কাঞ্চিপুরমের সভায় জয়ললিতা ও দলের প্রার্থীরা। —নিজস্ব চিত্র।
কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। তালে তালে বাজছে গোটা তিরিশেক ড্রাম। সেই সঙ্গে সমবেত চিৎকার। ‘‘আম্মা, ভারুগা! ভারুগা! আম্মা, আম্মা, আম্মা!’’
ভারুগা— ‘স্বাগত’। দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকা ভিড় স্বাগত জানাচ্ছে ‘আম্মা’ জয়ললিতাকে। সদ্য যিনি নেমেছেন আকাশ ফুঁড়ে।
গত কয়েক মাস ধরেই নাকি খুব অসুস্থ তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু অসুখটা যে ঠিক কী, স্পষ্ট নয় কারও কাছেই। তাঁর দল এডিএমকে-র পক্ষ থেকে শুধু এটুকুই জানানো হয়েছে, শারীরিক কারণে চেন্নাইয়ের বাইরে আম্মা ভোট-সফর করবেন চপারে। বাছাই করা কিছু জেলায় তাই তৈরি হয়েছে অস্থায়ী হেলিপ্যাড। তাঁর এক-একটি জনসভায় হাজির থাকছেন লাগোয়া এলাকার পনেরো-কুড়ি জন দলীয় প্রার্থী। আম্মার ধকল কমাতে মিলিত প্রচারসভা আর কী!
সিল্কের শাড়ি আর মন্দির স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত কাঞ্চিপুরম থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে ভারানভাসি গ্রাম। আম্মার সাম্প্রতিকতম নির্বাচনী জনসভার অকুস্থল। মেজাজটা যে মহোৎসবের, তা বলাই বাহুল্য। এলাকার সবচেয়ে বড় ফুটবল মাঠটায় ধুলো উড়িয়ে সবেমাত্র নেমেছে আম্মার চপার। এডিএমকে-র স্রষ্টা এমজি রামচন্দ্রন ও আম্মার পোস্টারে শোভিত বক্তৃতা মঞ্চের দূরত্ব হেলিপ্যাড থেকে সামান্যই। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত পথটুকুও পুলিশে-পুলিশে ছয়লাপ।
মঞ্চের দু’টো ভাগ। একটা অংশ ডায়াসের মতো। স্টেজের বাকি অংশের থেকে সেটা ফুট পাঁচেক উঁচুতে। আম্মা এসে উঠলেন সেই উঁচু ডায়াসে। কাঞ্চিপুরম, তিরুভান্নামালাই, তিরুভাল্লার— পাশাপাশি তিন জেলার আঠারো জন প্রার্থী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে নীচের মঞ্চটায়। আম্মা উঁচু ডায়াসে না ওঠা পর্যন্ত তাঁর আসনের দিকে চেয়ে ও ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁরা। আম্মা আসন গ্রহণ করার পর প্রায় নেত্রীর পায়ের কাছে নিচু মঞ্চে বসলেন তাঁরা। এটাই দলীয় রেওয়াজ। আম্মা যে জেলাতেই বক্তৃতা দিতে যাবেন, সেখানকার প্রার্থীরা তাঁর ডায়াসের নীচের ধাপে বসবেন!
খুব দীর্ঘ বক্তৃতার মধ্যে গেলেন না মুখ্যমন্ত্রী। এ বারের ভোট প্রচারে যে কথাগুলো বারবার বলে আসছেন, সেগুলোই আওড়ালেন— “মানুষকে কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে অসংখ্য বার ভাবনা-চিন্তা করি। কিন্তু এক বার যদি কথা দিই, তা হলে সেই কথা রাখার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করি।” এর পরেই এক এক করে ‘আম্মা ওয়াটার’, ‘আম্মা ক্যান্টিন’, ‘আম্মা রোড’-এর মতো সরকারি প্রকল্পগুলোর খতিয়ান দিলেন মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনির সঙ্গতে। সঙ্গে চলল প্রতিপক্ষ শিবিরের প্রবীণ সেনাপতি এম করুণানিধিকে আক্রমণ। ডিএমকে-র সর্বাধিনায়ক ‘ব্যক্তিগত স্বার্থের’ বশবর্তী হয়ে রাজ্যকে সঙ্কটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ তুললেন। অগুনতি কালো মাথার উদ্দেশে প্রশ্ন তুললেন, “ডিএমকে তাদের ইস্তাহারে বলেছে, ক্ষমতায় এলে আমাদের সরকারের আমলে শুরু হওয়া সমস্ত প্রকল্প বন্ধ করে দেবে। আপনারা কি ওদের সেই সুযোগ দেবেন?” বজ্র নির্ঘোষে জবাব এল, “ইল্লে! ইল্লে!” না, না!
আম্মার বক্তৃতা শুরু হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলেছিলেন পেরিয়ার নগর থেকে আসা তানিম আনসারি। পেশায় সিল্ক তাঁতি, অন্ধ আম্মা-ভক্ত তানিম ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, “আমি তো এসেছি স্রেফ ওঁকে দেখতে। উনি আমাদের মাদার! যা করেছেন তা ভোলার নয়। বন্যার সময়ে আমাদের সব যন্ত্রপাতি প্রায় কুড়ি দিন ডুবে ছিল। উনি টাকা না দিলে কি ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম?” ধুলো উড়িয়ে চপার যখন ফিরতি উড়ান দিচ্ছে, তখনও তার দিকে চেয়ে তানিমেরই মতো আরও হাজার স্বপ্নালু চোখ।
তবে এমন আকুল আবেগের উল্টো পিঠেও একটা ছবি রয়েছে। সেটা হতাশার। গত ডিসেম্বরের ওই ভয়াল বন্যাই যার কেন্দ্রবিন্দু। এ বারের ভোটে আম্মার এক নম্বর প্রতিপক্ষ যদি হন ‘কলাইনার’ করুণানিধি, তা হলে আর এক শত্রু বন্যা।
বন্যাত্রাণ ও উদ্ধারকার্যে সরকারের তৎপরতার অভাব নিয়ে যথেষ্ট ক্ষোভ এখনও জমাট বেঁধে রয়েছে চেন্নাই থেকে শুরু করে শ্রীপেরুমবুদুর, এমনকী এই কাঞ্চিপুরমেও। বেঙ্গালুরু হাইওয়ের দু’পাশের জেলাগুলোয় পা রাখলেও সেই ক্ষোভের আঁচ মিলবে ইতস্তত। স্বাভাবিক ভাবেই বন্যাকে অস্ত্র করে শুধু ডিএমকে বা অন্য তামিল দলগুলো নয়, দক্ষিণের ভোট ময়দানে যুদ্ধে নেমেছেন নরেন্দ্র মোদী, সনিয়া গাঁধী, রাহুল গাঁধীরাও। জলমগ্ন চেন্নাই এবং তামিলনাড়ুর উত্তর ভাগের আতঙ্ক-স্মৃতিকে উস্কে দিতে ছাড়েননি তাঁরা কেউই।
এটা ঘটনা যে, বন্যা আক্রান্ত প্রায় ১১ লক্ষ মানুষকে পরিবার-পিছু ৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এডিএমকে সরকার। ফের ক্ষমতায় এলে আরও পাঁচ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও মুখ্যমন্ত্রী দিচ্ছেন জনসভাগুলিতে। কিন্তু এহ বাহ্য। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রামু মনি ভান্নান বলছিলেন, “প্রথমত, পেশাদারদের যা ক্ষতি হয়েছে, ওইটুকু টাকায় তা পূরণ হয় না। দ্বিতীয়ত, পরিকাঠামো, ত্রাণ এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে বড় কথা, অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নটা টাকারও নয়। এই প্রথম তামিলনাড়ুর উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে ছিল দিনের পর দিন। সে সময়ে সরকারের ভূমিকা প্রশ্ন তুলছে তারা।”
বন্যায় নাকানি-চোবানি খেয়েছিল মূলত ছ’টা জেলা। ছয় জেলায় রয়েছে ৬৪টি বিধানসভা আসন। এ বারের লড়াই যখন কাঁটায়-কাঁটায়, তখন এই আসনগুলোর কথা আম্মাকে মাথায় রাখতে হচ্ছে বইকী! ২৩৫ আসনের তামিলনাড়ু বিধানসভার অনেক হিসেবই যে এই ৬৪ আসন উল্টে দিতে পারে, তা বুঝতে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নেই। অসুস্থ শরীরেও তাই গ্রাম থেকে গ্রামে চলেছেন আম্মা জয়ললিতা। চপারের ধুলো উড়িয়ে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy