ক্যানসার মানেই মৃত্যু, এ কথা আর প্রযোজ্য নয়। সব ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসার ওষুধ এখনও বাজারে আসেনি ঠিকই, কিন্তু সময় মতো রোগ নির্ণয় হলে রোগীর বাঁচার আশা যথেষ্ট। তবে ক্যানসার রোগীর সমস্যার আরও একটি দিক রয়েছে, যা বহু ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করে থাকেন চিকিৎসক, রোগী বা তাঁর পরিবার। তা হল, রোগাক্রান্ত মানুষটিকে ঘিরে ধরে মানসিক সমস্যা। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে, অন্তত ৭০ শতাংশ ক্যানসার রোগী রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পর্বে হতাশায় ভুগে থাকেন।
ক্যানসারকে ঘিরে বিভিন্ন কারণে জন্ম নিতে পারে হতাশা। প্রথমত, রোগের কথা সামনে আসতেই আক্রান্ত বা তাঁর পারিপার্শ্বিক মানুষেরা ধরেই নেন, এঁর আয়ু সীমিত। এই ধরনের সামাজিক পরিমণ্ডল রোগীর মনে অবসাদের জন্ম দেয়। দ্বিতীয়ত, ব্যয়বহুল চিকিৎসার দীর্ঘকালীন খরচ। এই আর্থিক বিষয়টি আক্রান্তের পরিবারের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। রাজ্যে সরকারি স্তরে কম খরচে ক্যানসার চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও তার দীর্ঘসূত্রতা, রোগীর পাশে থাকার মতো লোকবলের অভাব এবং কোথায় গেলে কী ভাবে এই চিকিৎসা মিলবে— সে বিষয়ে অজ্ঞতা মানসিক চাপের জন্ম দেয়। তৃতীয়ত, কিছু ক্ষেত্রে রোগের চিকিৎসায় ওষুধ বা অস্ত্রোপচার শরীরে এমন প্রভাব ফেলে, যা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে অনেকটা ব্যাহত করে।
ক্যানসারের চিকিৎসার যে যে ক্ষেত্রে মনোরোগ হতে পারে
সদ্য মা হওয়া বছর পঁয়ত্রিশের তরুণী খেয়াল করেছিলেন, তাঁর স্তনে একটি মাংসপিণ্ড। তিনি প্রথমে তাঁর স্বামীকে জানান, পরে তা জানতে পারেন তরুণীর শাশুড়ি। পরিবারের বড়দের পরামর্শ ছিল, সন্তানকে স্তনদুগ্ধপান করালে মাংসপিণ্ডটি এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেটির আয়তন বাড়ছে দেখে তরুণী যান স্ত্রীরোগ চিকিৎসকের কাছে। ওই মাংসপিণ্ডের বায়প্সি করালে ধরা পড়ে টিউমরটি ম্যালিগন্যান্ট। ক্যানসার চিকিৎসকের পরামর্শ মতো অন্যান্য পরীক্ষা করলে ধরা পড়ে, বাহুমূলের লিম্ফনোডেও ছড়িয়েছে রোগ। চিকিৎসক জানান, সরাসরি অস্ত্রোপচার করলে স্তন বাদ দিতে হবে। স্তন বাঁচানোর অন্য উপায় হল, কেমোথেরাপি দিয়ে টিউমরকে ছোট করে তার পরে অস্ত্রোপচার করা। আতঙ্কিত পরিবারটি সদ্যোজাতের কাছ থেকে মাকে দীর্ঘ দিন দূরে রেখে রোগের চিকিৎসা করতে রাজি ছিল না। তাই স্তন বাদ দেওয়ার পথেই হাঁটে। অস্ত্রোপচারের পরেও চলল রেডিয়েশন ও কেমোথেরাপি। এ সবের জেরে অবসাদ শুরু হয় তরুণীর। সেই সঙ্গে স্তন বাদ দেওয়া মনখারাপের জন্ম দেয়। নিজেকে সামাজিক ভাবে গুটিয়ে নেন ক্রমেই। ধীরে ধীরে নিজের একলা জগৎ তৈরি করে নিলেন।
প্রস্টেট ক্যানসারের চিকিৎসার পরে দেখা গিয়েছিল, প্রৌঢ়ের স্বাভাবিক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে সমস্যা হচ্ছে। এই জায়গা থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়েছিল। ক্যানসার সেরে গেলেও, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন প্রৌঢ়।
জরায়ুমুখের ক্যানসার আক্রান্ত মধ্য চল্লিশের মহিলাকেও দাম্পত্য জীবনে ভুগতে হয়েছিল। ঠিক সময়ে ধরা পড়ায় ক্যানসারের চিকিৎসায় সেরে উঠলেও শারীরিক সম্পর্ক তৈরিতে শিথিলতা আসে তাঁর। যে কারণে পরবর্তী সময়ে একাকিত্ব সঙ্গী হয় মহিলার।
হেড অ্যান্ড নেক, মুখের ক্যানসার অথবা অস্টিয়ো সারকোমা আক্রান্তদের বহু ক্ষেত্রেই শরীরের গঠনে পরিবর্তন আসে। হাত বা পায়ের অংশ বাদ দিতে হয়। এ ছাড়াও কেমোথেরাপির পরে চুল উঠে যায়, ত্বকের সমস্যা হতে পারে। অনেক রোগীই নিজের চেহারার এই সব পরিবর্তন মেনে নিতে পারেন না। একে বলে ‘বডি ইমেজ ডিজ়অর্ডার’। সেই পর্বে যে কেউ অবসাদ, উদ্বেগের শিকার হতে পারেন।
ক্যানসার থেকে সেরে ওঠা রোগীদের অনেকেই মনে করেন, ফের রোগ ফিরে আসতে পারে। রোগ প্রত্যাবর্তনের এই আশঙ্কা থেকেই মানসিক সমস্যার জন্ম হয়। যে কোনও শারীরিক পরিবর্তন বা ছোটখাটো অসুস্থতাও তাঁকে আতঙ্কিত করে তোলে। সেই থেকে অবসাদ, উদ্বেগ তৈরি হয়।
চিকিৎসা কোন পথে
কোনও ক্যানসার আক্রান্ত মনোরোগের শিকার হলে ও যথাযথ সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে সুস্থ হতে পারেন, জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের পরামর্শ, রোগীকেও নিজের জন্য কিছু পদক্ষেপ করতে হবে। যেমন,
ক্যানসার চিকিৎসক অরুন্ধতী দে-র মতে, ‘‘ক্যানসার রোগীর আয়ু বেড়েছে। চিকিৎসা চলাকালীন বা চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে তাঁর জীবনযাত্রার মান যাতে ভাল হয়, তাই তাঁর মনের যত্ন নেওয়া জরুরি। বর্তমানে ক্যানসারের চিকিৎসায় সেই দিক নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন চিকিৎসক এবং হাসপাতালগুলি। তবে রোগীর মানসিক শুশ্রূষায় আরও জোর দেওয়া উচিত। অন্তিম পর্যায়ের ক্যানসার রোগীদের মানসিক অবসাদ আরও তীব্র হয়, তা দূর করানোর উপায় আরও ভাবা উচিত।’’
ক্যানসার মনোবিদ সৌমিত্রশঙ্কর দত্তের পরামর্শ, “রোগীর মনের ক্ষত সারাতে সহানুভূতির সঙ্গে সবটা বিবেচনা করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ঠিক সময়ে রোগীর মানসিক অবস্থার পরিবর্তন বুঝে কাউন্সেলিং ও প্রয়োজনে ওষুধ দিতে হতে পারে। সবটাই পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করছে। তবে পরিবারকেও এই বিষয়ে সমান যত্নবান হতে হবে।” তাঁর আরও বক্তব্য, অন্তিম পর্যায়ের ক্যানসার রোগীর মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণা উপশম করার জন্য মনোবিদ, মনোরোগ চিকিৎসক, প্যালিয়েটিভ কেয়ার পরিষেবাকে সাধারণ মানুষের নাগালে আনতে হবে। শারীরিক যন্ত্রণা কী ভাবে কমানো যেতে পারে, তা দেখতে হবে। যে ক’দিন রোগী বাঁচবেন, তাঁর ছোট ছোট মত,ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে গুরুত্ব দেওয়া, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। এতে রোগীর জীবনের বাকিদিনগুলি স্বস্তিতে কাটবে, ভাল স্মৃতি তৈরি হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy