পুড়েছে ঘর। কোলের শিশু নিয়ে আশ্রয় শিবিরে। রবিবার। ছবি: পিটিআই।
মণিপুর রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো। আর মণিপুরের পাহাড়ে পপি বা আফিম চাষকে ঘিরে যে সমান্তরাল অর্থনীতি চলছে, তার পরিমাণ কত? রাজ্যের সংখ্যাগুরু মেইতেইদের যৌথ মঞ্চ কোকোমির দাবি, প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। রাজ্যের জিডিপি-র থেকেও বেশি!
মণিপুরের হিংসা নিয়ে ‘মণিপুর ট্রাইবালস ফোরাম, দিল্লি’ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে একটি নথি জমা দিয়েছে। ফোরামের বক্তব্য, গত এক দশকে মণিপুরের মাদক পাচারের কারবার ‘প্রবল ক্ষমতাশালী ড্রাগ মাফিয়া’-দের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া সেই নথিতে দাবি করা হয়েছে, ‘এই সব মাদক মাফিয়ার নাম বা তারা কোন সম্প্রদায়ের, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায়। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, এক বড় মাপের মাদক মাফিয়া মণিপুরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আত্মীয়। আর এক বড় মাপের মাদক মাফিয়া মণিপুরের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর আত্মীয়।’
গত তিন মাস ধরে মণিপুরে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে চলা সংঘর্ষ, হিংসার পিছনে আরও একাধিক কারণের পাশাপাশি সে রাজ্যের মাদক মাফিয়াদের স্পষ্ট মদত রয়েছে বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর কর্তারা। গোয়েন্দা কর্তাদের বক্তব্য, এই মাদকের কারবারে দলমত নির্বিশেষে রাজ্যের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি মণিপুর তথা উত্তর-পূর্বের অধিকাংশ জঙ্গি সংগঠনও যুক্ত। মাদক পাচারই জঙ্গিদের আয়ের মূল উৎস। আর মাদক পাচারের পথ ধরেই চলে জঙ্গিদের জন্য অস্ত্র পাচারও। মণিপুরে কয়েক মাস আগে বেআইনি আফিম চাষের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছিল। তাতে আফিম চাষ তথা ড্রাগের কারবারের সঙ্গে যুক্ত রাজনীতিবিদ থেকে জঙ্গি— জড়িত সব পক্ষের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। তার জেরেই ছড়িয়েছে হিংসা। যা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই বনাম সংখ্যালঘু কুকিদের সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে।
পপি চাষ করে মেলে আফিম। সেই আফিম থেকেই তৈরি হয় উন্নত মানের হেরোইন। গোয়েন্দা কর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক ড্রাগ কারবারের তাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া-লাওসের ‘সোনালি ত্রিভুজ’ থেকে সরে মাদক ব্যবসা ক্রমেই মায়ানমারে দানা বেঁধেছে। সেখানকার সরকার ও সেনা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতির চুক্তি করেছে। কিন্তু তাদের শান্ত রাখতে মাদক চাষের সুযোগ করে দিয়েছে।
মায়ানমারের জঙ্গিদের সঙ্গে এ পারের জঙ্গিদের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। তাই মায়ানমার থেকে ভারতে মাদক পাচারের জন্য আদর্শ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে মণিপুর। দেশের হেরোইন রাজধানী হয়ে উঠেছে মণিপুর। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে কুটির শিল্পের মতো ঘরে-ঘরে মাদক তৈরির কারখানা। পরিস্থিতি এমন, গ্রামের মানুষ ফসলের চাষবাষ বন্ধ করে আফিম চাষ করছেন।
কারণ এক হেক্টর জমিতে ধান চাষ করলে বড়জোর ১ লক্ষ টাকা মেলে। সেখানেই পপি চাষ করলে পাওয়া যাচ্ছে ৬-৭ লক্ষ টাকা। সরকারি বিকল্প রোজগার যোজনার মুনাফা পপি চাষের ধারেকাছে আসে না।
নিরাপত্তা বাহিনীর ড্রোনের ছবিতে দেখা গিয়েছে, মণিপুরের মায়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ের পর পাহাড়ে পপির চাষ চলছে। মণিপুরের মাদক দমন শাখার পুলিশ সুপার কে মেঘচন্দ্র সিংহ বলেন, “২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রাজ্যে ১৫ হাজার একরের বেশি জমিতে পপি চাষ হচ্ছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।”
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার একরই কুকি এলাকায়। গোয়েন্দা সূত্রই জানাচ্ছে, মাদকের কাঁচামাল চাষের ক্ষেত্রে কুকিদের জমি ব্যবহার করা হলেও মাদক তৈরির জন্য গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির অধিকাংশই মেইতেই। ২০১৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত রাজ্যে ৭৮৮৩ কোটি টাকার মাদক বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
মেইতেইদের অভিযোগ, মাদকের চাষ কুকিদের এলাকাতেই। তা বন্ধ করতে গেলে কুকিরা বাধা দিচ্ছেন। অন্য দিকে কুকিরা বলছেন, গোটা কুকি সম্প্রদায়কেই মাদক পাচারের কারবারি হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে মেইতেইরা। গোয়েন্দাদের একটি সূত্রের দাবি, মাদক চাষ হয় কুকি এলাকায়, তা থেকে মাদক তৈরি হয় মেইতেই এলাকায় আর তা পাচারের নিয়ন্ত্রণ আবার কুকিদের হাতে। সব মিলিয়ে বড় চক্র।বীরেনের সমালোচকরা বলছেন, রাজ্যের বিজেপি সরকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে চাইছে। কংগ্রেস আমলে সরকার ও মাদক চাষিদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত সে ভাবে বাধেনি। কিন্তু সরকার বদলের পরে টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা ধাক্কা খেয়েছে। কুকিদের মৌরসিপাট্টা বেড়েছে।
দিল্লির মণিপুর ট্রাইবালস ফোরাম সুপ্রিম কোর্টে অভিযোগ তুলেছে, রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন এএসপি বৃন্দা থাওনাজোম থৌবাল জেলার এক ড্রাগ মাফিয়া তথা রাজনীতিবিদকে বমাল গ্রেফতার করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বীরেন তখন ওই ঘটনায় চার্জশিট তৈরি না করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। ফোরাম বৃন্দার সেই রিপোর্ট নিয়ে তদন্তের দাবি তুলছে।
অন্য দিকে, বীরেনের ঘনিষ্ঠ শিবিরের পাল্টা বক্তব্য, মাদক পাচারের কারবারে ঢিল পড়লে কুকি জঙ্গি সংগঠনগুলো যে হিংসা শুরু করবে, তা জানা ছিল।
তাই রাজ্য সরকার আগেই সুপারিশ করেছিল কুকি জঙ্গি সংগঠনগুলির সঙ্গে সংঘর্ষবিরতি প্রত্যাহার করার জন্য। যাতে প্রয়োজনে নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু বীরেনের বিস্তর অনুরোধেও কেন্দ্রের মোদী সরকার সেই সুপারিশ কার্যকর করতে রাজি হয়নি। যার ফলে এখন হিংসা লাগামছাড়া হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy