বারাক ওবামার সঙ্গে নিজের নাম লেখা স্যুট পরে বৈঠকে বসেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেই স্যুটের দাম ছিল ১০ লক্ষ টাকা। প্রধানমন্ত্রীর এই ‘আত্মপ্রেম’ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তখন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তাব্যক্তিরা দাবি করেছিলেন, এতে দোষের কী আছে!
এক বছর পরে সেই নরেন্দ্র মোদীই এখন চাপের মুখে। নোট বাতিল থেকে তাঁর যাবতীয় একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। আর তাই খাদি ইন্ডিয়ার ক্যালেন্ডারে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর বদলে মোদীর চরকা কাটার ছবি ছাপায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ই এখন ব্যাকফুটে। সচিবালয়ে মোদীর আস্থাভাজন কর্তারা এখন দাবি করছেন, ক্যালেন্ডারে এই ছবি ছাপার কথা প্রধানমন্ত্রী জানতেন না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কোনও অনুমতিও নেওয়া হয়নি। এর আগেও রিলায়্যান্স জিও এবং পেটিএম-এর বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রধানমন্ত্রী কেন শিল্পপতিদের হয়ে বিজ্ঞাপন করবেন? প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের যুক্তি, ওই সব ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কোনও অনুমতি নেওয়া হয়নি।
নিজের মুখ ও নামের প্রতি মোদীর এই প্রেম নিয়ে কটাক্ষ করে রাহুল গাঁধী আজ বলেছেন, ‘‘খুব শীঘ্রই রামলীলাতে ভগবান রামের মুখে প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখোশ দেখা যাবে।’’ আজ হৃষীকেশে কংগ্রেসের কর্মীদের সঙ্গে সভায় রাহুল বলেন, ‘‘মোদীজি এক দিকে দশলাখি স্যুট পরেন, অন্য দিকে চরকা কাটেন। চরকার অর্থ গরিবের ঘাম-রক্ত। মোদী কাজ করছেন বড় শিল্পপতিদের জন্য।’’ এক সুরে কংগ্রেসের বাকি নেতাদের বক্তব্য, মোদীর ডিজাইনার পোশাক বা ইতালীয় লিনেনের সঙ্গে চরকা কাটাটা মোটেই মানানসই নয়। রাহুল এ দিন নিজের কুর্তার ছেঁড়া পকেট দেখিয়ে বলেন, ‘‘আমার কুর্তার পকেট ছেঁড়া হলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু মোদীজির পোশাক কখনও ছেঁড়ে না। অথচ তিনি গরিবের রাজনীতি করেন!’’
কংগ্রেস নেতাদের যুক্তি, বর্তমান সরকারে যেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদীর অনুমতি ছাড়া কাগজের পাতাও ওল্টানো হয় না, সেখানে খাদির ক্যালেন্ডারে তাঁর অনুমতি ছাড়াই ছবি ছাপা হয়ে গেল, এটা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর আপত্তি থাকলে ক্যালেন্ডার ছাপার পরেও তিনি তা বন্ধ করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এখন বিতর্ক শুরু হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় দাবি করছে, মোদীকে না জানিয়েই তাঁর ছবি ছাপা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞাপনেও বা প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়া তাঁর ছবি ছাপা হলে সরকার কেন আপত্তি করেনি— প্রশ্ন তুলছেন কংগ্রেস নেতারা।
খাদির এই মোদী-করণের চেষ্টা দেখে নিন্দায় মুখর মোহনদাস কর্মচন্দের প্রপৌত্র তুষার গাঁধীও। সম্প্রতি এক টুইটে খেদের সঙ্গে তিনি লেখেন, ‘‘তেরা চরকা লে গ্যয়া চোর, শুন লে বাপু এ পয়গাম, মেরি চিট্ঠি তেরে নাম।’’ খবরের চ্যানেলে মোদী সম্পর্কে আরও ধারালো তিনি, ‘‘হাতে চরকা অন্তরে নাথুরাম!... টিভিতে জোকারকে জোকার বলতে দোষ কী!’’ তুষার গাঁধী মনে করিয়ে দেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী পরেন পলি-বস্ত্র (পলিয়েস্টারের পোশাক)। বাপু কিন্তু আসল খদ্দর পরেই বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়েছিলেন।’’
এ ভাবে বিভিন্ন ঘটনায় চাপে পড়লেও স্বভাব যে একেবারে পাল্টে গিয়েছে, তা নয়। আগ বাড়িয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের বিপাকে পড়ার ধারা সমানে চলেছে। গত কালই সংবাদমাধ্যমে গঙ্গাসাগরে মৃত্যুর খবর জেনেই প্রধানমন্ত্রীর দফতর রাতারাতি মোদীর হয়ে টুইট করে দেয়। ‘পদপিষ্ট’ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শোকপ্রকাশ করার পাশাপাশি হতাহতদের ক্ষতিপূরণের কথাও ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বা স্বরাষ্ট্রসচিবের থেকে কিছুই জানতে চায়নি প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়। রাজ্য সরকারের থেকেও রিপোর্ট চাওয়া হয়নি। কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, পদপিষ্ট হওয়ার কোনও ঘটনা ঘটেনি। এতেও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের মুখ পুড়েছে বলেই মনে করছে বিরোধীরা। সত্যাসত্য যাচাইয়ের আগেই মোদীর দফতর পদক্ষেপ করাতেই দরজা খুলেছে নতুন এক চাপানউতোরের।
গঙ্গাসাগর নিয়ে কেন্দ্রের তৎপরতা প্রসঙ্গে শোভনের মন্তব্য, ‘‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজ্যের সরকারকে এড়িয়ে এই ধরনের অনৈতিক কাজ করছে কেন্দ্র। বিজেপি সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ সব করছে। ওদের মনে রাখা উচিত, কেন্দ্রের মতো রাজ্যেও জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় রয়েছে।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের পাল্টা মন্তব্য, ‘‘গঙ্গাসাগরের ওই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ আছে। সেটা ধরে তদন্ত করলেই সত্য জানা যাবে।’’
নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সচিবালয়ের একতরফা সিদ্ধান্তের সব থেকে বড় নিদর্শন হল নোট বাতিল। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরামর্শের ভিত্তিতে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ও অন্যান্য শীর্ষকর্তা থেকে শুরু করে মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল, তা প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর আস্থাভাজন আমলারা নিজেরাই নিয়ে ফেলেন। যখন দেখা যায়, নোট বাতিলের রূপায়ণ ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখন দাবি করা হয়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সুপারিশের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বাস্তব যে তা নয়, তা-ও অবশ্য খোলসা হয়ে গিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিজেই সংসদীয় কমিটির কাছে লিখিত ভাবে জানিয়েছে, সরকারের তরফেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে নোট বাতিলকে অনুমোদন করতে বলা হয়েছিল। সেই অনুযায়ী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সিলমোহর বসিয়েছে মাত্র। মোদী তার পর তা সগর্বে ঘোষণা করেছেন। মোদী সরকারের এই অবস্থান বদলের ফলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর উর্জিত পটেলই বিপাকে পড়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য অভিযোগের আঙুল উঠেছে তাঁরই দিকে।
খাদির ক্যালেন্ডার নিয়ে বিজেপি প্রথমে তেড়েফুঁড়ে মাঠে নেমেছিল। দলের মুখপাত্ররা দাবি করেছিলেন, মোদী নিজে খাদির পোশাক পরেন, অন্যকে খাদির পোশাক পরতে উৎসাহ দেন। তার জেরেই মোদী জমানায় খাদির পণ্যের বিক্রি বেড়েছে। আরও এক ধাপ এগিয়ে হরিয়ানার বিজেপি মন্ত্রী অনিল ভিজ দাবি করেন, খাদির জন্য গাঁধীজির থেকেও বড় ব্র্যান্ড মোদী। কিন্তু মানুষ যে বিষয়টি ভাল ভাবে নিচ্ছে না, তা বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ই এখন ক্যালেন্ডারের ছবির দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy