Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

ভোটে উত্‌সাহ দিতে লোহারডাগায় তত্‌পরতা

২৩ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে গুমলার শহিদ চকে গাড়ি ঢুকতেই ভেসে এল নাগপুরী (ছোটনাগপুর) গানের কলি। “চুনু এসন প্রতিনিধি / বদলি আমার গতিবিধি / যে করি গরিব কে উত্থান / চল যাবই করে মতদান।” কেউ দাঁড়িয়ে শুনছেন। কেউ বা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও থামছেন না সঞ্জনা-শঙ্কররা। প্রবল গরমে ঢোল পেটাচ্ছেন, কী-বোর্ড বাজাচ্ছেন আর গাইছেন। এই গানের জন্যই তাঁদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ছে। ভোটের দৌলতে এই ক’টা দিন ওঁদের এটাই রোজগার।

প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়
রাঁচি শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:১১
Share: Save:

২৩ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে গুমলার শহিদ চকে গাড়ি ঢুকতেই ভেসে এল নাগপুরী (ছোটনাগপুর) গানের কলি। “চুনু এসন প্রতিনিধি / বদলি আমার গতিবিধি / যে করি গরিব কে উত্থান / চল যাবই করে মতদান।” কেউ দাঁড়িয়ে শুনছেন। কেউ বা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। তা সত্ত্বেও থামছেন না সঞ্জনা-শঙ্কররা। প্রবল গরমে ঢোল পেটাচ্ছেন, কী-বোর্ড বাজাচ্ছেন আর গাইছেন। এই গানের জন্যই তাঁদের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ছে। ভোটের দৌলতে এই ক’টা দিন ওঁদের এটাই রোজগার।

পাথুরে জমিতে চাষবাস তেমন হয় না। বর্ষার পরেই খেত শুকনো। কাজের জন্য অন্যত্র চলে যাওয়া (স্থানীয় ভাষায় বলে ‘পলায়ন’), নয়তো বক্সাইট খনির মজুরের লাইনে গিয়ে দাঁড়ানো। কাজের লোভ দেখিয়ে গ্রামের অল্পবয়সী মেয়েদের দালাল মারফত্‌ অন্যত্র পাচার হয়ে যাওয়া মাঝে মাঝেই শিরোনামে তুলে আনে লোহারডাগাকে। লোহারডাগা লোকসভা আসন এমনই। তবে এর মধ্যেই ভোট এলে একটু হয়তো ভাল থাকে কিছু কিছু মানুষ। কারণ ভোটের বাজারে গুরুত্ব তো আম-আদমিরই। নানা দল, নানা প্রার্থী, নানা কাজ। সভায় গেলেও টিফিন-নগদ টাকা। ভোট এলে যে যার মতো একটু ভাল থাকে। যেমন সঞ্জনা-শঙ্কররা ভোট এলে একটু ভালো থাকেন, কারণ তাঁরা গানের বরাত পান। কখনও দল থেকে, কখনও সরকার থেকে। এ বার যেমন সরকারের চুনুবাবুরা (আসলে চুনাওবাবু) ‘নিজের ভোট, নিজে দিন / বুথে গিয়ে ভোট দিন’ প্রচারে বাড়তি বরাদ্দ করেছে। সেই বার্তাবাহী গান গেয়ে দু’পয়সা রোজগার করছেন শঙ্কররা। অন্য সময় হয় খেতে চাষবাস, নয়তো ‘পলায়ন’।

লোকশিল্পীদের সংস্থা ‘মধুকুঞ্জ’-এর পাণ্ডা শঙ্কর নায়ক। তিনি গান বাঁধেন, সুর বাঁধেন। গান করেন সঞ্জনা। মজা করে শঙ্কর বলেন, “মানুষের ভোটে তেমন উত্‌সাহ নেই। তাই ভোটের গান বেঁধে দুটো রোজগার হচ্ছে এ বার। ভোটে বেশি উত্‌সাহ হলে পরের বার হয়তো আমাদের রোজগারও বন্ধ হয়ে যাবে।” আয় বলতে দিন পিছু দু’শো থেকে পাঁচশো টাকা। তার মধ্যে আবার অনুষ্ঠানের বরাত যিনি পাইয়ে দিয়েছেন সেই চুনুবাবুকে তার হিস্যাও দিতে হবে।

গুমলা, বিষুণপুর, সিসাই, মান্দার, লোহারডাগা---এই পাঁচটি বিধানসভার বাসিন্দাদের নিয়েই লোহাডাগা লোকসভা। এলাকার মানুষের কিন্তু ভোট নিয়ে বিরাট উত্‌সাহ কিছু চোখে পড়ে না। কোথাও কোথাও কিছুটা গা-ছাড়া মনোভাবও রয়েছে। গ্রামের প্রত্যন্ত এলাকা তো কোন ছাড়, জাতীয় সড়কের ধারেও রাজনৈতিক দলের পতাকা-ফেস্টুন খুঁজে পাওয়া দায়। এক-আধটা প্রচার গাড়ি যদি বা চোখে পড়ল তো পড়ল। আর হোর্ডিং, ব্যানার বলতে যা, তার অধিকাংশই নির্বাচন কমিশনের। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই এলাকায় মাত্র তিপ্পান্ন শতাংশ ভোট পড়েছিল। সে কারণেই এ বার বাড়তি জোর।

কংগ্রেস আর বিজেপির পাশাপাশি এই কেন্দ্রে এ বার প্রার্থী দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসও। তাঁর প্রার্থী বিষুণপুরের বিধায়ক চামড়া লিণ্ডা এখানে লড়াইয়ে থাকবেন বলেই ধারণা রাজনীতির লোকজনদের। গত লোকসভা নির্বাচনে নির্দল হিসেবে লড়ে তিনি দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। ফলে লোহারডাগার উপরে বাড়তি নজর রয়েছে তৃণমূলের। রয়েছে কংগ্রেস, বিজেপি, জেভিএম। আর রয়েছেন মাওবাদী অধ্যুষিত লোহারডাগায় সশস্ত্র জঙ্গিরা।

বিষুণপুরের বাসিন্দা রামরতন সাহুর ক্ষোভ, “মাওবাদী সমস্যার নামে এখানে উন্নয়ন হয় না। তবে সাধারণ মানুষের সমস্যা মাওবাদী নয়। বেকারত্ব। এখানে বক্সাইটের খনিতে দিন মজুরের কাজ করতে হয় আমাদের। কোনও দল একটা কারখানা তৈরি করতে পারল না! সেচের জলের ব্যবস্থা হল না আজও। ভোটের পরে নেতাদের দেখাও যায় না। পরিস্থিতি যা ছিল তাই আছে, তার থেকেও খারাপ হয়েছে। মানুষ ভোট দেবে কেন?” এই প্রশ্নটাই আসল। আর এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই জঙ্গি অধ্যুষিত লোহারডাগায় রাজনীতির কারবারিরাও মাওবাদীদের সঙ্গে দর কষাকষি করে নেন। জঙ্গিদের বুলেটকে যাঁরা নিজেদের দিকে টানতে পারেন, ব্যালটের লড়াইয়ে এগিয়ে যান তাঁরাই। এরপর গ্রামে গ্রামে ফতোয়া জারি করে জঙ্গিরা। বাধ্য করে তাদের মনোনীত দলকেই ভোট দিতে। নিজের পছন্দের দলকে ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকায় অনেকে বুথেও যান না। লোহারডাগার সাংসদ তথা এ বারের বিজেপি প্রার্থী সুদর্শন ভগত মানছেন নির্বাচন নিয়ে মানুষের উদাসীনতার কথা। তাঁর কথায়, “মানুষ হতাশ হতেই পারেন। কারণ ইউপিএ সরকার এলাকার উন্নয়নের জন্য কিছুই করেনি।” কিন্তু যে ক’বছর রাজ্যে তাঁদের দল ক্ষমতায় ছিল তখনই বা কী হয়েছে? নিরুত্তর ভগত।

অন্য বিষয়গুলি:

election lohardaga
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy