স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় নতুন দিশা। ফাইল চিত্র।
জটিল অস্ত্রোপচার নয়। যন্ত্রণাদায়ক কেমোথেরাপি বা রেডিয়োথেরাপিও নয়। ক্যানসার কোষকে ধ্বংস করতে সক্ষম এক টুকরো থকথকে জেলি! যে সে জেলি নয়। এমন এক আধার, যা তার পেটের ভিতর ওষুধ পুরে নিয়ে দৌড়বে ক্যানসার কোষের দিকে। সরাসরি আঘাত করে ধ্বংস করবে টিউমার কোষকে। স্তন ক্যানসারের চিকিৎসায় এমন পদ্ধতির প্রয়োগ আগে হয়নি। এখানেই নতুনত্ব। গতে বাঁধা অস্ত্রোপচার বা কেমোথেরাপির থেকে যা অনেকটাই আলাদা। প্রথম বাঙালি গবেষকেরাই আশার আলো দেখালেন। ক্যানসার চিকিৎসায় ‘সুপ্রামলিকিউলার হাইড্রোজেল থেরাপি’ নিয়ে নতুন রকম গবেষণার পথে আইআইটি গুয়াহাটি ও কলকাতার বোস ইনস্টিটিউট। এ সংক্রান্ত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে লন্ডনের ‘রয়াল সোসাইটি অফ কেমিস্ট্রি’-র বিজ্ঞান পত্রিকা ‘মেটেরিয়াল্স হরাইজ়নস’-এ।
গবেষণাটি দু’টি ভাগে হচ্ছে। ‘হাইড্রোজেল’ তৈরি করা এবং সেটির কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণায় রয়েছেন আইআইটি গুয়াহাটির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক দেবপ্রতিম দাস ও তাঁরই দুই ছাত্রী তনুশ্রী দাস ও ঋত্বিকা কুশওয়াহা। অন্য দিকে, ‘হাইড্রোজেল’ পদ্ধতিটির বাস্তব প্রয়োগ করে কী ফল পাওয়া যাচ্ছে, সে নিয়ে পরীক্ষা করছেন কলকাতার বোস ইনস্টিটিউটের গবেষক কুলদীপ জানা ও তাঁর ছাত্র সত্যজিৎ হালদার এবং অনুপকুমার মিশ্র। আপাতত ইঁদুরের উপরে পরীক্ষা করে খুব ভাল ফল পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি গবেষকদের।
‘হাইড্রোজেল’ নিয়ে ক্যানসার থেরাপি এই প্রথম
ক্যানসার নিরাময়ের অনেক রকম চিকিৎসা পদ্ধতিই তো বেরিয়ে গিয়েছে। বেশ কিছু নিয়ে গবেষণাও হচ্ছে। তা হলে নতুন পদ্ধতিটি কোথায় আলাদা? এই প্রসঙ্গে আইআইটি গুয়াহাটির অধ্যাপক দেবপ্রতিমবাবু আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “ক্যানসারের চিকিৎসায় সুপ্রামলিউকিউলার জেল নিয়ে গবেষণা করে আমরা যা ফল পেয়েছি, তা আগে কখনও হয়নি বলেই আমার ধারণা। পলিমার জেল নানা রকম গবেষণার কাজেই ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু ক্যানসার সংক্রান্ত গবেষণায় এর প্রয়োগ করে আশানুরূপ ফল পাওয়া গিয়েছে।”
ক্যানসারের দুই রকম চিকিৎসা পদ্ধতি আছে— অস্ত্রোপচার ও কেমোথেরাপি। অস্ত্রোপচার করলেই যে ক্যানসার কোষ নির্মূল হবে, তা নয়। এর পরেও কেমোথেরাপি বা রেডিয়োথেরাপি দিতে হয়, যা যথেষ্টই যন্ত্রণাদায়ক ও খরচসাপেক্ষও। বস্তুত শরীরে বিষ প্রয়োগ করেই বিষক্ষয়ের চেষ্টা হয়। এতে যেমন শরীরের উপর অত্যাচার হয়, তেমনই মানসিক ভাবেও ভেঙে পড়েন রোগী। কাজেই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেবল শরীরে নয়, মনেও হয়। অধ্যাপকের কথায়, “গত ২০-৩০ বছরে ক্যানসারের গবেষণা বহু দূর এগিয়েছে। একাধিক চিকিৎসা পদ্ধতি বেরিয়েছে এবং ওষুধও তৈরি হয়েছে। তবে সেখানেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। ওষুধ খেলে বা শরীরে ইনজেক্ট করলে সেটি সঠিক জায়গায় যাচ্ছে কি না অথবা সুস্থ কোষগুলির ক্ষতি করে ফেলছে কি না, তা বোঝা যায় না। তাই কোনও ওষুধ এক জনের শরীরে কার্যকরী হলেও, অন্য জনের হয় না। এই সমস্যাই কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা হয়েছে নতুন গবেষণায়।”
কী এই ‘হাইড্রোজেল’?
আর পাঁচটি জেলের মতো নয়। এক ধরনের ত্রিমাত্রিক পলিমার, যা ছোট ছোট পেপটাইড দিয়ে তৈরি। প্রোটিনের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হল পেপটাইড। সেই পেপটাইড দিয়েই তৈরি হয়েছে হাইড্রোজেল। এর মধ্যে জলীয় ভাবই বেশি। সহজ করে বললে থকথকে জেলির মতো। এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। দেবপ্রতিমবাবু ও বোস ইনস্টিটিউটের গবেষক কুলদীপ জানা বলেন, “হাইড্রোজেল খুব নরম বস্তু, তরলও নয় আবার শক্তও নয়। এর ভিতরে পলিমারের নেটওয়ার্ক আছে। জেলের ভিতর ওষুধ ভরে দিলে ওই নেটওয়ার্কের জালিতে গিয়ে ওষুধটি সেঁটে যাবে। শক্ত করে আটকে বসবে, বাইরে বেরোবে না। এ বার জেলিটা শরীরে ইনজেক্ট করলে সেটি ওষুধটিকে নিয়ে সোজা চলে যাবে ক্যানসার কোষের কাছে। সেখানে গিয়ে ফেটে যাবে এবং ওষুধটি ছিটকে বার করে একেবারে টিউমারের উপর ফেলবে।”
সাধারণ জেলের থেকে কোথায় আলাদা হাইড্রোজেল?
এখানেও চমক আছে। সাধারণ জেল নিয়ে পরীক্ষাটি করতে গেলে তিনটি সমস্যা হত—
১) সাধারণ জেল শরীরে ঢোকালে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে রক্ত জমাট বাঁধার আশঙ্কা বাড়বে। হিতে বিপরীত হবে।
২) এমনিতে জেল বা জ্যামের মতো থকথকে বস্তু যদি সিরিঞ্জে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে সেটি এমন ভাবে জমে থাকবে যে, ইনজেক্ট করাই যাবে না।
৩) যদিও বা জেল ইনজেক্ট করা গেল, তা হলে সেটি শরীরে ঢুকেই রক্তে মিশে যাবে। ফলে ওষুধটি আর নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না।
সুপ্রামলিকিউলার হাইড্রোজেল এখানেই আলাদা। কারণ সেটির চরিত্র বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছে গবেষণাগারে। এটি যত ক্ষণ বাইরে রাখা হবে, তত ক্ষণ জেলির মতো জমে থাকবে। সিরিঞ্জে ভরার পরেই সেটি তরল হবে এবং সহজে ইনজেক্ট করা যাবে। আবার সুচের ডগা দিয়ে বেরোনো মাত্রই ফের জমে গিয়ে জেলি হয়ে যাবে। একই সঙ্গে তিন রকম সুবিধা পাওয়া যাবে।
রানার ছুটেছে ওষুধের বোঝা নিয়ে
রানার চলেছে, রানার...। ক্লান্তি এলেও চিঠির বোঝা নামিয়ে গাছের ছায়ায় দু’দণ্ড জিরিয়ে নেওয়ার তার জো নেই। ঠিকানা মিলিয়ে গন্তব্যে চিঠি পৌঁছে দিতেই হবে। ক্যানসারের গবেষণায় সেই রানারটি হল ‘হাইড্রোজেল’। ওষুধের বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়াই তার কাজ। ক্যানসারের বড় জাঁদরেল ওষুধ হল ‘ডক্সোরুবিসিন’। ওষুধটির কার্যকারিতা পরীক্ষায় প্রমাণিত। এই ওষুধটিকে দায়িত্ববান রানারের হাতে না দিলে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছতে অনেকটাই দেরি হয়ে যাবে। দেবপ্রতিমবাবুর কথায়, “খামের উপর ঠিকানা না লিখলে চিঠি কি আর সঠিক জায়গায় পৌঁছবে? কার বাড়িতে যেতে, কার বাড়ি ঢুকে যাবে। ক্যানসারের চিকিৎসায় এই গোলমালটাই তো হত। তাই হাইড্রোজেলই সেই পিয়নের কাজ করবে। ওষুধটি আঁকড়ে ধরে তার ঠিকানায় পৌঁছে দেবে।”
জেল তো ছুটল, ওষুধ বেরোবে কী করে?
হাইড্রোজেলে ভরে ওষুধ তো ঢুকল শরীরে। এ বার কোন ঠিকানায় সে থামবে, তারও পদ্ধতি আছে। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ক্যানসার কোষ একটি সঙ্কেত ছাড়ে, যেটি বুঝতে পারবে হাইড্রোজেল। সেই সঙ্কেতটির নাম হল ‘গ্লুটাথায়োন’। এক রকম ট্রাইপেপটাইড, যা শরীরেই তৈরি হয়। ক্যানসার কোষে এর মাত্রা খুব বেড়ে যায়। হাইড্রোজেল দেখবে যে কোষে গ্লুটাথায়োনের মাত্রা অস্বাভাবিক রকম বেশি, সেখানে গিয়েই সেটি ফেটে যাবে আর ওষুধও বেরিয়ে আসবে ভিতর থেকে। বার বার পরীক্ষা করে দেখে তা নিশ্চিত করে বোঝা গিয়েছে।
আবিষ্কারের পরে পরীক্ষা
হাইড্রোজেলটি কী ভাবে কাজ করছে, সে গবেষণা করছেন কলকাতার বোস ইনস্টিটিউটের গবেষক কুলদীপ জানা। তিনি বললেন, “ইঁদুরের উপর পরীক্ষা হয়েছে। ওষুধটির একটিমাত্র ডোজ় ইনজেক্ট করে দেখা গিয়েছে, ১৮ দিনের মাথায় টিউমার কোষের ৭৫ শতাংশ নির্মূল হয়েছে। ইনভিট্রো সেল কালচার মডেলে পরীক্ষাটি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সাফল্যের মুখ দেখেছি আমরা। এর পরে মানুষের উপর পরীক্ষাও হবে।”
কী ভাবে হয়েছে পরীক্ষা?
কুলদীপবাবুর কথায়, গবেষণাগারে ইঁদুরগুলিকে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত করা হয়েছিল। তার পর সুচ ফুটিয়ে হাইড্রোজেলে ভরা ডক্সোরুবিসিন ওষুধটি ইঁদুরের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ১৮ দিন পরে ইঁদুরের শরীর কাটাছেঁড়া করে দেখা যায়, ক্যানসার কোষগুলির চারপাশে হাইড্রোজেল ও ওষুধটির অবশিষ্টাংশ জমে রয়েছে। ক্যানসার কোষগুলির ৭৫ শতাংশ ধ্বংস হয়েছে।
হাইড্রোজেল থেরাপি নিয়ে গবেষণা ২০১৯ সাল থেকে শুরু হয়। এখনও গবেষণাটি চলছে। গবেষকেরা জানিয়েছেন, আরও অনেকগুলি স্তরেই গবেষণা হবে। হাইড্রোজেলের ‘পেটেন্ট’ পাওয়া গিয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার কাছে তা পাঠানোও হয়েছে। আইআইটি গুয়াহাটি ও বোস ইনস্টিটিউটের অনুমতিসাপেক্ষে বাণিজ্যিক ভাবে তাঁরা এই নিয়ে কাজও করতে পারেন। এর পরের ধাপ হল মানুষের শরীরে পরীক্ষা করে দেখা। তার জন্য নানা জায়গায় আবেদন করতে হয়। সে কাজ চলছে। যদিও তা সময়সাপেক্ষ, তবুও আশাবাদী গবেষকেরা। আগামী দিনে ওষুধটি সাধারণের নাগালে এলে, তা কম খরচে বহু জনের প্রাণ বাঁচাতে পারে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন গবেষকেরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy