শহর জুড়ে কার্ফু। মঙ্গলবার সকালে শ্রীনগরের রাস্তায়। ছবি: এএফপি।
লাদাখ শান্ত। জম্মুতে জয়ধ্বনি। কাশ্মীর থমথমে।
না, তিন এলাকার কোনও অংশ থেকেই অশান্তি, হাঙ্গামা, পাথরবাজি, হিংসা বা নিরাপত্তা বাহিনীর ধরপাকড়ের কোনও খবর নেই।
বাড়তি ১০০ কোম্পানি আধাসেনা মোতায়েন, অমরনাথ যাত্রা বাতিল, পর্যটকদের ফিরে যেতে বাধ্য করার মতো ঘটনায় গোটা কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে আশঙ্কার একটা পরিবেশ ছিলই। দীর্ঘ অশান্তির আশঙ্কায় খাবারদাবার, অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, পেট্রল ইত্যাদি কেনা, এটিএম থেকে টাকা তোলার হুড়োহুড়িও শুরু হয়েছিল। এর পর কাশ্মীরের প্রাক্তন দুই মুখ্যমন্ত্রী তথা প্রধান দুই স্থানীয় দলের নেতানেত্রী, পিডিপি-র মেহবুবা মুফতি ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওমর আব্দুল্লাকে গ্রেফতারের খবরে উদ্বেগ তৈরি হয় গোটা দেশেই। তবে কি ফের আগুন জ্বলবে ভূস্বর্গে! গত কাল রাজ্যসভায় জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ বিশেষ মর্যাদা খারিজ ও রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে দু’টি কেন্দ্রশাসিত এলাকা গঠনে বিল পেশ হতেই উদ্বেগ চরমে ওঠে। গোটা কাশ্মীর হয়তো ফেটে পড়বে বিক্ষোভে! সেই আশঙ্কা সত্যি হয়নি শেষ পর্যন্ত। একাই ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ফারুক আব্দুল্লা। বিজেপি বলছে, ‘দোকান’ বন্ধ হওয়ার ক্ষোভ।
হিংসাত্মক কিছু হয়নি, এটা যেমন ঘটনা। আপাত শান্তির আড়ালে যে ভয় বা থমথমে উৎকণ্ঠা জমাট বেধে রয়েছে, সেটাও ধরা পড়েছে নানা ভাবে। আইএএসের পদ ছেড়ে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের জন্য কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে সবে গত মার্চ মাসে রাজনৈতিক দল গড়েছেন ৩৬ বছর বয়সি শাহ ফয়জ়ল। টুইটারে ‘ভয়’ ও ‘হদয়ভঙ্গে’র কথা জানিয়েছেন এই নবীন রাজনীতিক। লিখেছেন, ‘‘কাশ্মীরে অভূতপূর্ব আতঙ্ক। প্রতেকের মন ভেঙে গিয়েছে। প্রতিটি মুখে পরাজয়ের ছাপ। নাগরিক থেকে প্রজা হয়ে যাওয়ার। এক বিপর্যয়কর মোড় নিয়েছে ইতিহাস। মানুষ স্তম্ভিত। প্রকাশ্য দিনের আলোয় তাদের জমি, পরিচয় ও ইতিহাস চুরি হয়ে গিয়েছে।’’
শ্রীনগরের পথে পথে দিনভর ঘুরেছেন সাংবাদিকেরা, টিভি চ্যানেলের লোকজন। কোনও কাশ্মীরিকে প্রতিক্রিয়া জানাতে দেখা যায়নি ৩৭০ নিয়ে। বুম হাতে টিভি সাংবাদিকেরা দেখিয়েছেন, ঠেলা নিয়ে ফল-আনাজ বেচছেন কয়েক জন। কয়েক জন মহিলা-পুরুষ কিনছেন। কিন্তু পিছনের ফাঁকা রাস্তা, সার সার বন্ধ দোকানপাট বলে দিয়েছে আসল ছবিটা। খোলা শুধু ওষুধের দোকান। বন্ধ স্কুল-কলেজ-অফিস। চলছে ১৪৪ ধারা। নামাজ পড়তে, চিকিৎসা বা খাবার কেনার মতো একান্ত প্রয়োজনে পথে বেরিয়েছেন হাতে গোনা মানুষ। পুলিশ ও সিআরপি প্রত্যেকের পরিচয়পত্র দেখে ও কোথায় যাচ্ছেন তা যাচাই করে তবেই এগোতে দিচ্ছে।
ভূস্বর্গ নিয়ে বাকি দেশ ও সাইবার দুনিয়া জুড়ে যখন তুমুল তর্ক, বিস্তর চর্চা, কাশ্মীরে জমি কেনা বা কাশ্মীরি মেয়েকে বিয়ে করার সুযোগ নিয়ে চলছে এন্তার মিম-বিনিময়, কাশ্মীরিরা তখন কোথায়? গত কাল থেকেই তাঁরা পুরোপুরি ঘরবন্দি। কার্যত ‘অদৃশ্য’ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বন্ধ মোবাইল, নেট, ব্রডব্যান্ড, কেবল টিভি। ডিটিএইচ চালু থাকলেও তার বিস্তার সীমিত। বাইরে কী ঘটছে, জানতে পারছেন না। তাঁদের মনে কী ঘটছে, সেটাও জানতে পারছে না দুনিয়া।
শুধু কাশ্মীরের বাইরে রয়েছেন যে সব কাশ্মীরি, তাঁদের উৎকণ্ঠার ছবিটা ধরা পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পেশায় চিকিৎসক উমের ভাট থাকেন দিল্লিতে। পুলিশ আর আধাসেনায় মুড়ে ফেলা তাঁর উপত্যকা, তাঁর স্বজনেরা কেমন আছে, জানতে না-পারার যন্ত্রণার কথা জানিয়েছেন তিনি। লিখেছেন, ‘‘রাতভর জেগে কাটিয়েছি। কান্নায় ভিজে গিয়েছে দু’চোখ। সকালের আবছায়ায় নিজের মৃত্যুকে দেখেছি সামনে। আল্লার কাছে জানতে চেয়েছি, ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণ থেকে আমার কাশ্মীরকে বাঁচাতে কেন একটা দেওয়াল তুলে রাখোনি! জানলায় চোখ রেখে ভেবেছি, আল্লা সব দেখছেন। এই লড়াইটা নিজেদেরই লড়তে হবে। প্রাণ থাকতে এক ইঞ্চি জমি দেব না।’’
আশ্চর্য রকমের উল্টো ছবি জম্মুর পথে। সেখানে স্কুটি থামিয়ে কাশ্মীরি মহিলা জানালেন, এ বারে বাইরের কাউকে বিয়ে করার জন্য জমিজমা- সম্পত্তির অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। জায়গায় জায়গায় গেরুয়া ও জাতীয় পতাকা হাতে জড়ো হয়ে লোকে স্লোগান তুলেছেন, হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ। রাতে ১৪৪ ধারা ছিল জম্মুর কিস্তোয়ার ও রাজৌরির বেশ কিছু এলাকায়। জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখ, তিন অঞ্চলের পুলিশ কর্তারাই জানিয়েছেন, কোথাও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পরিস্থিতি পুরো শান্ত ও নিয়ন্ত্রণে। রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ রাখছেন নিরন্তর। রাজভবন সূত্রে বলা হয়েছে, প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন রাজ্যপাল। গত কাল রাতে সেনাবাহিনীর নর্দার্ন কমান্ডের প্রধান রণবীর সিংহও দেখা করেছেন তাঁর সঙ্গে। রাজ্যপাল সকলকেই সজাগ থাকতে বলেছেন। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানিয়েছেন জনগণ, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলির নেতৃত্বের কাছে।
এই সময়ে বিহার-উত্তরপ্রদেশ ও অন্যান্য রাজ্য থেকে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতে আসেন কাশ্মীরে। সময় থাকতে পর্যটকদের ফেরত পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এই শ্রমিকরা পড়েছেন দুর্ভোগে। রোজগার বন্ধ। ফিরতে মরিয়া হলেও বাস পাচ্ছেন না। বিমানে ফেরার সাধ্য নেই। প্রশাসন কিছু ক্ষেত্রে বাসের বন্দোবস্ত করতে পারলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy