জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে প্রকাশ কারাট এবং এইচ ডি দেবগৌড়া। সোমবার নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনে পিটিআইয়ের ছবি।
ধর্মনিরপেক্ষতা দেশের পক্ষে একান্ত জরুরি। এবং গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা। এই প্রত্যাশিত কথাগুলিই আজ দলের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যথাসাধ্য তুলে ধরার চেষ্টা চালালেন সনিয়া গাঁধী। উপলক্ষ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ১২৫তম জন্মবাষির্কী হলেও আসলে কংগ্রেসকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখাতেই এই সম্মেলনের পরিকল্পনা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বা ক্ষমতাসীন বিজেপি বা তাদের শরিকদের কাউকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে, আগেভাগেই উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট করে দিয়েছিল কংগ্রেস। এবং প্রত্যাশিত পথে হেঁটেই কংগ্রেস সভানেত্রী এ দিন নেহরুর দর্শন, গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ও বিশেষ করে তাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি নিষ্ঠার কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এনেছেন তাঁর বক্তৃতায়।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী পালন সরকারও করছে। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকলে সনিয়া হয়তো তার থেকে বড় আয়োজনই করতেন। কিন্তু নেহরু-স্মরণে কংগ্রেসের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রাসঙ্গিকতা ভিন্ন। নেহরু-গাঁধী পরিবারের ঐতিহ্যকে লঘু করে দিতে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকার যখন তৎপর, তখন সনিয়া আজ বলেন, “নেহরু বলতেন সম্পদের উল্লাস বেশি, কিন্তু জ্ঞানের গুঞ্জন শোনা যায় মাত্র। তবে নেহরুর কাজ নিয়ে চর্চা ও গুঞ্জন ইদানীং কমে গিয়েছে। তাঁর কথার ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। তবু বলতে পারি, যে পথ তিনি দেখিয়েছিলেন, তা আজও প্রাসঙ্গিক।”
সনিয়া বলেন, “নেহরু এ দেশের গণতন্ত্রকে এমন ভাবে লালন পালন করেছিলেন যেমন মা তাঁর সন্তানকে করে। তিনি আর্থিক উন্নয়নের জন্য ভয় দেখিয়ে কাজ করানোর মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না।” সন্দেহ নেই সনিয়ার এই বক্তৃতার মূল নিশানা মোদী ও বিজেপিই। লোকসভা ভোটের পর জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেস এখন কোণঠাসা। ঘুরে দাঁড়াতে এখন খড়কুটোর মতো আশ্রয় খুঁজছে। প্রকাশ্যে ঘোষণা না করলেও, কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী একটি ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চ তৈরি করা। যে কারণে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এনডিএ-র বাইরে থাকা দলগুলিকে।
কতটা সফল হলেন সনিয়া? সম্মেলনে দেখা গেল, প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজার মতো বামপন্থী নেতাদের। ইউপিএ-র প্রথম দফায় যাঁরা সঙ্গ ছেড়েছিলেন কংগ্রেসের। হাজির দ্বিতীয় দফার ইউপিএ সরকার থেকে সরে আসা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। কিন্তু সময়ে-অসময়ে যাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছেন কংগ্রেসের, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির সেই পরিচিত মুখগুলিই দেখা গেল না। আসেননি মুলায়ম সিংহ যাদব, মায়াবতী। কোনও প্রতিনিধি পাঠায়নি ডিএমকে, ন্যাশনাল কনফারেন্স, তেলুগু দেশম পার্টি। আরজেডি-প্রধান লালুপ্রসাদও নিজে না এসে পাঠিয়েছিলেন দলের সাংসদ জয়প্রকাশনারায়ণ যাদবকে।
চুম্বকে নেহরুর দর্শনকে সামনে রেখে জাতীয় স্তরে বিজেপি-বিরোধী একটি ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চ গড়ার কংগ্রেসি প্রয়াস আজ গোড়াতেই ধাক্কা খেল, বলছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। জাতীয় রাজনীতির এই মুখগুলি নেহরু-স্মরণের সম্মেলনে উপস্থিত না থাকায় সেই মঞ্চ রাজনৈতিক উচ্চতা পায়নি। বরং নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনের তুলনায় সিডনির অ্যালফোনস অ্যারেনাই আজ বেশি প্রচারের আলো কেড়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অরুণ জেটলি। তিনি বলেন, “কংগ্রেসের সম্মেলনে নিমন্ত্রিতদের তালিকা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওঁদের রেখচিত্র নিম্নগামী। কিছু লোহিয়াপন্থী আর বামপন্থীদের ডাকা হয়েছে সম্মেলনে। অথচ রামমনোহর লোহিয়া ছিলেন নেহরুর রাজনীতির ঘোর বিরোধী। অন্য দিকে কেরলে প্রথম বাম সরকার ফেলে দিয়ে ৩৫৬ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করার ব্যাপারে নেহরুর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন বামেরা। অর্থাৎ যাঁরা আগে নেহরুর দর্শনকে খারিজ করেছিলেন, তাঁরাই এখন কিনা এই সম্মেলনে এসে শক্তি প্রদর্শন করতে চাইছেন!”
দু’দিনের এই সম্মেলনে কারাট-মমতাদের হাজির থাকার পিছনে রাজনৈতিক দায়টাও অস্পষ্ট নয় মোটে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপিকে রুখতে এখন উভয়েই কংগ্রেসের মুখাপেক্ষী। কিন্তু আপাতত দুর্বল কংগ্রেসের মঞ্চে যোগ দিতে রাজি নন মুলায়ম-নীতীশ। বরং তাঁরা চাইছেন, পূর্বতন জনতা পরিবারের শরিকদের এককাট্টা করতে। এ জন্য সম্প্রতি মুলায়মের বাসভবনে নীতীশ- লালুর মতো জনতা দলের পুরনো নেতারা বৈঠকেও বসেছিলেন। ওঁদের কৌশল হল, বিহার ভোটের আগে কংগ্রেস যেন তাঁদের সমর্থন জানায়।
ডাক পেয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকের না আসাতেই শুধু নয়, সনিয়ার দল-পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা ধাক্কা খেয়েছে দলের অন্দরেও। এ কে অ্যান্টনি আসেননি, অসুস্থ থাকায়। জয়রাম রমেশ বিদেশে। কিন্তু দলের পক্ষে এমন একটি অনুষ্ঠানে পি চিদম্বরম, কমলনাথ, সুশীলকুমার শিন্দের মতো কংগ্রেসের অনেক প্রবীণ নেতারই দেখা মেলেনি। আসেননি কর্নাটক ও কেরলের মুখ্যমন্ত্রীও।
আমন্ত্রণ গিয়েছিল ৫২টি দেশের নেতাদের কাছে। এ দিন এসেছেন ঘানার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন কুফোর, আফগানিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই, ভুটানের রাজমাতা আসি দর্জি, নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাধব নেপাল প্রমুখ।
তবে এর মধ্যেও নেহরুকে সামনে রেখে ধর্মনিরপেক্ষতার বার্তা দিতে সনিয়া ত্রুটি রাখেননি। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সনিয়া বলেন, “নেহরু বলতেন, যদি ধর্মের নামে এক জন অপরকে দমন করতে চান, তার বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই করব। তা সরকারের নেতা হিসেবে হোক বা বাইরে থেকে।” কংগ্রেস সভানেত্রীর কথায়, “ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া ভারত ও ভারতীয়তার কোনও অর্থ নেই। বরং ভারতের মতো বৈচিত্রপূর্ণ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শনই অপরিহার্য।”
এখানেই থেমে থাকেননি কংগ্রেস সভানেত্রী। কার্যত বিজেপিকে বার্তা দিতেই বলেন, “নেহরু বলতেন, গণতন্ত্রে মর্যাদার সঙ্গে হার ও জিত কী ভাবে মেনে নিতে হয়, তা জানতে হবে। যাঁরা জিতবেন সাফল্য যেন তাঁদের মাথায় চড়ে না বসে। যাঁরা পরাস্ত হবেন, তাঁদেরও হতাশার কারণ নেই। কী ভাবে জিতলেন বা হারলেন সেই কারণটা ফলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভুল পথে জেতার তুলনায় ঠিক পথে থেকে হারাও ভাল।”
স্পষ্টতই সনিয়ার কথায় উঠে এসেছে সাম্প্রতিক নির্বাচনী হার-জিতের প্রসঙ্গই। আর সম্মেলনের উদ্দেশ্যটাই যে পূরণ হল না তা নিয়ে কী বলছে কংগ্রেস। না-আসা আমন্ত্রিতদের নিয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র বীরাপ্পা মইলি এ দিন বলেন, “কেন কে আসতে পারেননি সেই ব্যাখ্যা তাঁরাই দিতে পারবেন। সম্মেলন কালও চলবে। এ-ও হতে পারে কাল তাঁরা আসবেন!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy