জামিয়া ক্যাম্পাসে রক্তের চিহ্ন। —ফাইল চিত্র।
প্রথমে আবছা। কিন্তু নতুন লাইব্রেরির দোতলায় আর দশ-পনেরো পা এগোলেই রক্তের শুকিয়ে যাওয়া বড় বড় ফোঁটা! অভিযোগ, ভয়ে পালাতে থাকা পড়ুয়াদের পিছু ধাওয়া করে পুলিশের বেধড়ক লাঠি পেটানোর এটিই অব্যর্থ নিশান।
একতলার অবস্থা আরও শোচনীয়। গ্রন্থাগারের রিডিং-রুমের প্রায় কোনও কাচ আস্ত নেই। মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে চেয়ার-টেবিল। সিসি ক্যামেরা ভাঙা। পেটমোটা বইয়ের পাশেই মেঝেতে ইটের টুকরো আর কাঁদানে গ্যাসের শেল। প্রায় একই ছবি পুরো ক্যাম্পাসে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। এমনকি নরেন্দ্র মোদী আর অযোধ্যা সম্পর্কিত বই রাখা শো-কেসের কাচকেও রেয়াত করেনি অমিত শাহের পুলিশ। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার চত্বরে ‘পুলিশি তাণ্ডবের’ ১২ ঘণ্টা পরে ক্যাম্পাসে পা রেখেও মনে হল, যেন যুদ্ধক্ষেত্র!
আজ সকাল থেকে এই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় হাজার-হাজার মানুষের ঢল। কারও মুখে আজাদির স্লোগান, কেউ ছুটছেন গাঁধীজির ছবি মাথার উপরে তুলে। কারও হাতে জাতীয় পতাকা, কেউ জনতার রোষে পুড়ে খাক হওয়া পুলিশ চৌকির সামনে ‘দিল্লি পুলিশ হায় হায়’ আওয়াজ তুলতে ব্যস্ত। হেলমেট-ঢাল-লাঠিতে সেজে কয়েকশো ফুট দূরেই বিপুল সংখ্যক পুলিশ। কাছের যে হাসপাতালে গত কাল আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, ভিড় থিকথিক করছে তার সামনেও। এত বাস পোড়ার পরে আর কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে আশেপাশের প্রায় সমস্ত মেট্রো স্টেশনের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। তালাবন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকেও। ভিতরে গুটিকয় পড়ুয়া।
আরও পড়ুন: ফাঁকা করা হচ্ছে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, ধৃত ২১
বাইরের ভিড় দেখে জামিয়ার জনসংযোগ আধিকারিক আহমেদ আজিম বলছিলেন, ‘‘যাঁদের দেখছেন, এঁদের মধ্যে পড়ুয়া প্রায় কেউ নেই। কিন্তু এই তল্লাটে যে-কোনও গোলমালের দায় বর্তায় জামিয়ার উপরে।’’ রবিবার সন্ধ্যাতেও নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মিছিলে শামিল প্রতিবাদী পড়ুয়াদের পাশাপাশি লাইব্রেরিতে বসে থাকা বহু ছাত্রছাত্রী পুলিশের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছেন বলে তাঁর অভিযোগ।
পুলিশের পাল্টা দাবি, পড়ুয়াদের দিক থেকেও ইন্ধন ছিল যথেষ্ট। উর্দিধারীদের লক্ষ্য করে নাগাড়ে পাথর ছুড়ছিল অনেকে। উড়ে আসছিল ইটের টুকরো। তাই বাধ্য হয়েই মাঠে নামতে হয়েছে তাদের।
কিন্তু মহম্মদ আতিফ, শোয়েব আনসার, মহম্মদ মুকার্রমের মতো পড়ুয়াদের বক্তব্য, ধাওয়া করে তেড়ে এসে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়ার পরে প্রথমেই সিসিটিভি-র ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছিল পুলিশ। বন্ধ করে দিয়েছিল দু’দিকের দরজা। তার পরেই শুরু বেধড়ক মার। কাঁদানে গ্যাসের শেল এসে পড়ার পরে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। মরিয়া হয়ে দোতলা বা তিন তলার দিকে পালানোর চেষ্টা করতেই তাড়া করে মেরেছে পুলিশ। রক্তের দাগ সেই কারণেই।
ভাঙচুরের চিহ্ন প্রায় প্রত্যেক বাথরুমে। যেখানে ঢুকে কোনও রকমে বাঁচতে চেষ্টা করছিলেন অনেক পড়ুয়া। মহম্মদ নানহে, মহম্মদ শাদাবদেরও দাবি, বাঁচতে যাঁরা টেবিলের নীচে লুকিয়েছিলেন, প্রথমে তাঁদের না-মারার আশ্বাস দিয়ে বার করে নিয়ে এসেছে পুলিশ। কিন্তু তার পরে পিটিয়েছে ঘিরে ধরে।
লাইব্রেরির কর্মী আদনান বলছিলেন, ‘‘চোখের সামনে ছাত্রীদের লাঠিপেটা হতে দেখেছি। যাঁরা মারছিলেন, তাঁদের মধ্যে কোনও মহিলা পুলিশ কিন্তু ছিলেন না।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমা আখতার এ দিন সাংবাদিক বৈঠকে বলেছেন, যে ভাবে পুলিশ ক্যাম্পাসে চড়াও হয়েছে, তা বরদাস্ত করবেন না তাঁরা। পড়ুয়াদের উপরে লাঠি চালানো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি নষ্টের জন্য এফআইআর দায়ের করা হবে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রীর কাছে জমা দেবেন রিপোর্ট। দাবি করবেন উচ্চ পর্যায়ের তদন্তও।
ক্যাম্পাসের কোথাও পড়ে কোনও ছাত্রীর কানের দুল, কোথাও কাচের কুচিতে মাখামাখি এক পাটি জুতো। কোথাও আইএএস পরীক্ষার প্রস্তুতির ফর্ম মাটিতে লুটোপুটি, তো কোথাও উপড়ে এসেছে দরজার ছিটকিনি।
উপাচার্য বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি না হয় মেরামত হবে। কিন্তু পড়ুয়াদের এই আতঙ্কের স্মৃতি আর তিক্ত অভিজ্ঞতা?
সত্যিই। ভাঙা কাচ তো বদলানো যাবে, কিন্তু ভাঙা মন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy