চিকিৎসক অরুণাভ ধর। ছবি: সংগৃহীত।
কোথায় উত্তর কলকাতার রাধাগোবিন্দ কর (আরজি কর) মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। আর কোথায় কেমব্রিজের অ্যাডেনব্রুক হাসপাতাল! আকাশপথে দূরত্ব প্রায় ৯ হাজার কিলোমিটার। ভৌগোলিক দূরত্ব তো রয়েছেই। পরিবেশ এবং পরিকাঠামোগত বিভাজনও কম নয়। তবে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে দু’দেশের মধ্যে সেতুবন্ধনের দায়িত্ব নিয়েছেন কলকাতারই এক বাঙালি চিকিৎসক। নাম অরুণাভ ধর। পেশায় শিশুরোগ চিকিৎসক। নবজাতক বা সদ্যোজাতদের নিয়েই তাঁর কাজ। নিয়োনেটোলজি বিভাগে যাঁর আবিষ্কার ইংল্যান্ডে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সেই কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে এসেছেন তিনি।
কী নিয়ে এত হইচই?
শহর থেকে অনেক দূরে, রাতবিরেতে কিংবা প্রতিকূল আবহাওয়ায় অসুস্থ সদ্যোজাতকে নিয়ে সব সময়ে বড় হাসপাতালে পৌঁছনো অভিভাবকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। অপেক্ষাকৃত ছোট, স্থানীয় হাসপাতালে সব রকম পরিষেবা না থাকলে সেখানে শিশুটির চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে পড়ে। অসুস্থ সদ্যোজাতটিকে তৎক্ষণাৎ বড় হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার মতো পরিস্থিতিও থাকে না। সেই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে শিশুর কাছে সশরীরে পৌঁছতে না পারলেও ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন এই বাঙালি চিকিৎসক। কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় রোগীকে দেখে চিকিৎসা আগেও হত। কিন্তু এই ব্যবস্থা তার চেয়ে অনেক বেশি উন্নত।
শুনে মনে হতে পারে, এ অনেকটা হিন্দি ছবি ‘থ্রি ইডিয়ট্স’-এর র্যাঞ্চোর কর্মকাণ্ডের মতো! বীরু সহসস্ত্রবুদ্ধে ওরফে ‘ভাইরাস’-এর বড় মেয়ে মোনা প্রসবযন্ত্রণায় ছটফট করছে। ও দিকে বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে গোটা শহর। আবহাওয়ার এমন অবস্থা যে, মোনাকে উদ্ধার করতে অ্যাম্বুল্যান্স কিংবা গাড়ি— কিছুই ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। ঠিক সেই সময়ে সন্তান প্রসব করানোর দায়িত্ব নিয়েছিল র্যাঞ্চো। ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র হয়ে সন্তান প্রসব করানো কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। তবে, মোনার বোন পূজা যে হেতু পেশায় চিকিৎসক, সে এবং তার হাসপাতালের সহকর্মীরা সেই কাজে র্যাঞ্চোকে সাহায্য করেছিল। গোটা বিষয়টিই সম্পন্ন হয়েছিল ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে। চিকিৎসা পরিকাঠামো ছাড়া কী ভাবে সন্তান প্রসব করাতে হয়, তা ক্যামেরার মাধ্যমে দেখিয়ে, বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল র্যাঞ্চোকে। প্রযুক্তিগত সাহায্য করেছিল ‘থ্রি ইডিয়ট্স’-এর দ্বিতীয় জন অর্থাৎ রাজু। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পুরো বিষয়টি কোনও মতে উতরে গিয়েছিল সে দিন। কিন্তু সে তো পর্দায়, বাস্তবে কি আদৌ এমনটা সম্ভব?
কোভিড পরিস্থিতি দেখিয়ে দিল, তা-ও সম্ভব। প্রযুক্তি এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান হাতে হাত মিলিয়ে দেশ-বিদেশের প্রায় সর্বত্র টেলিফোন, ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে চিকিৎসা পরিষেবা চালু করল। কিন্তু অরুণাভ বললেন, ‘‘প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা চলতে পারে। সাধারণ জ্বর-সর্দি-কাশির মতো রোগের চিকিৎসা সাধারণ ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে করা গেলেও শিশুদের জটিল কোনও রোগের চিকিৎসা এ পদ্ধতিতে হবে না। তার জন্য রোগীকে চোখে দেখা প্রয়োজন। শিশুটির গায়ের রঙে কোনও পরিবর্তন হল কি না তা-ও দেখা প্রয়োজন।” ভিডিয়ো কলে তা সম্ভব নয়। একেবারে সামনে থেকে নিজের চোখ দিয়ে কিংবা শিশুকে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার যে অনুভূতি তা সাধারণ ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে হওয়ার নয়। তাই অরুণাভ এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করতে চাইছিলেন, যার মাধ্যমে দেশের ছোট-বড় সব হাসপাতালকে এক ছাতার তলায় আনা যায়। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে বসেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ব্যবস্থা যেন চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে যায়। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম হল ‘ওয়ার্কস্টেশন অন হুইল’ বা সংক্ষেপে ‘ওয়াও’-এর। এবং গোটা ব্যবস্থাটির নাম দেওয়া হল ‘রিয়্যাল টাইম রিসোর্স লোকেটর ফর অ্যাকিউট নিয়োনেটাল ট্রান্সফার সার্ভিস’ বা সংক্ষেপে ‘লোকঅ্যান্টস’। কেমব্রিজ থেকে ফোনে আনন্দবাজার অনলাইনকে চিকিৎসক অরুণাভ ধর বলেন, “লোকঅ্যান্টস ব্যবস্থার মাধ্যমে সে দেশের ছোট-বড় সব হাসপাতালকে নিয়ে আসা হবে একটি বৃহত্তর ছাতার (নেটওয়ার্ক) তলায়। বড় হাসপাতাল থেকে তুলনায় ছোট হাসপাতালগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সেই কাজে সাহায্য করবে ‘লোকঅ্যান্টস’ ব্যবস্থা।
এই ব্যবস্থা কী ভাবে কাজ করবে?
লোকঅ্যান্টস ব্যবস্থার দুটি ভাগ রয়েছে। প্রথমটি হল, হার্ডঅয়্যার। যার নাম হল ‘ওয়াও’। অরুণাভ বলেন, “এই ‘ওয়াও’ আসলে চাকা লাগানো একটি ট্রলি বা ঠেলাগাড়ি। সেই গাড়ির উপর বসানো থাকে হাই-ডেফিনেশন ক্যামেরা-যুক্ত একটি মনিটর। তার সঙ্গে থাকে একটি স্পিকার এবং দু’টি সাউন্ড বক্স। ছোট হাসপাতালগুলো অর্থাৎ যেখানে অসুস্থ শিশুরা রয়েছে সেখানে বসানো থাকে এই ‘ওয়াও’।” যার সাহায্যে অনেক দূরে বড় হাসপাতাল থেকে রোগীকে সহজেই দেখা যায়। তার শব্দ শোনা যায়। আশপাশে কী ঘটছে তা-ও চিকিৎসকদের নজরে পড়ে।
দ্বিতীয় ভাগটি হল সফ্টঅয়্যার। যেটি থাকে বড় হাসপাতালে। সঙ্গে থাকে বিশালকার একটি মনিটর। যার মাধ্যমে শিশুর শারীরিক পরিস্থিতি সরাসরি দেখতে পাওয়া যায়। অরুণাভ বলেন, “ছোট হাসপাতালে বসানো ‘ওয়াও’ ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণ থাকে বড় হাসপাতালের চিকিৎসকদের হাতে।”
ভিডিয়ো কল কিংবা টিম ভিউয়ারের মতো উন্নত প্রযুক্তি তো আগেও ছিল। ‘ওয়াও’ তাদের চেয়ে কতটা আলাদা?
ভিডিয়ো কল বা মোবাইল ক্যামেরার মাধ্যমে রোগীকে দেখতে পাওয়া গেলেও তা কখনওই চিকিৎসকদের চোখ হয়ে উঠতে পারেনি। ‘ওয়াও’ আসায় সেই কাজ অনেকটাই সহজ হয়ে যেতে পারে। দেশের যে কোনও প্রান্তে বসে ‘ভার্চুয়ালি’ সদ্যোজাতের চিকিৎসা করা সম্ভব হবে গোটা ব্যবস্থাটির সাহায্য। বিপদের সময়ে পরিবারের পাশে থাকা, অসুস্থ শিশুর অভিভাবক বা ‘কেয়ার গিভার’দের সঙ্গে কথা বলা এবং যতটা সম্ভব নির্ভুল চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়াই এই ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য।
বিলেতে বাঙালি-রাজ নতুন নয়। তবে সে দেশে এই বাঙালি ডাক্তারের অবদান একেবারে নতুন। বর্তমান ঠিকানা কেমব্রিজ হলেও অরুণাভ আদতে মফস্সলের ছেলে। বেলঘরিয়া হাই স্কুলে পড়াশোনা। তার পর ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হওয়া কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে। ডাক্তারি পাশ করে বেশ কিছু দিন কলকাতার বিধানচন্দ্র রায় মেমোরিয়াল হাসপাতাল এবং বিধানচন্দ্র রায় পোলিয়ো ক্লিনিক হাসপাতালে কাজ করেছিলেন অরুণাভ। তার পরে নিজের শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রের পরিধি আরও প্রসারিত করতে ২০১০ সালে তিনি পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। সেখানে কেমব্রিজের অ্যাডেনব্রুক হাসপাতাল থেকে নবজাতক বা সদ্যোজাত (নিয়োনেটোলজি) নিয়ে হাতে-কলমে কাজ শুরু করেন। কাজ করতে গিয়ে প্রতি দিনই নানা রকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় চিকিৎসকদের। সেই অভিজ্ঞতা চিকিৎসা ক্ষেত্রে কোথাও না কোথাও কাজে লেগে যায়। তেমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল অরুণাভর জীবনে।
সালটা ২০১৮। কনকনে শীতের রাতে হঠাৎ হাসপাতালে ডাক পড়ে অরুণাভর। তখন তিনি পূর্ব ব্রিটেনের ‘অ্যাকিউট নিয়োনেটাল ট্রান্সপোর্ট’ চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ১০০ মাইল দূরে ওই দেশেরই একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে নির্জন, সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ছুটি কাটাতে এসেছিল ব্রিস্টলের একটি পরিবার। স্বামী, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এবং সঙ্গে ছিল তাঁদের ৭ বছরের কন্যাও। সে রাতে হঠাৎই তরুণীর প্রসববেদনা শুরু হয়। তৎক্ষণাৎ তাঁকে সেখানকার স্থানীয়, অপেক্ষাকৃত ছোট একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ওই তরুণীর দ্বিতীয় সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে। তবে সদ্যোজাতটি নির্দিষ্ট সময়ের আগে (প্রি ম্যাচিয়োর) ভূমিষ্ঠ হওয়ায় জন্মের কিছু ক্ষণের মধ্যেই তার শারীরিক কিছু সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। তখন স্থানীয় হাসপাতাল থেকে শহরের বড় হাসপাতালে থাকা অরুণাভর সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু রোগীর অবস্থা চোখে না দেখে চিকিৎসা করা তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সদ্যোজাতটির মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়। সদ্যোজাতটির বাবাকে ফিরে যেতে হয় তাঁদের অন্য সন্তানের কাছে। সেই পরিস্থিতিতে ১০০ মাইল দূর থেকে ওই সদ্যোজাতটিকে বড় হাসপাতালে নিয়ে আসাও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। অসুস্থ শিশুদের নানা রকম পরিষেবা দেওয়ার জন্য ইংল্যান্ডের (এনএইচএস)-এর অন্তর্গত পেডিয়াট্রিক অ্যান্ড নিয়োনেটাল ডিসিশন সাপোর্ট অ্যান্ড রিট্রিভাল সার্ভিস ‘পিএএনডিআর’ নামক যে বিশেষ দল রয়েছে, ঘটনাস্থলে তাদের পৌঁছনো পর্যন্ত অপেক্ষা করাও সম্ভব ছিল না। ঠিক সেই সময়েই অরুণাভর মাথায় একটি বুদ্ধি খেলে গেল। চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, চিকিৎসকও আছেন। প্রয়োজন শুধু সঠিক ভাবে সঠিক জায়গায় তা পৌঁছে দেওয়ার। তার জন্য চাই উন্নত প্রযুক্তি। ব্যস্, সেই থেকে শুরু।
অবশ্য অরুণাভ একা নন, এই কাজে তাঁর সঙ্গী ছিলেন বন্ধু, প্রযুক্তি বিশারদ রণদীপ চট্টোপাধ্যায় এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের চিকিৎসক সুজ়েন ব্রস্টার। অরুণাভর কথায়, “ফোনের মাধ্যমে এত দিন আমরা শুধু কানে শুনতে পেতাম। এখন দেখতেও পাচ্ছি। একেবারে মানুষের চোখের মতো ক্যামেরাকে চারদিকে ঘোরাতে পারছি। চাইলে অসুস্থ শিশুটির একেবারে নাকের ডগায় ক্যামেরাটিকে ‘জ়ুম ইন’ করে নিয়ে যেতে পারছি। বাচ্চার মা-বাবা কিংবা সেখানে উপস্থিত চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলছি। রোগীর পরিস্থিতি বুঝে চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন হবে সেই সিদ্ধান্ত নিতে অনেকটাই সাহায্য করছে এই ব্যবস্থা।” শুধু তা-ই নয়, ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিসের অন্তর্গত এই পিএএনডিআর’ দলটি ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি জটিল ক্ষেত্রে শিশুদের চিকিৎসায় অরুণাভর তৈরি ‘লোকঅ্যান্টস’ ব্যবস্থার সাহায্য নিয়েছে। বাঙালি ডাক্তারের মস্তিষ্কপ্রসূত এই ‘লোকঅ্যান্টস’ এবং ‘ওয়াও’ ইতিমধ্যেই পরীক্ষামূলক ভাবে কাজ শুরু করেছে সে দেশের চারটি হাসপাতালে।
চলতি মাসেই ইউকে-ইন্ডিয়া হেল্থ কনভেশনে অরুণাভ গোটা বিষয়টি দু’দেশের প্রতিনিধিদের সামনে উপস্থাপন করবেন। ইংল্যান্ডের ‘ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস’ এই গোটা ব্যবস্থার যথেষ্ট প্রশংসা করেছে। ইংল্যান্ডের সব হাসপাতালে তো বটেই, অরুণাভর আশা, এই ব্যবস্থা খুব তাড়াতাড়ি ভারতের প্রত্যন্ত এলাকার হাসপাতালেও গড়ে উঠবে। এশিয়ার মধ্যে নেপাল এবং ভারতে মহারাষ্ট্রের পুণেতে পরীক্ষামূলক ভাবে এই ব্যবস্থা চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy