এক বার খবর হয়েছিল, পশ্চিম মেদিনীপুরের পাঁচ বছরের এক শিশুর মস্তিষ্ক থেকে ক্রিকেট বলের আকারের সিস্ট অস্ত্রোপচার করে বার করেছেন চিকিৎসকেরা। সেই সিস্টে ছিল কয়েকশো ফিতাকৃমির লার্ভা। সিস্টের ফলে মাথায় অসহ্য ব্যথা হত শিশুটির। ক্রমশ অসাড় হতে শুরু করেছিল দেহের একাংশও। ফিতাকৃমির সংক্রমণ কিন্তু বিরল নয়। চিকিৎসক অরিজিৎ রায়চৌধুরীর কথায়, “বহু মানুষের দেহেই দেখা যায় এই ধরনের পরজীবী সংক্রমণ। অনেকের ক্ষেত্রে কোনও সমস্যার সৃষ্টি হয় না। অনেকের গুরুতর সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষ করে শিশুদের।”
কী ভাবে হয় ফিতাকৃমি সংক্রমণ?
আধসিদ্ধ বা কম আঁচে রান্না করা মাংস, মাছ ও সবজিতে যদি ফিতাকৃমির ডিম থাকে, তা হলে তা মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে। এর পাশাপাশি অপরিশোধিত জল থেকেও হতে পারে এই সংক্রমণ। মাঠে বা ঘাসজমিতে পড়ে থাকা মলে কৃমির ডিম থাকে। সেই ঘাস খায় গবাদি পশু, ফলে ওই ডিম তাদের শরীরে প্রবেশ করে। লার্ভা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন মাংসপেশিতে। সেই মাংস ভাল করে ধুয়ে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রান্না করে না খেলেই সমস্যা! একই ভাবে কৃমির ডিম স্বাদু জলের মাছের শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ণবয়স্ক ফিতাকৃমি হোস্ট বা ধারক ছাড়া বাঁচতে পারে না, কিন্তু ডিম বা লার্ভা বেঁচে থাকতে পারে। অর্থাৎ বলা চলে—
ডা. রায়চৌধুরী বললেন, “পূর্ণবয়স্ক কৃমি যদি কোনও ভাবে মানুষের দেহে প্রবেশ করে তা হলে বিশেষ সমস্যা সৃষ্টি হয় না। মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্রে এমনিতেই অনেক সময়ে কৃমি পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হয় যখন কৃমির ডিম বা লার্ভা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। সেটি শুধু ক্ষুদ্রান্ত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না। টিসু স্প্রেডের মাধ্যমে পেশি, চোখ ও মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।”
ক্ষুদ্রান্ত্রে ফিতাকৃমির সংক্রমণ বা টিনিয়াসিস: মানুষের ক্ষুদ্রান্ত্রের দেওয়ালে পরিণত ফিতাকৃমি চোষকের সাহায্যে আটকে থাকে। খাবার হজম হওয়ার সময়ে সেখান থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে। অনেক সময়েই এ ক্ষেত্রে ধারক মানুষ কিছু অনুভব করেন না। তবে কখনও কখনও অপুষ্টি, হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া, অসম্ভব ক্লান্তি, বমি ও ডায়রিয়া হতে পারে এই ধরনের সংক্রমণ থেকে। কোনও কোনও ফিতাকৃমি ৩০ বছর পর্যন্ত থেকে যেতে পারে ও ৩০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে তাদের দৈর্ঘ্য।
সিস্টিসার্কোসিস: ফিতাকৃমির ডিম বা লার্ভা যদি শরীরের অন্য অংশে পৌঁছে যায় তখন তাকে বলে সিস্টিসার্কোসিস। এই সংক্রমণের ফলে দেহের যে যে অংশে লার্ভা পৌঁছয় সেখানে সিস্ট হয়। ফুসফুস, যকৃতে সিস্ট হলে সেগুলি ক্রমশ বড় হয়ে অঙ্গগুলির কার্যক্ষমতা হ্রাস করতে শুরু করে। পেশিতেও হতে পারে এই সিস্ট।
ডা. রায়চৌধুরী বললেন, “সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় মস্তিষ্কে যদি এই লার্ভা পৌঁছে যায়। একে বলা হয় নিউরোসিস্টিসার্কোসিস। মস্তিষ্কে সিস্ট হতে থাকলে কনভালশান বা খিঁচুনি-তড়কা, হঠাৎ করে অজ্ঞান হওয়া প্রভৃতি দেখা যায়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে যেতে পারে মানুষ। মস্তিষ্কের কোনও অংশে এক বা একাধিক ফিতাকৃমির লার্ভার অবস্থানের ফলে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুয়িডের প্রবাহ ব্যাহত হয়। ধীরে ধীরে জায়গাটি ফুলতে শুরু করে। ফলে কথা বলা, দেহের চলাচল ব্যাহত হয়। এই সমস্যায় অস্ত্রোপচারও করতে হয় বহু ক্ষেত্রে।” পাশাপাশি রেটিনার পিছনেও অবস্থান করতে পারে এই লার্ভা।
ডা. রায়চৌধুরীর কথায়, “এই ধরনের সংক্রমণের ফলে সব সময় যে সমস্যা হবেই, তা নয়। সব সিস্ট সমস্যার সৃষ্টি করেও না। তবে, মস্তিষ্কের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এমনও হয়, সংক্রমণ হওয়ার ১০ বছর পরে শুরু হল উপসর্গ। তখন কিছুতেই ফেলে রাখা যাবে না।”
ডা. রায়চৌধুরীর মতে, “মূল সমস্যার সৃষ্টি করে টিনিয়া সোলিয়াম। টিনিয়া স্যাজিনাটা অতটা সমস্যার কারণ নয়। আর ফিশ টেপওয়ার্ম ক্ষুদ্রান্ত্রে ভিটামিন বি ১২ শোষণে বাধা দেয়। ফলে রক্তাল্পতা হতে পারে।”
চিকিৎসা কী?
মূলত অ্যান্টি প্যারাসাইটিক ও অ্যান্টি কনভালশন ড্রাগ দিয়েই এর চিকিৎসা করা হয়। তবে আক্রান্ত হওয়ার বহু পরে উপসর্গ দেখা দিলে মূলত অ্যান্টি কনভালশন ড্রাগ দেওয়া হয়। দীর্ঘ দিন চলতে পারে এই চিকিৎসা, নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডা. রায়চৌধুরীর পরামর্শ, সংক্রমণ হওয়ার আগেই তা রুখতে হবে। তার জন্য নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা দরকার। আর রাস্তাঘাটে খাবার বা জল খাওয়ার আগে দেখে নিতে হবে তা আদৌ নিরাপদ কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy