্ষা ব্যবস্থায় মধ্যমেধার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার ফল ভুগতে হয়েছে দলকেও! সর্বভারতীয় স্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো ভাষাজ্ঞান ও মেধাসম্পন্ন নেতা সিপিএম বাংলা থেকে তুলে আনতে পারেনি। জ্যোতি বসু চেষ্টা করেছিলেন অশোক মিত্র, বিপ্লব দাশগুপ্ত, অসীম দাশগুপ্তের মতো কেতাবি বিদ্যায় দক্ষ ব্যক্তিত্বকে গুরুত্ব দিতে। সফল হননি। বরং, সংগঠনের প্রয়োজনে ক্যাডার বাহিনী গড়ে তুলে সুভাষ চক্রবর্তী, দীপক সরকারেরাই ছড়ি ঘুরিয়েছেন! দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে ব্রাত্য হয়েছেন সৈফুদ্দিন চৌধুরী, বিতাড়িত হয়েছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। রাজ্যসভায় বলিয়ে-কইয়ে সাংসদ পাঠানোর জন্য ইয়েচুরি এবং বিবাহ সূত্রে দক্ষিণী বৃন্দা কারাটকে ডেকে আনতে হয়েছিল স্বয়ং অনিলবাবুকেই!
দলের একাংশ অবশ্য বলছে, পিল্লাই হলে তবু কথা ছিল, কিন্তু ইয়েচুরিকে এখন আর দক্ষিণী বলে ধরা যায় না। পলিটব্যুরোর এক সদস্যের কথায়, ‘‘জন্মসূত্রে সীতারাম তেলুগু ঠিকই। কিন্তু জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, তরুণ বয়স থেকে দিল্লির দরবারেই রাজনীতিতে হাত পাকিয়েছে। সারা ভারতেই ও পরিচিত নাম। হিন্দিটাও অন্য দক্ষিণীদের চেয়ে ভাল বলে!’’
দলীয় নেতৃত্ব যা-ই বলুন, সিপিএমের দক্ষিণী ঝোঁকের ইঙ্গিত আরও অনেক। কোয়ম্বত্তূর, কোঝিকোড় এবং এ বার বিশাখাপত্তনম— পরপর তিন বার দলের পার্টি কংগ্রেস হল দক্ষিণের মাটিতেই! এ বারের ২১তম পার্টি কংগ্রেসের সাংগঠনিক রিপোর্টেও কেরলের রাজ্য শাখার জন্য প্রশংসা বরাদ্দ হয়েছে অনেকটা! কারণ, দিল্লিতে হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের নামে ভবন গড়ে তোলার জন্য সিপিএম যে ৮ কোটি ৯৮ লক্ষ ৫৫ হাজার টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছে, তার মধ্যে ৮ কোটি ৯১ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকাই এসেছে কেরল থেকে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, জম্মু ও কাশ্মীরে ত্রাণের জন্য ৯১ লক্ষ ৮৯ হাজার এবং মুজফ্ফরনগরে সংঘর্ষ-পীড়িতদের জন্য ৪৫ লক্ষ ২৭ হাজার টাকা তুলে দিয়েছে কেরল ইউনিটই। সদস্যপদেও ছবিটা একই। বাংলায় যেখানে গত তিন বছরে ৩৯ হাজার ৯৬৮ জন সদস্য কমেছে, কেরলে বেড়েছে ৩৪ হাজার ৬৯২ জন। বিশাখাপত্তনমে পোর্ট স্টেডিয়াম চত্বরে দাঁড়িয়ে কেরলের এক সিপিএম সাংসদ হাসতে হাসতেই বলছিলেন, ‘‘বাংলার পাশে আমরা অবশ্যই আছি। কিন্তু কেরলই এখন পার্টিটা চালাচ্ছে!’’ কলেবরে এবং ভাঁড়ারে বাংলাকে টেক্কা দিয়ে যাচ্ছে কেরল অর্থাত্ দক্ষিণী লবি! সুতরাং সংগঠনেও তাদেরই রমরমা।
কিন্তু ক’বছর আগেও যখন বাংলা থেকে দিল্লিতে দল চালানোর টাকা যেত, সাংসদ পাঠানো হতো গণ্ডায় গণ্ডায়, তখনও সর্বভারতীয় সংগঠনে রাজ্যের দাপট ছিল না কেন? দিল্লিবাসী হয়েও কেন তেমন কল্কে পাননি নীলোৎপল বসু? এক বাঙালি নেতার অক্ষেপ, ‘‘মাঝে মাঝে মনে হয়, এর চেয়ে পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক একটা আলাদা দল গড়লেই বোধহয় ভাল হতো!’’
তবে বাংলায় সংগঠন যদি শেষ হয়ে যায়, তা হলে যে গোটা দলেরই বিপদ, সেটা দায়িত্ব নিয়েই বুঝেছেন ইয়েচুরি। প্রথম দিনেই জানিয়ে দিয়েছেন, বামেদের প্রতি রাজ্যের মানুষের আস্থা ফেরানোর জন্য রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভাবে যা যা করণীয়, সব করবেন। দরকার হলে জেলায় জেলায় কর্মসূচিও নেবেন। বাংলায় সিপিএম কর্মীরা মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন, এমন কথা মানতে নারাজ ইয়েচুরি সোমবার বলেন, ‘‘বাংলায় কর্মীরা প্রতিরোধ করছেন বলেই তাঁদের উপরে আক্রমণ হচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানেন বামেদের পুনরুত্থান মানেই ওঁদের বিপদ! তাই মেরেধরে, যে কোনও উপায়ে সকলের কণ্ঠরোধ করে পঞ্চায়েত থেকে পুরসভা— সব স্থানীয় প্রশাসন দখল করতে চাইছেন।’’
পার্টি কংগ্রেস শেষে সোমবার দিল্লি ফিরে গিয়েছেন ইয়েচুরি, প্রকাশ, বৃন্দা, পিল্লাইরা। বিদায় নেওয়ার আগে বিশাখাপত্তনম বিমানবন্দরেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে দলের নতুন পলিটব্যুরোয় তিন সতীর্থ সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু ও মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপচারিতা সেরে নিয়েছেন ইয়েচুরি। সূর্যবাবু, বিমানবাবুদের আশ্বাস দিয়েছেন, তাঁর মতো করে বাংলার জন্য যখনই যা করা সম্ভব, রাজ্য নেতৃত্বকে তিনি জানিয়ে দেবেন। বাংলায় তেমন কোনও বড় ঘটনা ঘটলে দিল্লি থেকে সংসদীয় দল পাঠিয়ে জাতীয় স্তরে তাকে তুলে ধরবেন। বিমানবন্দরে বিমানবাবুদের হাত ধরে নয়া সাধারণ সম্পাদক বলে গিয়েছেন, চিন্তার কিছু নেই।
আলিমুদ্দিন চাইলেও এখনই পশ্চিমবঙ্গে আসতে পারছেন না ইয়েচুরি। আনন্দবাজারকে এ দিন তিনি বলেন, ‘‘এই সপ্তাহে সংসদ খুলে গিয়ে মুশকিল হয়ে গেল। একটু সামলে নিয়ে তার পরেই যাব।’’ ব্যক্তিগত ভাবে ইয়েচুরি আর সাংসদ থাকতে বিশেষ আগ্রহী নন। সংগঠনের কাজেই অনেক বেশি নজর দিতে হবে তাঁকে। কিন্তু তিনি এখন ইস্তফা দিলে রাজ্যসভার ওই আসনটি উপনির্বাচনে তৃণমূলের দখলে চলে যাবে। তাই ২০১৭ পর্যন্ত ইয়েচুরির সংসদীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়া মুশকিল।
আর যত দিন তিনি সাংসদ আছেন, তত দিন তা-ও বাংলার নামটা সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে একটু হলেও জুড়ে থাকবে! বিশাখাপত্তনমে এ বারের পার্টি কংগ্রেস শেষ হয়েছে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সঙ্গীত বাংলায় গেয়ে। সভাকক্ষ ছাড়তে ছাড়তে এ রাজ্যের এক প্রতিনিধির আক্ষেপ, ‘‘বাংলায় আন্তর্জাতিক, সাধারণ সম্পাদক বাংলা থেকে সাংসদ। আমাদের এই সব সান্ত্বনাই সম্বল!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy