ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানা চত্বরের একাংশ। —নিজস্ব চিত্র।
৪০ বছর আগের ২ ডিসেম্বর মধ্যরাতের (ইংরেজি মতে ৩ ডিসেম্বর) সাক্ষী মরচে ধরা লোহার ফটক ঠেলতেই নড়ে উঠল ঘুমন্ত স্মৃতি।
সেই আরিফনগরের বিপুল এলাকা জুড়ে থাকা পাঁচিল ঘেরা ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেড চত্বর, যা বিশ্ব দরবারে ভোপালের অন্য পরিচয় তৈরি করে দিয়েছে। বিশ্বের প্রথম সারির শিল্প বিপর্যয়ের একটি, এই ভোপাল গ্যাস লিক দুর্ঘটনার দগদগে স্মৃতি বইছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কারখানা চত্বর সংলগ্ন ও আশপাশের ঘন জনবসতির বাতাস ঘটনার রাতে ঢেকে গিয়েছিল বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাসে। তারই প্রভাবে তছনছ হয়েছিল প্রায় পাঁচ লক্ষ নাগরিকের জীবন। বেসরকারি হিসেবে ঘটনার প্রথম সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা আট হাজারে পৌঁছয়। কারখানা কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ঘটনার রাতে মৃত্যু হয়েছিল তিন হাজারের কিছু বেশি।
১৯৮৪ সালের সেই রাতের পরে বন্ধ হয় কারখানার ফটক। চার দশক পরেও পরিত্যক্ত কারখানার অভিশপ্ত ফটক ঠেলতে বেশ কিছু কাঠখড় পোড়াতে হল।
বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষিদ্ধ। অথচ অনুমতি কোথা থেকে মিলবে, তার স্পষ্ট উত্তর চত্বরে হাজির কেউ দিতে পারলেন না। বা দিতে চাইলেন না। ফাঁক গলে টাকার বিনিময়ে চলে নাকি চোরাগোপ্তা ‘ঘুরে দেখা’। অভিযোগ, লাভের টোপ গিলে এখানে শুরু থেকেই কারখানা কর্তৃপক্ষও নিরাপত্তার নিয়ম ভাঙার ‘চোরাগোপ্তা’ পথে চলেছিলেন।
কারখানা পরিদর্শনে সঙ্গী চার বিদেশি সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিক এবং এক পঞ্জাবি তরুণী, পেশায় অধ্যাপিকা। নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে ঘণ্টা দুয়েকের জন্য প্রবেশের অলিখিত অনুমতি মিলল। যদিও ৪৫ মিনিট পরেই এল এলাকা ছাড়ার তাগাদা।
বন্ধ কারখানার মরচে ধরা লোহার গেট ঠেলে ঢুকতেই শুরু জঙ্গল। কখনও তা ঘন, কখনও একটু হালকা। বাঁ হাতে ভূতুড়ে কয়েকটি টানা একতলা ভবন। আন্দাজ করা গেল, ফটকের এত কাছে থাকা এই ভবন কখনও ছিল বিভিন্ন অফিসঘর। আরও এগোতেই নজরে পড়ল, বিক্ষিপ্ত ভাবে থাকা প্লান্টের দানবাকৃতি যন্ত্রাংশের কঙ্কাল। ঝোপ আর কাঁটাগাছের ঝাড় পেরিয়ে এগোনো হচ্ছিল। পথে পড়ছিল বিরাট সব লোহার যান্ত্রিক কাঠামো, এক সময়কার কর্মীদের ব্যস্ততার সাক্ষী। সেগুলির নীচে ছড়িয়ে পালক আর বিষ্ঠা। মরচে ধরা দৈত্যাকার রিঅ্যাক্টর ট্যাঙ্কের মাথার কাছে পৌঁছনোর বিপজ্জনক সিঁড়িতে পা পড়ে না বহুকাল।
দেখা মিলল সেই রাতে লিক করা মিথাইল আইসোসায়ানেট (এমআইসি) ট্যাঙ্কটির। মুখ থুবড়ে ফেলে রাখা ট্যাঙ্কের মাথায় আজও আছে রেগুলেটরের অবশেষ। তার কয়েক হাত দূরে অনেকটা জায়গা জুড়ে মাটিতে ছড়ানো বড় পাথরের চাঁই। যেন কিছু ‘ধামাচাপা’ দেওয়া। এই জায়গাতেই সকলের নাকে এল বিশেষ গন্ধ। অন্য রকম গন্ধ। কারখানায় ঢোকার বেশ কিছু ক্ষণ পরে আরও এক জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল বেশ ঝাঁঝালো গন্ধ। অচেনা সেই গন্ধ যে মনের ভুল নয়, তা স্পষ্ট হয়েছিল যখন দলের সবাই এর ওর মুখ চাইছেন। চত্বরে ঘুরে বেড়ানো এক লাঠিধারী জানালেন, গ্যাস বেরোয় এখনও। বেশি ক্ষণ না থাকতে সতর্ক করে যেন মিলিয়ে গেলেন তিনি।
কারখানায় ঢোকার পথে দেখা গেল, সাইরেন টাওয়ার। যার মাথার আলো আর শব্দ ছড়াত বিপদবার্তা। শোনা গেল, বিশেষ সময়ে সতর্ক করতে গোড়ায় এই সাইরেন ঘন ঘন বাজত। ফলে অভিযোগ জমছিল কারখানা নিয়ে। কর্তৃপক্ষ তাই বন্ধ করে দেন সাইরেন।
১৯৬৯ সালে কীটনাশক, ব্যাটারি প্রভৃতির উৎপাদন শুরু করে ইউনিয়ন কার্বাইড ইন্ডিয়া লিমিটেডের এই কারখানা। এখানে প্রযুক্তি ছিল মানুষ নির্ভর। গোড়া থেকেই কারখানার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৭৬ সালে স্থানীয় দু’টি সংগঠন কারখানা চত্বরে গ্যাস লিকের অভিযোগ করে। ১৯৮১ সালে মেরামতির কাজে পাইপে নেমে বিষাক্ত ফসজেন গ্যাসে ঝলসে মৃত্যু হয় আশরফ খান নামে এক শ্রমিকের। গুরুতর জখম হন দু’জন। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে ঘটে পর পর দুর্ঘটনা। ফসজেন লিক করে ২৫ জন শ্রমিক অসুস্থ হন। ফের অক্টোবরে এমআইসি লিক থামাতে গিয়ে গুরুতর জখম হন সুপারভাইজার-সহ তিন কর্মী এবং শতাধিক বাসিন্দা। এমন গ্যাস লিকের ছোটখাটো ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছিলআসন্ন বিপদের।
১৯৮৪-র গ্যাস লিকের দুর্ঘটনার আগে থেকেই কর্তৃপক্ষের অসতর্কতার চিহ্ন জমছিল জমে থাকা রাসায়নিক বর্জ্যে। কারখানার বাইরের জলাশয়ের রাসায়নিক বর্জ্য ও চত্বরের ৩২ একর জায়গা জুড়ে ১৯৭৭ সালে নির্মিত ‘সোলার পন্ডে’ পরিবেশের ক্ষতিকর বর্জ্য ফেলা হত। আজও প্রতি বর্ষায় এ সব ভেসে এলাকা প্লাবিত হয় রাসায়নিক দূষণ। যার প্রভাবে বহু বছর ধরেই বিষাক্ত এখানকার ভূগর্ভস্থ জল ও পরিবেশ। ছবি তু্লতে সোলার পন্ডের কাছে যেতেই সেই লাঠিধারী বলে উঠলেন, “দূর হঠো। মরনে কা শখ হ্যায় ক্যায়া!”
‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’-এর (আইআইএসইআর) পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “গন্ধ যদি বেরিয়ে থাকে, তার মানে কিছু না কিছু কেমিক্যাল সাবস্টেন্স হাওয়ায় ঘুরছে। তার উৎস কী? সেটা জানা জরুরি। এ জন্য ওই এলাকায় পরিবেশ বিজ্ঞানীদের নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন, মাটির নীচে কি কোনও কন্টেনার আছে, যেখান থেকে গন্ধ বেরোচ্ছে? নাকি উৎস অন্য কিছু? বৃহত্তর স্বার্থে তা জানতে সরকারি স্তরে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।”
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক পৃথা ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, অতি বিষাক্ত কার্সিনোজেনিক উদ্বায়ী গ্যাস এই মিথাইল আইসোসায়ানেট। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলছে, ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার পরে এখনও ওই সব অঞ্চলে বিষাক্ত গ্যাসের উপস্থিতি রয়েছে। কারণ, এই এমআইসি সময়ের সঙ্গে অন্য যৌগে পরিণত হয় বা বিয়োজন হয়। তাপীয়, জল দ্বারা, সূর্যালোক দ্বারা, উৎসেচক দ্বারা এবং অণুজীবীর সহায়তায় এই বিয়োজন হয়। পৃথা বলেন, “কোনও অঞ্চলের তাপমাত্রা ও পিএইচ-র পার্থক্য এবং অণুজীবীদের প্রকার ও সংখ্যা বলে দেবে এমআইসি কত তাড়াতাড়ি বিয়োজিত হবে। বিয়োজিত যৌগ আবার অক্সিজেন ও জলের সঙ্গে বিক্রিয়ায় অন্য কোনও পদার্থ তৈরি করে। যার কিছু মাটিকে আঁকড়ে উপরে লেগে থাকে। আর কিছু পদার্থ মাটির ভিতরে ঢুকে বহু দিন ধরে রাসায়নিক গ্যাস নিষ্ক্রমণ করে। ক্রমাগত ক্রিয়া-বিক্রিয়া দুই-তিন প্রজন্ম ধরে চলতে পারে। বিশদে পরিবেশের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে ওই জায়গায় গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।”
অর্থাৎ, এখনও বিপদ মাথায় আরিফনগর ও তার সংলগ্ন এলাকা। সোলার পন্ডের কিছুটা দূরে চত্বরের বিরাট বড় মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে গবাদি পশু। ক্রিকেট খেলছে ছোটরা। বছর ছয় থেকে তেরোর সেই বালকদের প্রায় সকলেই জানে ‘গ্যাস-কাণ্ড’-এর কথা। যার মিথ এলাকায় ছড়ানো হয় আজও। ডিসেম্বরের ভোপালে মলিন ছেঁড়া জামা পরা মহম্মদ কবীরের কথায় সেটাই বোঝা গেল। ১১ বছরের বালক ব্যাট হাতে এগিয়ে এসে জানায়, সে শুনেছে রবিবার সকালে গ্যাস-কাণ্ডের ঘটনাস্থল দেখতে আসা এক জনকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ।
গত চার দশক ধরে নিজেদের দাবি আঁকড়ে আর হাওয়ায় ঘোরা এমন মিথ শুনেই ক্ষতিগ্রস্তেরা খালি ঝোলা নিয়ে বিষে বাস করে চলেছেন।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy