নির্বাচনী প্রচারে জেডিইউ প্রধান নীতীশ কুমার (ডান দিকে)। মঙ্গলবার বিহারের নালন্দায়। ছবি: পিটিআই
শিক্ষিত যুবকেরা বলছেন, ১৫ বছরে চাকরি কোথায়?
লকডাউনের গোড়ার দিকে রাজ্যে ফেরা পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢুকতে দেননি নীতীশ কুমার। হিসেব চোকাতে ভোটের দিন গুনছেন তাঁরা।
২০১৫ সালে আরজেডির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়ার পরে বিজেপির হাত ধরা নীতীশকে শিক্ষা দিতে মরিয়া যাদব সমাজ।
এই ত্র্যহস্পর্শ গোড়া থেকেই মজুত ছিল। ভোট ঘোষণার পরে তার সঙ্গে যোগ হয়েছে, ফের যাদব-মুসলিম একজোট হওয়া, চিরাগ পাসোয়ানের ক্রমাগত আক্রমণ এবং সর্বোপরি নীতীশের দলের সঙ্গে বিজেপির নিঃশব্দে দূরত্ব বাড়ানো। চুম্বকে কোণঠাসা নীতীশ।
আরও পড়ুন: লালুকে সন্তান-খোঁচা নীতীশের, পাল্টা মোদী-কটাক্ষ তেজস্বীর
অথচ নীতীশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লালুপ্রসাদ জেলবন্দি। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী রামবিলাস পাসোয়ান সদ্য প্রয়াত। ফলে সেই নিরিখে কার্যত খোলা মাঠ হলেও সম্ভবত জীবনের সব চেয়ে কঠিন লড়াইয়ে নামতে চলেছেন নীতীশ কুমার। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হাওয়ায় রীতিমতো টলমল করছে তাঁর ভাবমূর্তি। যত দিন গড়াচ্ছে নীতীশের চতুর্থ বার ক্ষমতা দখল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিজেপি শিবিরেই।
নীতীশ সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বছর চল্লিশের দীনেন্দ্র শর্মা। মুজফ্ফরপুরের সম্পন্ন কাপড় ব্যবসায়ী বললেন, “প্রথমে দশ বছর বিজেপি, তার পর আরজেডি-কংগ্রেস, তার পরে আবার বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজের কুর্সি কোনও মতে বাঁচিয়ে রেখেছেন নীতীশ। অনেক হয়েছে। এ বার ওঁর একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।’’ মোকামার ঘোড়াসান গ্রামের বাসিন্দা মহেন্দ্র কুমার ক্ষুব্ধ অন্য কারণে। তাঁর কথায়, “লকডাউনে পঞ্জাব থেকে ছেলে কোনও মতে এসে তিন দিন রাজ্যের সীমানায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ নীতীশ প্রশাসন তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। কী অসহায় অবস্থা বলুন তো!”
আরও পড়ুন: ঋণ দিয়ে খুশি মোদী, কটাক্ষ প্রিয়ঙ্কার
বাড়ি ফিরে আসা পরিযায়ীদের এক হাজার টাকা অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ পরিযায়ী শ্রমিক তা চোখে দেখেননি বলে দাবি করলেন মানের এলাকার বাসিন্দা লোকেশ রাম। লকডাউনের সময়ে মুম্বই থেকে ফেরা লোকেশের অভিযোগ, “যারা পঞ্চায়েত প্রধানের ঘনিষ্ঠ, তারা এক-আধ জন শুনেছি টাকা পেয়েছে।’’
চলতি বছরের বন্যা নীতীশকে আরও কাদায় ঠেলে দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সরকার পরিবার-পিছু ছয় হাজার টাকা দেবে বলেছিল। সেই টাকা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলেই ফুঁসে উঠলেন বৈশালী জেলার মালেপুর গ্রামের দীপক কুশওয়াহা। সামনের জলে ভরা খেত দেখিয়ে বললেন, “সব ফসল এখনও জলের তলায়। অথচ বেশির ভাগ লোকেরই অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকেনি।’’ খাতায়-কলমে কিন্তু কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে আর্থিক অনুদানের নামে। সেই টাকা কোথায় গেল, তদন্তের দাবি তুলেছেন এলজেপি নেতা চিরাগ পাসোয়ান।
বিহারে মহারণ
আজ প্রথম দফা
• মূল লড়াই: জেডিইউ-বিজেপি বনাম আরজেডি-কংগ্রেস-বাম জোট। একা লড়ছে এলজেপি।
• ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ৩২৮ জন প্রার্থী। গুরুতর অপরাধের মামলা ২৪৪ জনের বিরুদ্ধে।
• ২৯ জন মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধে অভিযুক্ত। ধর্ষণের অভিযোগ ৩ জনের বিরুদ্ধে।
• ২১ জনের বিরুদ্ধে খুনের, ৬২ জনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ।
• ৩৭৫ জন কোটিপতি প্রার্থী।
• সবচেয়ে ধনী মোকামার আরজেডি প্রার্থী অনন্তকুমার সিংহ। সম্পত্তির মূল্য ৬৮ কোটি ৫৬ লক্ষ ৭৮ হাজার ৭৯৫ টাকা।
• উল্লেখযোগ্য প্রার্থী: জামুইয়ে বিজেপির শ্রেয়সী সিংহ। প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দিগ্বিজয় সিংহের মেয়ে শ্রেয়সী স্বর্ণপদক জয়ী শুটার।
• মহিলা প্রার্থী ১৪ জন।
• প্রচারে মূল বিষয়: পরিযায়ী সমস্যা, বেকারত্ব, দুর্নীতি।
গত পাঁচ বছরে নীতীশের সাত দফা প্রতিশ্রুতির অন্যতম ছিল ঘরে ঘরে জল পৌঁছে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রেও খাতায়-কলমে রাজ্যের অধিকাংশ বাড়িতে জল পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু বাস্তব বলছে, লাইন পাতা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই লাইন গিয়েছে সড়ক বরাবর। গ্রামের ভিতরে পৌঁছয়নি। পটনার বীরচাঁদ পটেল পথে জেডিইউ সদর দফতরে দলীয় নেতা তথা সাংসদ রাজীব রঞ্জন সিংহের দাবি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই সাধারণ মানুষের কাছে অর্থ পৌঁছয়নি। কিন্তু মানুষ সেই যুক্তি শুনতে নারাজ!
বিহার নয়, নীতীশের ১৫ বছরের শাসনে ভোল পাল্টেছে মূলত পটনা। গোটা রাজধানী জুড়ে শপিং মল, হোটেল গজিয়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। মাথা তুলেছে একাধিক ফ্লাইওভার। শুধরেছে আইনশৃঙ্খলা। পটনার কয়েক প্রজন্মের বাসিন্দা মানিক দত্ত স্বীকার করে নিলেন, চুরি-ছিনতাই, রাহাজানি আরজেডি জমানার চেয়ে অনেকটাই কমেছে।
কিন্তু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, কিংবা যুব সমাজের জন্য চাকরি? এ প্রশ্নে নীতীশ সমর্থকদের মুখে কুলুপ। কিন্তু যুব সমাজ শুনবে কেন! পটনার বোরিং রোডের বাসিন্দা শাশ্বত সিংহ বেঙ্গালুরুতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। লকডাউনে বাড়ি আসা শাশ্বতের সাফ কথা, ‘‘পটনায় কোনও চাকরি নেই। তাই রাজ্য ছাড়তে হচ্ছে।’’ গত পাঁচ বছরে সরকারি কোনও নিয়োগ হয়নি। তেজস্বী যাদবের দাবি, অন্তত চার থেকে পাঁচ লক্ষ সরকারি পদ খালি রয়েছে। বিরোধীদের আক্রমণের মুখে ভোটের আগে শিক্ষক ও পুলিশে নিয়োগের ঘোষণা করেন নীতীশ। কিন্তু আদর্শ আচরণবিধি চালু হওয়ায় তা আটকে গিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাওয়ায় হৃত জমি উদ্ধারে ঝাঁপিয়েছে আরজেডি। স্থানীয় রাজনীতিকদের মতে, এক মাস আগেও মনে হচ্ছিল একতরফা জিতবেন নীতীশ। কিন্তু আচমকাই প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে এসেছে আরজেডি, কংগ্রেস এবং সিপিআই (এমএল) জোট। এর মধ্যে আরজেডির পিছনে শক্ত খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ১৭ শতাংশ মুসলিম ও ১৩ শতাংশ যাদব ভোট। নীতীশকে ধাক্কা দিতে রাজপুত ভোটও কোমর কষে পিছনে দাঁড়িয়েছে আরজেডির। মদের ব্যবসা ও অবৈধ বালির খনন বন্ধ করেছে নীতীশ সরকার। এই ব্যবসাগুলি মূলত যাদব ও রাজপুতেরাই নিয়ন্ত্রণ করত। সেই থেকেই দুই শিবির নীতীশকে হটাতে মরিয়া। আরজেডি নেতা আব্দুল বারি সিদ্দিকির দাবি, “৩৫ শতাংশ ভোট আমাদের পিছনে রয়েছে। এ ছাড়া, যুব সম্প্রদায় নীতীশের উপর বেজায় খাপ্পা। তাদের সমর্থন পেলে নীতীশ মুছে যেতে বাধ্য।’’
পরিস্থিতি যে কঠিন তা বিলক্ষণ বুঝছেন নীতীশও। এ যাত্রায় তাই চার ‘ম’-এর উপর ভরসা রেখেছেন তিনি। প্রথম ‘ম’ হল-মহাদলিত। যারা মোট ভোটারের প্রায় ১৭ শতাংশ। যাদের মন জিততে দলিত নেতা জিতনরাম মাঁঝিকে শেষ বেলায় এনডিএ-তে নিয়েছেন নীতীশ। দ্বিতীয় ‘ম’ হল মোস্ট ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস বা অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া শ্রেণি। ১৫ বছর আগে ক্ষমতায় এসে যাদের জন্য সংরক্ষণ চালু করেছিলেন নীতীশ। তৃতীয় ‘ম’ হল মহিলা। পঞ্চায়েতে মোট আসনের অর্ধেক আসন মহিলা সংরক্ষণ ও মদ নিষিদ্ধ করে যাদের প্রবল সমর্থন কুড়িয়েছেন নীতীশ। চতুর্থ ‘ম’ হল মোদী। শেষ বেলায় নরেন্দ্র মোদী এসে প্রচারে ঝড় তুলে বিক্ষুব্ধ ভোটারদের নিজেদের দিকে টেনে আনবেন, এই আশায় বুক বেঁধেছেন জেডিইউ নেতারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy