ফাইল চিত্র।
হরিদ্বারের গঙ্গার উপরের আকাশে সারা দিনমান অজস্র টিয়ার ওড়াউড়ি। প্রবল রোদ জল থেকে যে বাষ্প শুষে নেয়, ওরা কি তার স্পর্শ পায়?
টিয়াদের করোনার ভয় নেই। ভয়ে মানুষেরই অগ্রাধিকার, তাই ভয় কাটানোর নানান পন্থার খোঁজ তাকেই করতে হয়। তন্ত্রসাধকেরা ভয়ের ভিতরে ডুব দিয়ে ভয় কাটানোর নিদান দেন। অমাবস্যার রাতে শ্মশানে শবাসনে যে বসে পড়তে পেরেছে এক বার, ভয়ের তাকে ভয় না পেয়ে উপায় আছে? তেমন করেই হয়তো ঘনঘোর বিপদে ঝাঁপ দিয়ে বিপদমুক্তির রাস্তা খোঁজেন অনেকে। আবার কারও কারও মনে হয় সংযোগের মাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবে কেন? আমিই তো সে, সোঅহম!
কোন ঘাটে সবচেয়ে বেশি স্রোতের টান, তাই নিয়ে তর্ক চলছিল দু'জনের মধ্যে। শেষমেশ তাঁরা একমত হওয়ায় তাঁদের পিছুপিছু বিষ্ণুঘাটে যাওয়া গেল। রাত্রি বারোটার কিছু পরে জলে হাত ডোবাতেই শক খেলাম যেন। ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা নেমে এলে দাঁড়ানো যায় না, মনে হয় গঙ্গা এক ঝটকায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কে জানে কোথায়! এই প্রাবল্য থেকেই জলবিদ্যুতের জন্ম আবার ওই প্রাবল্য দিয়েই প্রকৃতি প্রতিরোধ করে বিন্যাস বদলের, কয়েক বছর পর পরই হড়পা বান অসংখ্য প্রাণ কেড়ে নেয় উত্তরাখণ্ডে।
তারকেশ্বরে শিব মানে শ্রাবণ আর হরিদ্বারে শিবের নাম প্লাবন।
কুণ্ডের সামনে বসে এক সাধু উচ্চারণ করে যাচ্ছিলেন, “পাশবদ্ধো ভবেৎ জীবঃ, পাশমুক্তঃ সদা শিবঃ”।
লজ্জা, ঘৃণা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, ভয়, ক্রোধ, কাম- অষ্টপাশ থেকে যে মুক্ত সেই শিব, এমন বিশ্বাস থেকেই ‘হর হর মহাদেব’-এর কল্পনা।
‘কিন্তু আমি-আপনি শিব হব কী করে, আমরা কি শুধু বেলপাতায় সন্তুষ্ট?’
উত্তরহীন প্রশ্নের পৃথিবীতে, প্রশ্নকেই উত্তরের মর্যাদা দিয়ে সরে আসতে গিয়ে দেখি, পঞ্চায়তী আখাড়ার সামনের অশ্বত্থের ডালে দু’জন মানতের সুতো বাঁধছেন, খুলছেন এক জন। আচ্ছা, কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারেন, তাঁর বাঁধা সুতো অন্য কেউ খোলেননি, তিনি খুলে নিচ্ছেন না অন্য কারও প্রার্থনার ধাগা? এক জনের চাওয়া, অন্য জনের পাওয়ায় বদলাতে থাকে, ঘুরন্ত রুলেট কোন মুহূর্তে থমকে গিয়ে কাকে রাজা করে দেবে, কে বলবে?
— এই এক জনই দেবতা যে ভিখারি হয়ে থাকতে চায়, ভোলাগিরি আশ্রমের কাছে একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট মেয়েদের হাতের বালা দর করছিলেন একজন সাধু।
“সারা বছর কত বাড়ি যাই, বাচ্চাদের জন্য কিছু না নিয়ে গেলে চলে?’’
লৌকিকতা থেকে তবে সন্ন্যাসীরও ছাড় নেই? ‘‘পূর্ণ কুম্ভ মানে যেখানে জল আর জলাধার মিলিত হয়েছে, জীবাত্মা আর পরমাত্মার মতো।’’ সাজানো ট্র্যাক্টরে বসে থাকা অন্য এক সাধুর কথা কানে এল।
একটু এগিয়ে গিয়ে জানলাম, অর্থবলে বলীয়ান বেশ কিছু আখাড়া এই কুম্ভ উপলক্ষে ‘ট্র্যাক্টর’ ভাড়া করে থাকে, ‘সাধুমহারাজ’রা তার উপরে চেপেই স্নানের জন্য যান। ট্র্যাক্টর ভাড়া দিয়ে লাভের কড়ি গুনে নেন যাঁরা, তাঁরা কুলাক। আর জমিতে জমিতে উদয়াস্ত খাটলেও যাঁদের মজুরিবৃদ্ধির দাবি শিরোনামে আসে না, সেই খেতমজুররা এখানেও ট্র্যাক্টরের ‘হেল্পার’, ‘ক্লিনার’, ‘ডেকরেটর’ কিংবা ‘ড্রাইভার’ হয়ে খাটতে এসেছেন।
“ট্র্যাক্টর জমিতে যেমন চলে, রাস্তাতেও তেমনই চলে”, এক জন ড্রাইভারের মুখে শুনলাম।
তাই যদি তবে, রাজার ঘরের ধন টুনটুনির পার্সেই বা চলবে না কেন?
মাটির কলসের দেওয়াল ফেটে গেলে যেমন জলাধারের অস্তিত্ব থাকে না, ‘প্রাইভেট প্রপার্টি’র ধারণা চুরমার হয়ে গেলেই ফসলের সুষম বণ্টন হয়ে উঠতে পারে আমাদের ধর্ম।
নগ্ন সন্ন্যাসী মানে সস্তার সার্কাস নয়, বরং একটা বার্তা; যার হারাবার কিছুই নেই, কেবল সেই সন্ন্যাসী!
আজকের শাহি স্নানের শেষে কুম্ভের ভিড় কমতে শুরু করবে, কলসের জল গড়িয়ে যাবে ভাঁড়ে, ঘটিতে বা আঁজলায়। যা আমার তা যে আসলে অনন্তের, এই বোধের নামই কুম্ভ।
অর্থভিক্ষা, মানভিক্ষা, লাইক-ভিক্ষার তরে হাপিত্যেশ করে বসে থাকতে থাকতে আমরা ভুলে যাই আমাদের প্রতিটি মুহূর্তের গা-ঘেঁষে যে মহাকাল দাঁড়িয়ে আছেন, কলস ছাপিয়ে তাঁর ধ্বনি শোনা যাচ্ছে।
তিনি তাঁর জটার নদীকে খুলে দিয়েছেন। কারণ, লোভ আর অহঙ্কারের বাঁধগুলো অনেক মানুষকে অনেক দিন তৃষ্ণার্ত করে রেখেছে।
এ বার সেই তৃষ্ণা মেটবার সময়। মহাকাল আর মুহূর্তের গলা মেলানোর সময়।
ভূমিহীন কৃষক, আখাড়াহীন সন্ন্যাসী, পতাকাহীন দিগন্ত যে রকম মিলেমিশে গিয়েছে।
কুম্ভের ক্যানভ্যাসে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy