আপনার এই সমস্যা হচ্ছে না তো? ছবি: শাটারস্টক।
শরীরের যে কোনও অঙ্গেই ব্যথাবেদনা স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন ঘটায়। সে পিঠ-কোমর টনটনিয়ে উঠুক বা ঘাড়ে-কাঁধে বিদ্যুতের শক লাগার মতো ব্যথা— যার হয়, সে-ই তার মর্ম বোঝে। শরীরের পেশি আর হাড় যদি একই সঙ্গে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেয়, তখন মনে মনে ‘এ ব্যথা কী যে ব্যথা’ বলে হাহাকার করা ছাড়া আর উপায় থাকে না। ব্যথাবেদনাও বিভিন্ন প্রকার। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাদের নাম, ধরন, প্রকৃতিও ভিন্ন ভিন্ন। তার মধ্যেই একটি হল ‘ডেড বাট সিনড্রোম’। নাম শুনলে ব্যথাজনিত অসুখ বলে মনেই হবে না। মূলত নিতম্বের পেশির অসাড়তা। শুরুতে যন্ত্রণা হয়, তার পর পেশির সাড়ই চলে যায়। মনেই হবে ওই অংশের পেশিই মৃত। তাই হয়তো নামই এই রকম।
‘ডেড বাট সিনড্রোম’ যে জনে জনে হয়, তা নয়। মূলত শহুরে লোকজনের এই অবস্থা বেশি হয়। একটানা বসে কাজ করে নিতম্বে নিদারুণ যন্ত্রণা এবং শেষে ওই অংশ ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যাওয়া। তখন উঠতে-বসতে গেলে পেশিতে টান, খিঁচ ধরে যাওয়া অথবা বসতেই না পারার মতো সমস্যা দেখা দেবে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক জটিল রোগেরই চিকিৎসা বেরিয়ে গিয়েছে। আংশিক অসাড় করে অস্ত্রোপচার থেকে শুরু করে, স্নায়ুর পথ রোধ করে ব্যথার বোধ রুখে দেওয়া, সব প্রকরণই এখন চিকিৎসকদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু ‘ডেড বাট সিনড্রোম’ অত সহজে সারার নয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, নিতম্বের ব্যথা একা আসে না। আরও নানা ব্যথার সঙ্গে আসে অথবা তাদের নিমন্ত্রণ করে আনে। সেটা কী রকম?
নিতম্বের পেশি বড্ড স্পর্শকাতর
নিতম্বের তিন রকম পেশি আছে, যারা কিন্তু ভীষণ স্পর্শকাতর। আনন্দবাজার অনলাইনকে এই বিষয়ে বুঝিয়ে বললেন দুর্গাপুরের সরকারি হাসপাতালের অস্থিরোগ চিকিৎসক প্রবীরকুমার দত্ত। তাঁর কথায়, “নিতম্বের সবচেয়ে বড় পেশি গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস যার কাজ ধারণ করে থাকা। এর পরেই থাকে গ্লুটিয়াস মিডিয়াস যা অনেক প্রশস্ত ও ঘন। মিডিয়াসের নীচের দিকে থাকে সবচেয়ে ছোট পেশি গ্লুটিয়াস মিনিমাস। এরা একটা নির্দিষ্ট সজ্জায় থাকে। যদি তাদের গঠন ও সাজসজ্জা নষ্ট হয়, তখনই নিতম্বে যন্ত্রণা শুরু হয়। তিন পেশি তাদের কার্যক্ষমতা হারাতেআগ
গ্লুটিয়াম ম্যাক্সিমাস হল নিতম্বের হর্তাকর্তা। প্রবীরবাবু বোঝাচ্ছেন, চতুর্ভুজ আকারের এই পেশিই নিতম্বের গঠন তৈরি করে। তার উপর প্রলেপ দেয় হল গ্লুটিয়াস মিডিয়াস। গোটা পেলভিস অঞ্চলকে ঠিক ভাবে রাখা ও ভার বহনে বিশেষ ভূমিকা আছে এদের। গাড়িতে যেমন ‘শক অবজ়ার্ভার’ থাকে, এরাও তেমনই নিতম্ব অঞ্চলের ‘শক অবজ়ার্ভার’। যত ঝড়ঝাপ্টা এদের উপর দিয়েই যায়। নিতম্ব ও পেলভিস অংশকে সোজা রাখাও এদের কাজ। পেশির গঠনই এমন, যা সোজা হয়ে দাঁড়াতে, হাঁটাচলা করতে সাহায্য করে। এখন যদি কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে, তা হলে এই দুই পেশিকে ভাঁজ হয়ে থাকতে হবে, যা তাদের স্বভাববিরুদ্ধ। তখনই তার বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। ভাঁজ হয়ে থাকতে থাকতে একটা সময়ে পেশির সক্রিয়তা কমতে থাকবে। তার সঙ্কোচন-প্রসারণের ক্ষমতাও কমে যাবে। তখন পেশি অসাড় হতে শুরু করবে। মনে হবে, ওই অংশে যেন আর সাড় নেই। ‘ডেড বাট সিনড্রোম’-এর ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়। আর আরও একটি নাম হল ‘গ্লুটিয়াস মেডিয়াস টেন্ডিনোসিস’।
কুঁড়েমি করেছ কি মরেছ!
এক বার বসলে আর উঠতে ইচ্ছে করে না যাঁদের, তাঁদেরই নিতম্বের ‘মৃত্যু’ হয়। শুনতে হাস্যকর হলেও সত্যি। এমনটাই মত বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের অস্থিরোগের চিকিৎসক বুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়। বললেন, “পা-কোমর বা ঘাড়ে ব্যথা নিয়ে অনেক রোগীই আসেন। ইদানীং কালে নিতম্বের অসাড়তা নিয়েও রোগীরা আসছেন। সব ক্ষেত্রেই কারণ প্রায় এক, একটানা বসে কাজ। স্ক্রিনটাইম যত বেশি, ততই ব্যথাবেদনার উৎপাত বেশি। যত বেশি বসে থাকবেন, ততই পেশির শক্তি কমবে। তখন এই ধরনের রোগভোগে দুর্ভোগ বাড়বে।”
আইটি কর্মী, ব্যাঙ্কে দীর্ঘ ক্ষণ বসে কাজ করেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কম্পিউটারে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের এমন ব্যথা হতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, টানা বসে বসে বিড়ি বাঁধছেন, তাঁত বুনছেন এমন মানুষজনেরও এই ব্যথা হতে পারে। এমনটাই জানালেন প্রবীরবাবু। ‘উইভার্স বটম সিনড্রোম’ নামের রোগটির এই কারণেই এমন নাম। সে ক্ষেত্রেও গ্লুটিয়াস ম্যাক্সিমাস পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপসর্গও অনেকটাই ‘ডেড বাট সিনড্রোম’-এর মতো। অনেক সময় তো দু’রকম ব্যথা একই সঙ্গে হতে পারে।
জগাখিচুড়ি জটপাকানো ব্যথা
স্নায়ু আর পেশির ব্যথা জটপাকিয়ে যায় অনেক সময়েই। সিউড়ি সদর হাসপাতালের অস্থিরোগ চিকিৎসক সু্ব্রত গড়াই জানাচ্ছেন, পায়ের ব্যথায় ভুগছেন যিনি, তাঁর কিছু দিন পরে নিতম্বের ব্যথাও হতে পারে। পিঠ-কোমর থেকে ব্যথা নিতম্বে নামতে পারে। সায়াটিকা ব্যথার কারণেও নিতম্বের পেশিতে টান ধরতে পারে। সায়াটিকা আমাদের শরীরের দীর্ঘতম ও সবচেয়ে মোটা স্নায়ু। যা শুরু হয় মেরুদণ্ড থেকে। এর একাধিক রুটের মধ্যে কিছুটা থাকে কোমরের নীচের দিকে লাম্বার স্পাইনে। সেখানে আঘাত পেলেও এই ব্যথা হয়। সে জন্য এই সমস্যাকে ‘লাম্বোসায়াটিকা পেন’ বলা হয়। এর থেকেও নিতম্বে ব্যথা হতে পারে।
প্রবীরবাবুর নিতম্বের ব্যথাকে বলছেন ‘স্পেকট্রাম সিনড্রোম’। অর্থাৎ, নানা ব্যথার মিশ্রণ। ‘গ্লুটিয়াল টেন্ডিনোপ্যাথি’, ‘পিরিফর্মিস সিনড্রোম’, ‘উইভার্স বটম সিনড্রোম’— সবই দেখতে গেলে নিতম্ব বা পশ্চাৎদেশের ব্যথা যা পা অবধি নেমে যায়। তাই কোন ব্যথা কী কারণে হচ্ছে, তা ধরা খুব মুশকিল। যেমন, গ্লুটিয়াল টেন্ডিনোপ্যাথির ক্ষেত্রেও কিন্তু নিতম্বে খুব যন্ত্রণা হয় যা ঊরু হয়ে হাঁটুতে নামে। টেন্ডন অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টেন্ডন হল পেশিতন্তু যা খুব শক্ত ও দড়ির মতো দেখতে হয়। এর কাজ হল পেশিকে হাড়ের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখা। পেশির নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে এই তন্তুর মতো অংশ। যদি কোনও ভাবে এই তন্তুতে আঘাত লেগে সেটি ছিঁড়ে যায় বা ক্ষয়ে যায়, তখন পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। ‘গ্লুটিয়াল টেন্ডিনোপ্যাথি’ হলেও কিন্তু তার থেকে ‘ডেড বাট সিনড্রোম’ হতে পারে। তখন পেশিতে ব্যথা, জ্বালা ভাব থাকবে। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটাচলা করতে পারবেন না রোগী। খুঁড়িয়ে হাঁটতে হবে।
মৃত পেশি জাগবে কী ভাবে?
ঠিক সময়ে ওষুধ খেলে, ফিজিয়োথেরাপি করলে এই ব্যথা সারতে পারে। বুদ্ধদেববাবু বলছেন, কোন পর্যায়ে রোগী রয়েছেন, তা পরীক্ষা না করে সমাধান বলে দেওয়া যায় না। যদি এমন হয় যে যন্ত্রণা হতে হতে পুরো অবশ হয়ে যাচ্ছে, তখন কিন্তু সাধারণ ব্যথা কমানোর ওষুধে কাজ হবে না। তখন কিছু টেস্ট করতে হবে।
‘ট্রেনডেলেনবার্গ টেস্ট’ নামে একটি পরীক্ষা পদ্ধতি আছে, যা করলে নিতম্বের ব্যথার কারণ কিছুটা বোঝা যায়। প্রবীরবাবুর কথায়, “রোগীকে হাঁটতে বলা হয়। পিছন থেকে লক্ষ্য করা হয়, এক পা এগনোর পরে নিতম্ব যেমন টানটান থাকার কথা তেমন আছে কি না। যদি দেখা যায় নিতম্ব ঝুলে যাচ্ছে অথবা রোগী হাঁটতেই পারছেন না, তখন দেখা হয় কোন কোন পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেই মতো চিকিৎসা শুরু হয়।”
নিতম্বের পেশি সক্রিয় রাখতে হলে হাঁটাচলা, শরীরচর্চা নিয়ম করে করতে হবে। সুব্রতবাবুর পরামর্শ, মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসার চেষ্টা করবেন। একটানা বসে না থেকে মাঝেমাঝে হেঁটে আসবেন। সমস্যার সমাধান হয়ে যাওয়ার পরেও বসা ও শোওয়ার ভঙ্গি ঠিক রাখা জরুরি। চেয়ারে বসার সময়ে বা গাড়ি চালানোর সময়ে সিটে ছোট একটা বালিশ রাখা প্রয়োজন। শুধু নিরাময়ের পরে নয়, একটা বয়সের পর থেকে পেশি মজবুত রাখার জন্য কিছু ব্যায়াম করতেই হয়। নিতম্বের বেশ কিছু ব্যায়াম আছে যা অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের থেকে শিখে নিলে ভাল। তা ছাড়া বাড়িয়ে নিয়ম করে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ়, স্কোয়াট, স্ট্রেচিং করা যেতে পারে। পাশাপাশি অবশ্যই পুষ্টিকর ডায়েটের মাধ্যমে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জীবনযাপনে যত সংযম থাকবে ততই ব্যথা দ্রুত কমবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy