নিহত বশির আহমেদকে ঘিরে পরিজন। ফাইল চিত্র
‘পাপা’-র কথা শুনলেই নাকি তিন বছরের আয়াদ বলছে ‘ঠাক ঠাক’।
‘ঠাক ঠাক’ মানে গুলির আওয়াজ। কাশ্মীরের সোপোরে গত কাল গুলিতে নিহত ‘পাপা’ অর্থাৎ দাদুর রক্তমাখা দেহের বুকের উপরে বসে-থাকা আয়াদের ছবি ছড়িয়ে গিয়েছে গোটা দুনিয়ায়। বাড়ির লোকেদের দাবি, আয়াদ এখনও মাঝে মাঝেই বলছে, কী ভাবে ‘ঠাক ঠাক’ করা হয়েছিল দাদুকে। তাঁদের ভয়, এই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি হয়তো সারা জীবন ভোগাবে তাকে।
কিন্তু কে গুলি করল ৬৫ বছরের বশির আহমেদ খানকে? এই প্রশ্নই বারবার তুলছে পরিবার। জঙ্গি আর সিআরপি-র গুলি-যুদ্ধের মধ্যে পড়েই বশির মারা গিয়েছেন— প্রশাসনের এই ব্যাখ্যা তাঁরা চোখ বুজে মানতে নারাজ।
নিহতের ছেলে গত কাল অভিযোগ করেছিলেন, গাড়ি থেকে নামিয়ে তাঁর বাবাকে গুলি করেছে নিরাপত্তা বাহিনীই। যা খণ্ডন করতে আজ ফের বিবৃতি দিয়েছেন সিআরপি-র এডিজি জুলফিকার হাসান। বলেছেন, ‘‘সম্পূর্ণই অসত্য কথা। কিছু লোক ঘটনাটাকে অন্য চেহারা দিতে চাইছে।’’ কিন্তু বশিরের ছেলেমেয়ের প্রশ্ন, গুলিগোলার মধ্যে পড়ে গেলে কেউ গাড়ি থেকে নামতে যাবেনই বা কেন? বিশেষত সঙ্গে যখন একটা শিশু রয়েছে! এমনকি বাড়ির লোকেদের কারও কারও দাবি, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতেই যে বশির নিহত হন, ছোট্ট আয়াদের মুখেই সেই কথা তাঁরা শুনেছেন।
বশিরের ছেলে, ২৫ বছরের সুহেল আহমেদ খান ইসলামিক স্টাডিজ নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ছেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। বললেন, ‘‘একটা শিশু কেন বাড়িয়ে বলবে? সে যা দেখেছে, তা-ই বলছে। তা-ও আমি আমার ভাগ্নের কথা বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু সোপোরের থানায় গিয়ে দেখলাম, বাবার গাড়িটায় একটা একটা আঁচড় পর্যন্ত নেই। বাবা যদি গুলি-যুদ্ধের মধ্যে পড়েই মারা যায়, তা হলে গাড়ির কাচ ভাঙবে, ভেতরে রক্তের দাগ থাকবে। সে সব কিচ্ছু নেই।’’
বশিরের স্ত্রী বারামুলার মহিলা থানার অবসরপ্রাপ্ত এসএইচও। এখন আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। কাল, বৃহস্পতিবার তাঁর অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল। বশিরের বাড়ির গৃহ-সহায়িকা লকডাউনে আটকে রয়েছেন সোপোরে, নিজের বাড়িতে। তাঁকেই গত কাল আনতে যাচ্ছিলেন বশির। ছেলে জানালেন, সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ থানা থেকে ফোন করে বলা হয়, বশির দুর্ঘটনায় পড়েছেন। ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান গুলিবিদ্ধ দেহ।
জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ বলেছে, খুনের ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলা হচ্ছে সিআরপি-র বিরুদ্ধে। গুজব যারা ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলারও হুমকি দিয়েছে তারা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, আয়াদের ছবি টুইট করে, তার পরিচয় প্রকাশ করে শিশু-সুরক্ষা আইন (২০১৫) লঙ্ঘন করেছে জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ। সোপোরের এসএসপি জাভেদ ইকবাল জানান, ভাইরাল হওয়া আয়াদের ছবি কে তুলেছিল, তা নিয়ে তদন্ত হচ্ছে।
তদন্তই চাইছেন বশিরের মেয়ে ইরম বশির খান। বাবার মৃত্যুর তদন্ত। বলছেন, ‘‘পুলিশের আইজি বলেছেন, আমরা, পরিবারের লোকেরা তো ঘটনাস্থলে ছিলাম না। তাই বাবাকে নিরাপত্তা বাহিনী মেরেছে, এ কথা আমরা বলতে পারি না। ওঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। কিন্তু আইজি কী করে বলছেন, বাবাকে জঙ্গিরাই মেরেছে? উনিও তো ঘটনাস্থলে ছিলেন না। আমরা চাই, গোটা ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত হোক। কোন পক্ষের গুলি আমার বাবাকে কেড়ে নিল, আমি বলতে পারব না। কিন্তু একটা প্রশ্ন করবই। গুলিগোলার মধ্যে গাড়ি নিয়ে এসে পড়লে একটা লোক সেই গাড়ি ছুটিয়ে পালাবে, নাকি গাড়ি থেকে নেমে গুলি খাবে?’’
ইরমেরও দাবি, তাঁর বাবার গাড়ি অক্ষত। গাড়িটা রাস্তার ধারে দাঁড় করানো ছিল। বশিরের দেহ পড়ে ছিল গাড়ির পাশেই। সুতরাং তাঁকে গাড়ি থেকে নামানো হয়েছিল, এমন ইঙ্গিত রয়েছে বলেই তাঁর মত। ইরম বলছেন, ‘‘হয়তো বাবা জঙ্গিদের গুলিতেই মারা গিয়েছেন। কিন্তু প্রমাণ চাই। সুবিচার চাই আমরা।’’
তেতলা বাড়ির সিঁড়িতে ভাইবোনেদের সঙ্গে খেলছে আয়াদ। হাসছে। কে বলবে, তিন বছরের এই বাচ্চার ছবি, ভিডিয়ো, তথাকথিত ‘বয়ান’ ঘিরেই চলছে চর্চা, বিতর্ক, রাজনৈতিক আস্ফালন। অনেকেই বলছেন, মৃত্যু ছুঁয়ে-আসা আয়াদকে নিয়ে এই দড়ি-টানাটানির পর্বটাই সব চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy