Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

নিশানায় চিন, এক ঢিলে তিন বার্তা মোদীর

সম্প্রতি জাপান সফরে গিয়ে চিন সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। মনে করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে এক ঢিলে তিনটি বার্তার কৌশল নিয়েছেন তিনি। সাধারণ ভাবে বিদেশের মাটিতে গিয়ে তৃতীয় কোনও দেশের সম্পর্কে মন্তব্য করা কূটনৈতিক সহবত বা ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে না। সে কথা মোদী জানতেন না, এমনটা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, চিন, জাপান এবং আমেরিকা এই তিনটি দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখা এবং কূটনৈতিক ক্যালেন্ডার মাথায় রেখেই বেজিং-এর ‘আগ্রাসী নীতি’ নিয়ে কৌশলগত ভাবেই সরব হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:৪৫
Share: Save:

সম্প্রতি জাপান সফরে গিয়ে চিন সম্পর্কে কড়া মন্তব্য করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। মনে করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে এক ঢিলে তিনটি বার্তার কৌশল নিয়েছেন তিনি। সাধারণ ভাবে বিদেশের মাটিতে গিয়ে তৃতীয় কোনও দেশের সম্পর্কে মন্তব্য করা কূটনৈতিক সহবত বা ঐতিহ্যের মধ্যে পড়ে না। সে কথা মোদী জানতেন না, এমনটা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, চিন, জাপান এবং আমেরিকা এই তিনটি দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখা এবং কূটনৈতিক ক্যালেন্ডার মাথায় রেখেই বেজিং-এর ‘আগ্রাসী নীতি’ নিয়ে কৌশলগত ভাবেই সরব হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে চিনের প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং আসছেন নয়াদিল্লি সফরে। তাঁর সঙ্গে বৈঠক সফল করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে সাউথ ব্লক। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে মোদী এ-ও বলেছেন, “আমি চিনা নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে কাজ করতে চাই। যাতে দু’দেশের মধ্যে বকেয়া কৌশলগত বিষয়গুলির সমাধান করে উন্নয়নের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া যায়।” ফলে সি জিনপিং-এর সফরের ঠিক আগে, চিন নিয়ে মোদী কেন এই মন্তব্য করলেন, তা নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, একটি নয়, মোদীর আক্রমণাত্মক হওয়ার কারণ তিনটি।

প্রথমত, চিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে নিজেদের স্বর কিছুটা চড়িয়ে রাখতে চাইছেন মোদী। অরুণাচলকে চিনা ভূখন্ড হিসেবে দাবি করা থেকে শুরু করে সীমান্ত বরাবর লাগাতার চিনা সেনার অনুপ্রবেশের মধ্য দিয়ে বেজিং ক্রমাগত নয়াদিল্লির ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলেই চলেছে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতে চিনা সামরিক ঘাঁটি পোক্ত করে এক ধরনের পরোক্ষ চাপও তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি, দক্ষিণ চিনা সাগর নিয়ে বেজিং-এর দখলদারির নীতির কারণে তেল উত্তোলন বন্ধ করতে হয়েছে ভারতকে। এটা ঠিকই যে ভারতের চিন-নীতিতে এই সমস্ত মতপার্থক্যকে আলাদা করে রেখে, সব সময়ই চেষ্টা হয়েছে বাণিজ্য সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কে যে প্রবল ঘাটতি রয়েছে তাকে কমিয়ে ভারত চাইছে রফতানি বাড়াতে। কিন্তু চিনের সঙ্গে সেই দরকষাকষির জায়গাটিতে নিজেদের ঘাড় ঝোঁকাতে চাইছেন না মোদী। সেই সঙ্কেত তাঁর জাপানে করা মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। মোদী চাইছেন স্নায়ুর যুদ্ধে চিনের উপর নিজেদের চাপ পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখে বাণিজ্যিক দিকটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। টোকিওতে মোদী চিনের নাম না করেই তাই বলেছেন, “কোনও কোনও দেশের অষ্টাদশ শতকের মানসিকতা রয়েছে। অন্যের জমি দখল আর সমুদ্রের অধিকার নিতে তারা আগ্রাসী মনোভাব দেখায়।”

দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাপানে তাঁর প্রথম সফরে চিনকে কড়া বার্তা দিয়ে টোকিওর মন জয় করতে সক্ষম হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। কেননা, এশিয়ার রাজনীতিতে জাপানের সঙ্গে চিনের সমুদ্র নিয়ে সংঘাত একটি সুবিদিত ঘটনা। টোকিওতে মোদীর মন্তব্য, “সবাই বলে একবিংশ শতাব্দী হবে এশিয়ার। তবে ভারত এবং জাপানের সম্পর্ক কতটা দৃঢ় হবে তার উপরেই নির্ভর করছে সব সাফল্য।” দেশের উন্নয়নে জাপানি বিনিয়োগকে সব চেয়ে বেশি গুরত্ব দিতে চাইছেন মোদী। মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে টোকিওর মধুর সম্পর্ক রয়েছে। চিনকে নিশানা করে জাপানের কাছাকাছি পৌঁছতে চেয়েছেন তিনি।

তৃতীয়ত, আপাত ভাবে চিন সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নেওয়াটা নিঃসন্দেহে ওবামা প্রশাসনকে স্বস্তিতে রাখবে। এই মাসের শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে যাচ্ছেন মোদী। তার পর ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠক হবে তাঁর। এটা ঘটনা যে এই মুহূর্তে আমেরিকার সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক যথেষ্ট নড়বড়ে হয়ে রয়েছে। পরমাণু চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও ভারতের অভ্যন্তরীণ আইনের জন্য মার্কিন সংস্থাগুলি এখনও ভারতের পরমাণু বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি। ভারত-মার্কিন প্রতিরক্ষা সম্পর্কও ওয়াশিংটনের প্রত্যাশার কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি। বিমার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা মোদী সরকার বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাজ্যসভায় যথেষ্ট সংখ্যা না-থাকায় এখনও তা কার্যকর হয়নি। কবে হবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। এমতাবস্থায় চিনকে কড়া বার্তা দেওয়াতে আমেরিকা কিছুটা খুশি হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

চিন এবং আমেরিকা বরাবর দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে ভারসাম্য রেখেই চলে নয়াদিল্লি। কোনও কারণে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হলে বেজিং-এর দিকে একটু ঝোঁকার প্রবণতা রয়েছে সাউথ ব্লকের। আবার এর উল্টোটাও সত্য। আজকের খোলা বাজারে চিনের উপরে আমেরিকার অর্থনীতি যথেষ্ট পরিমাণ নির্ভরশীল হলেও মার্কিন রক্তে এখনও চিন-বিরোধিতা রয়েছে। ফলে আমেরিকা যাওয়ার আগে চিনের ‘আগ্রাসী’ নীতি নিয়ে মোদীর মুখর হওয়াটা হোয়াইট হাউসের পক্ষে শুভ বার্তাস্বরূপ বলেই মনে করা হচ্ছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE