প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। — ফাইল চিত্র।
জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে রইল শুক্রবার। এক দিকে মুম্বইয়ে ‘ইন্ডিয়া’র তৃতীয় বৈঠকে বিজেপি-বিরোধী জোট দাবি করল, ‘সমন্বয় সূত্র’ চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, একই দিনে ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি সামনে নিয়ে এল বিজেপি। বৃহস্পতিবারই কেন্দ্রের তরফে ঘোষণা করা হয়, আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ দিনের বিশেষ অধিবেশন বসবে সংসদে। তখনই মনে করা হয়েছিল, বিশেষ কোনও পরিকল্পনা নিয়েই কেন্দ্রের এই উদ্যোগ। এর পরে শুক্রবার সকাল থেকে দিল্লিতে শুরু হয়ে যায় নতুন তৎপরতা। ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকরের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে মোদী সরকার। সেই কমিটির শীর্ষে বসানো হয় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে। তার কিছু ক্ষণের মধ্যেই কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা।
‘এক দেশ, এক ভোট’ বিজেপির পুরনো লক্ষ্য। এ বার কি সেটাই কার্যকর করতে চায় মোদী সরকার? ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে কি গোটা দেশে সমস্ত রাজ্যের বিধানসভা ভোট হবে? না কি লোকসভা ভোটও মাস কয়েক এগিয়ে আনা হবে? তাতে মাত্র দু’বছর হওয়া পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের ভবিষ্যৎ কী? তবে কি সরকার ফেলে দিয়ে আবার ভোটের মুখোমুখি হতে হবে? এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ। আবার এমন প্রশ্নও উঠেছে যে, বিরোধী জোটের মোকাবিলাতেই কি এই নীতি প্রণয়ন চাইছে মোদী সরকার? দেশে ১৯৫১ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত দু’টি ভোট একসঙ্গেই হয়েছে। কিন্তু জওহরলাল নেহরু ১৯৫৯ সালে কেরলের সরকার ফেলে দিলে একসঙ্গে ভোটের নীতি আর বজায় থাকেনি। এর পরে অন্যান্য রাজ্যেও এমন সব হতে থাকায় ভোট হয়েছে আলাদা আলাদা সময়ে। এখন তাই নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে সংবিধানের বিভিন্ন ধারা পাল্টে অকাল নির্বাচনের রাস্তাও বন্ধ করতে হবে।
বিশেষ অধিবেশন ঘোষণা
১১ অগস্ট শেষ হয়েছে সংসদের বাদল অধিবেশন। এর পরে ডিসেম্বরের গোড়ায় শীতকালীন অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা। তার মাঝেই আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ দিনের জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকেছে কেন্দ্র। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী বৃহস্পতিবারই সেই ঘোষণা করেছেন। তিনি এক্স (সাবেক টুইটার)-এর মাধ্যমে জানিয়েছেন, আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে বসবে সংসদের বিশেষ অধিবেশন। পাঁচ দিনের অধিবেশন শেষ হবে ২২ সেপ্টেম্বর। কী কারণে এই অধিবেশন, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তিনি শুধু জানিয়েছেন, ‘অমৃত কালের দিকে তাকিয়ে কার্যকরী আলোচনা’র জন্য এই অধিবেশন। বৃহস্পতিবার থেকেই শুরু হয়ে যায় কেন এই বিশেষ অধিবেশন তা নিয়ে জল্পনা।
কোবিন্দের নেতৃত্বে কমিটি
গত বাদল অধিবেশনে রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী অর্জুনরাম মেঘওয়াল জানিয়েছিলেন, ‘এক দেশ এক ভোট’ চালু করার জন্য আইন কমিশনের দ্বারস্থ হচ্ছে কেন্দ্র। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এর ফলে যে বিপুল অর্থের সাশ্রয় হবে, তা রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের প্রচারে ব্যয় হতে পারে। এই নীতি কার্যকর হলে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের গতিও বাড়বে।’’ আর লোকসভা নির্বাচনের মাস সাতেক আগে আবার ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকরের পক্ষে শুক্রবার তৎপরতা শুরু করে মোদী সরকার। ওই নীতি কার্যকরের দিকগুলি খতিয়ে দেখার জন্য আইন কমিশনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে বলে সরকারি একটি সূত্রের খবর। সেই আলোচনার ভিত্তিতে ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকরের দিশা খুঁজতে একটি কমিটি গঠন করেছে মোদী সরকার। সেই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এর কিছু ক্ষণ পরেই কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করতে যান বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডা।
‘এক দেশ এক ভোট’ কী?
দেশে ভোট হবে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর। লোকসভার সঙ্গেই করে নেওয়া হবে সব রাজ্যের বিধানসভা ভোট। দেশে এমন নীতি তৈরির কথা বিজেপি ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহারেই বলেছিল। এই বিষয়ে প্রধান যুক্তি দেওয়া হয়, খরচ কমানো। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে সরকারের খরচ হয়েছিল ১০ হাজার কোটি টাকার মতো। রাজনৈতিক দলগুলির খরচ ধরলে সব মিলিয়ে পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার কোটি টাকার মতো। এ ছাড়া প্রতিটি রাজ্যে বিধানসভা ভোটের জন্য বিপুল পরিমাণে খরচ হয়। লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে গোটা দেশের বিধানসভা ভোট করতে পারলে সেই খরচ অনেকটাই কমে যাবে। এক খরচে সব রাজ্যের ভোট হয়ে যাবে। ‘এক দেশ এক ভোট’ নীতির পক্ষে আরও একটা যুক্তি হল, আলাদা আলাদা নির্বাচন মানে প্রতি ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যায় জনবল অর্থাৎ সরকারি কর্মী ও অফিসারদের নিয়োগ করতে হয়। ফলে সরকারি কাজ ব্যাহত হয়। এ ছাড়া দফায় দফায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় নির্বাচনী আদর্শ আচরণবিধি প্রয়োগের ফলেও সরকারি কাজ ব্যাহত হয়। একসঙ্গে ভোট হলে পাঁচ বছরে এক বার মাস দেড়েকের জন্য আদর্শ আচরণ বিধি চালু থাকবে। তাতে উন্নয়ন থমকে থাকবে না বলেই বিজেপির দাবি।
নীতি চালু হবে কী ভাবে
সংবিধান অনুযায়ী একসঙ্গে ভোট করা সম্ভব নয়। এ জন্য জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধন ছাড়াও সংবিধানের অন্তত পাঁচটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তন প্রয়োজন। যে যে ধারা বা অনুচ্ছেদের পরিবর্তন প্রয়োজন তার মধ্যে সবার প্রথমে রয়েছে ৮৩ (২)। এখানে বলা রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের সময়সীমা পাঁচ বছরের বেশি হতে পারে না। তবে প্রয়োজনে কমানো যায়। এ ছাড়াও অনুচ্ছেদ ৮৫ (২) (বি), ১৭২ (১), ১৭৪ (২) (বি) বদলাতে হবে। এগুলির সবই রাজ্যের সরকার নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ধারা। পরিবর্তন চাই রাজ্যে সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির ৩৫৬ ধারাতেও। এই পরিবর্তনের জন্য লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সংবিধান সংশোধনী বিলে সমর্থন দরকার। সেই সঙ্গে চাই সব রাজ্য সরকার এবং রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য। তার পরেও দেশের কমপক্ষে অর্ধেক রাজ্যের বিধানসভায় তা পাশ করিয়ে নিতে হবে। দেশের ৩০টি বিধানসভার মধ্যে ১৫টির সমর্থন চাই। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন দেশের ১০ রাজ্যে। এ ছাড়া বিজেপির জোট সঙ্গী ৫টি রাজ্যে ক্ষমতায়। ফলে বিজেপির পক্ষে এই পরিবর্তন খুব সহজ যেমন নয়, তেমন অম্ভবও নয়।
বিরোধীদের মোকাবিলাই কি বিজেপির লক্ষ্য
‘এক দেশ এক ভোট’ নীতি কার্যকর হলে তা বিরোধী জোটের মোকাবিলায় তা খুবই কার্যকর হবে বলে মনে করছে বিজেপি নেতারা। বাংলার উদাহরণ টেনেই তাঁরা বলছেন, রাজ্যে বিধানসভার প্রচারে বাম-কংগ্রেসের বিরোধিতা এবং লোকসভার ক্ষেত্রে একই দলের সঙ্গে জোটের কথা তৃণমূল বলবে কী করে? একই সমস্যায় পড়বে কংগ্রেস এবং বামেরাও। শুধু এই রাজ্যেই নয়, ‘ইন্ডিয়া’র শরিকরা সব রাজ্যেই এই সমস্যার মুখোমুখি হবে প্রচারে। অন্য দিকে, একটা কথা বলে বিজেপি ভোট চাইতে পারবে। কারণ, দলের সাম্প্রতিক পরম্পরা অনুযায়ী লোকসভা ভোট তো বটেই, যে কোনও রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদীই দলের একমাত্র মুখ। আবার একান্ত এই নীতি বিরোধীদের চাপে কার্যকর করতে না পারলেও বিজেপির হাতে যুক্তি থাকবে সরকারের খরচ কমানোর উদ্যোগ নিয়েও তা করা গেল না বিরোধীদের জন্যই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy