গ্রাফিক। সন্দীপন রুইদাস।
জল্পনা চলছিল গত কয়েক মাস ধরেই। পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনকে ‘পাখির চোখ’ করে মহারাষ্ট্রে শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেসের জোট ‘মহা বিকাশ আগাড়ি’তে ভাঙন ধরাতে চাইছে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের কয়েক দফায় দিল্লি যাত্রা এবং নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠক সেই জল্পনায় আরও ইন্ধন জুগিয়েছিল।
কিন্তু সোমবার বিধানসভার কার্যনির্বাহী স্পিকারকে হেনস্থার অভিযোগে ১২ জন বিজেপি বিধায়ককে ১ বছরের জন্য সাসপেন্ড করার ঘটনায় আপাতত সেই সম্ভাবনা হিমঘরে চলে গেল বলেই মনে করছেন রাজনীতির কারবারিদের একাংশ।
পাশাপাশি, তাঁদের ধারণা এই পদক্ষেপের ফলে পরিষদীয় পাটিগণিতের হিসেবে শিবসেনা নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের অবস্থান আপাতত ‘নিরাপদ’।
জোট সরকারের মেজো শরিক এনসিপি-র প্রধান শরদ পওয়ার সম্প্রতি জাতীয় রাজনীতিতে ফের ‘তৎপর’ হয়েছেন। ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর এবং একাধিক বিরোধী নেতার সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন বৈঠকে স্পষ্ট, জাতীয় স্তরে বিজেপি বিরোধী একটি মঞ্চ গড়তে শরদ সক্রিয়। বিজেপি-র একটি সূত্র জানাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে লোকসভা ভোটের আগে মহারাষ্ট্রে ‘রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ’ ফিরে পেতে চাইছে দল। কারণ, জনসংখ্যার হিসেবে দেশের বৃহত্তম রাজ্যে বিজেপি বিরোধী তিন দল এক হলে লোকসভা ভোটে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে পদ্মশিবির।
যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে এর কোনও সমর্থন কোনও তরফেই মেলেনি। তবুও ওই সূত্রের দাবি, মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা পুনর্দখলের জন্য একাধিক সম্ভাবনা যাচাই করেছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতারা। তার মধ্যে প্রাথমিক ভাবে ছিল, মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসকে ফের সরকারের প্রধান করে শিবসেনাকে উপমুখ্যমন্ত্রিত্ব দেওয়ার প্রস্তাব। প্রসঙ্গত, ২০১৯-এর নভেম্বরে একই প্রস্তাব খারিজ করেছিল শিবসেনা। এ বারও তা-ই করেছে বলেই সূত্রের দাবি।
ওই সূত্রের আরও দাবি, দ্বিতীয়ত বিকল্প ছিল, শিবসেনার ফডণবীসকে ‘অপছন্দ’ হওয়ায় তাঁকে রাজ্যের রাজনীতি থেকে দিল্লি পাঠিয়ে মহারাষ্ট্রে শিবসেনার সঙ্গে জোট সরকার গড়ার প্রস্তাব।
তৃতীয় বিকল্প হিসেবে আলোচনা চলছিল, পওয়ারের কন্যা সুপ্রিয়া সুলেকে মুখ্যমন্ত্রী করার। সে ক্ষেত্রে লাভ দু’টি। প্রথমত, ইউপিএ জোটে ভাঙন ধরানো সম্ভব হবে। দ্বিতীয়ত, শরদের সাহায্যে বিদর্ভ এবং কোঙ্কণ উপকূলের পর পশ্চিম মহারাষ্ট্রেও শক্তিবৃদ্ধির সম্ভাবনা বিজেপি-র।
বিধায়ক সংখ্যার হিসেবে শিবসেনা বা এনসিপি, কোনও একটি দলকে পাশে পেলেও মহারাষ্ট্রে জোট সরকার গড়তে পারার সম্ভাবনা বিজেপি-র। ২৮৮ বিধায়কের মহারাষ্ট্র বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজন ১৪৫টি আসন। বিজেপি-র বিধায়ক সংখ্যা ১০৬। যদিও সোমবার ১২ জন বিধায়কের সানপেনশনের জেরে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে ৯৪। শিবসেনার ৫৬, এনসিপি-র ৫৪ এবং কংগ্রেসের ৪৪ জন বিধায়কের পাশাপাশি ৮ নির্দল এবং কয়েকটি ছোট দলের সমর্থন রয়েছে ‘মহা বিকাশ আগাড়ি’ সরকারের উপর।
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফডণবীসকে সমর্থনের ক্ষেত্রে অবশ্য বিজেপি-র অন্দরেই মতবিরোধ রয়েছে। বিজেপি-র প্রাক্তন পরিষদীয় দলনেতা একনাথ খাড়সে কয়েকমাস আগেই ফড়ণবীসের বিরুদ্ধে গোষ্ঠী রাজনীতির করার অভিযোগ তুলে এনসিপি-তে যোগ দিয়েছেন। মহারাষ্ট্র বিজেপি-র একাংশের মতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই এনসিপি-র সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ হয়েছে তাদের।
২০১৯-এর বিধানসভা ভোটের পরে এনসিপি-র বিধায়ক তথা শরদের ভাইপো অজিত পওয়ারকে ভাঙিয়ে এনে উপ-মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ফডণবীস। কিন্তু বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে না পারায় তাঁদের ইস্তফা দিতে হয়। ওই ঘটনার জেরে মরাঠা রাজনীতিতে বিজেপি বিরোধী জোট গঠনের পথ প্রশস্ত হয়েছিল বলে তাঁদের অভিযোগ। শেষ পর্যন্ত অজিতও বিজেপি-সঙ্গ ছেড়ে কাকার কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করেন।
সোমবার স্পিকারের আসনে বসে বিধানসভা অধিবেশন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন শিবসেনা বিধায়ক ভাস্কর যাদব। অভিযোগ, সে সময় বিজেপি-র ১২ জন বিধায়ক তাঁকে হেনস্থা করেন। এর পরেই দ্রুত তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব পেশ করে সরকারপক্ষ। তা মঞ্জুরও করেন কার্যনির্বাহী স্পিকার যাদব। গত ফেব্রুয়ারিতে বিধানসভার স্পিকার পদে ইস্তফা দিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব নেন কংগ্রেসের নানা পাটোলে। বিধানসভার চলতি অধিবেশনেই নতুন স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার কথা। জল্পনা ছিল, সরকারপক্ষকে চাপে ফেলতে স্পিকার পদে লড়তে পারে বিজেপি। কিন্তু ১২ বিধায়ক সাসপেন্ড হওয়ায় রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সংখ্যার লড়াইয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ল বলে মনে করা হচ্ছে।
ঘটনাচক্রে, রবিবার মহারাষ্ট্র রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের সম্ভাবনা উস্কে দিয়েছিলেন ফড়ণবীস নিজেই। তিনি বলেছিলেন, ‘‘বিজেপি-র শত্রু নয় শিবসেনা। কয়েকটি বিষয়ে দু’দলের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু দুই প্রাক্তন শরিক দলের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।’’
এ ক্ষেত্রে ‘রাজনীতি’ বলতে শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের ‘হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারার’ দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি। কিন্তু ফড়ণবীসের এই মন্তব্যের জবাবে সোমবার সকালে শিবসেনা মুখপাত্র সঞ্জয় রাউত বলেন, ‘‘আমরা ভারত-পাকিস্তান নই। আমির খান এবং কিরণ রাওকে দেখুন, (আমাদের সম্পর্ক) অনেকটা তাঁদের মতো। আমাদের (বিজেপি-শিবসেনা) রাজনৈতিক পথ আলাদা হতে পারে। কিন্তু বন্ধুত্ব বরাবরই অটুট থাকবে।’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মতে বিচ্ছেদের ফাটল যে আপাপত জোড়া লাগছে না, সঞ্জয়ের মন্তব্যে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল। তা স্পষ্টতর হল কয়েক ঘণ্টা পরে। ১২ বিজেপি বিধায়কের ১ বছরের ‘নির্বাসনে’। প্রাথমিক ভাবে যা দেখে মনে হচ্ছে, বিজেপি-র যাত্রা আপাতত ভঙ্গ হয়েছে। এবং আপাতত নিরাপদে উদ্ধবের সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy