খরায় শুকিয়ে গিয়েছে গাছ। ওয়ার্ধায়। নিজস্ব চিত্র
ভরদুপুরে মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে ছিলেন বছর তিরিশের সন্দীপ দাণ্ডে। মাস খানেক আগে সাত একর জমিতে হাল চষেছেন। তার পর আর চাষের খেতে যাননি। কারণ, বৃষ্টি নেই। পাম্প চালিয়েও জল উঠছে না। অতএব, সারা দিন বাড়িতেই বসে থাকেন।
ওয়ার্ধা জেলার সমুদ্রপুরে এই চাষির কাছে খরার প্রসঙ্গ তুলতে পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘চাষ করেই বা কী হবে? এক সময় কাপাস তুলো চাষ করে বাপ-দাদা আয় করত। আর এখন? গত তিন বছর ধরে খরা। তার উপরে অর্ধেক ফসল পোকায় খাচ্ছে!’’ সন্দীপের পাশেই বসে ছিলেন আর এক কৃষক গজানন্দ চৌধুরী। বাবা, মা, ছেলে, মেয়ে, স্ত্রীর সংসারের একমাত্র রোজগেরে গজানন্দ বলেন, ‘‘শেষমেশ যা ফসল হল, তা বিক্রি করে মহাজনের ধার শোধ করব না জমাব?’’
মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার যে গ্রামগুলি খরায় সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের মধ্যে অন্যতম সমুদ্রপুর। বেশির ভাগই মাঝারি জোতের মালিক। কারও পাঁচ একর, কারও দশ একর, কারও পনেরো একর জমি। তাতেও মরসুম শেষে হিমশিম দশা। কেন?
সন্দীপেরা জানান, সারের দাম বাড়ছে। কেউই একবারে পয়সা দিয়ে সার কেনেন না। মহাজন বাকিতে সার দেন। তবে মরসুম শেষে ফসল বিক্রি করে দাম দিতে গেলে ৩ শতাংশ বেশি দাম গুণতে হয়। পাঁচ একর জমিতে তুলো চাষ করলে সার, মজুরি, কীটনাশক সব মিলিয়ে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ। পাঁচ একর জমি থেকে ২৫ কুইন্টাল কাপাস তুলো হলে তা বিক্রি করে হাজার পঁচিশেক টাকা লাভ হয়। গজানন্দদের কথায়, ‘‘গত বছর পোকার জন্য ৩০ শতাংশ ফলন কম হয়েছে। ভাবুন, লাভের টাকা কতটা পোকায় খেল!’’
ওয়ার্ধায় গাঁধীজির সেবাগ্রাম লাগোয়া মাধবগড় গ্রামের রবি ভুজারে পড়েছেন আরও সঙ্কটে। গ্রামের সম্পন্ন চাষি, তার উপরে প্রাক্তন সরপঞ্চ। গ্রামে প্রভাবও আছে। কিন্তু খরার জেরে বছর-বছর লোকসানের বহর বাড়ছে। খর গ্রীষ্মের দুপুরে বৈঠকখানায় বসে আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘ছেলে-মেয়ে ইংরেজি স্কুলে পড়ে। কত খরচ। এ দিকে চাষের মাঠ শুকিয়ে যাচ্ছে, পোকায় ফসল খাচ্ছে। বাকিরা তবু এ দিক, সে দিক দিনমজুরি করতে পারে। আমার তো সে উপায়ও নেই!’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘চাষ তো মজুর দিয়ে করিয়ে এসেছি। বাকি মজুরদের সঙ্গে কি খেটে পারব? আমায় যিনি নেবেন, তাঁর তো লাভ হবে না। আমিও নিজে কাজ চাইতে পারব না।’’
অনেক চাষি তাই কাপাস ছাড়াও সয়াবিন চাষ করেন। কেউ কেউ সয়াবিনের পরে অড়হর ডাল বা ছোলা চাষ করবেন বলে ভেবেছেন। ‘‘কিন্ত চাষ করব বললেই তো হয় না। জল কোথায়?’’ বলেন সন্দীপ। জানান, অগস্ট-সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি হলে কুয়ো বা ডোবায় জল জমবে। সেই জলেই ডাল চাষ হয়। যাঁদের সে সামর্থ্য নেই, তাঁরা ওই সময় অন্যের জমিতে দিনমজুর খেটে কিছুটা আয় করেন।
বিদর্ভের বেশির ভাগ জেলাতেই সেচের জল বলতে বৃষ্টির জল এবং মাটির তলার জল। ওয়ার্ধা সদর থেকে সমুদ্রপুরে আসতে আসতে দেখেছিলাম, বিরাট নদীখাত। তবে নামেই নদী। জলের লেশমাত্র নেই। স্থানীয় বাসিন্দা জনরাও নাগমোতে বলছিলেন, ‘‘এই বোর নদী এখানে জলের অন্যতম উৎস। ভাল বৃষ্টি হলে জলে ভরে যায়। কিন্তু এখন দেখুন, কে বলবে নদী?’’ নদীর গা ঘেঁষে কিছু খাল রয়েছে। সেগুলিও শুকিয়ে কাঠ। কৃষকেরাই বললেন, চাষের জল মানে মাটির তলা থেকে পাম্পে তোলা জল। কিন্তু টানা খরা চললে সেই জলই বা থাকবে কী করে? তার উপরে মালভূমি এলাকা। বহু জমিই নদী থেকে অনেক উপরে। ফলে সেচের জল পৌঁছয় না। মরাঠী ভাষায় যাকে বলে, ‘কোড়ড়বা’।
মাধবগড়ের তেজচন্দ্র পাটিলের অবশ্য এক কথা। ‘‘বর্ষাকালে যদি বৃষ্টি না-হয়, তা হলে এ সব ভেবে লাভ কী?’’ গত বছরের কাপাসের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে এ বার আখ চাষে জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু বিধি বাম! তীব্র খরা এবং তাপপ্রবাহে আখের চারা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। ৬০ ছুঁই ছুঁই বললেন, ‘‘মহাজন, ব্যাঙ্ক, পোকা, খরা— লাভের চিনি সবাই পায়। পায় না শুধু চাষি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy