ঋত্বিক ঘটকের ‘কোমল গান্ধার’।
তিয়াত্তর বছর পুর্ণ হবার দ্বারপ্রান্তে আমরা, অর্থাৎ এই উপমহাদেশের দু’টি দেশ ভারত ও পাকিস্তান। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের বন্ধন ছিঁড়ে জন্ম হয়েছে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। তাও দেখতে দেখতে আটচল্লিশ বছর হয়ে গেল।
ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হবার উল্লাসের মধ্যে মেশানো কান্নাভেজা এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা— দেশভাগ। স্বাধীনতার প্রাক্কালেই ঘটে গিয়েছিল এই মর্মন্তুদ ঘটনা। বাংলা ও পাঞ্জাবে নেমে এল অতলান্ত বিষাদ। খুবই সঙ্গত ভাবে তার প্রভাব পড়ল শিল্পসাহিত্যে। যদিও নানা মহলে প্রায়শই অভিযোগ শোনা যায়, এত বড় একটা ঘটনার প্রভাব নাকি শিল্প সাহিত্যে সেই ভাবে পড়েনি। সেই বিতর্কে না গিয়ে এই উপমহাদেশে, অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নির্মিত সিনেমায় দেশভাগের প্রভাব কতখানি পড়ল তার ওপর আলোকপাত করাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
মুম্বই দিয়েই শুরু করা যাক। ১৯৪৭ থেকে ’৬২, এই পনেরো বছরে এখানে দু’হাজারের বেশি ছবি তৈরি হলেও এতে দেশভাগের ছায়া অতি অল্প। একমাত্র ব্যতিক্রম এম এল আনন্দ পরিচালিত বম্বে টকিজের ‘লাহোর’ ছবিটি। ১৯৪৯-এ নির্মিত এই ছবিতে চড়া সুরের মেলোড্রামার মোড়কে বার বার ফিরে এসেছে ফেলে আসা পশ্চিম পাকিস্তানের স্মৃতি। ছবির শুরুতেই বলিষ্ঠ এক পুরুষকণ্ঠের ভাষ্য: ‘আমি দিল্লি বা ইনদওর শহর দেখে মুগ্ধ হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু কোনও কারণেই এই শহর দুটো লাহৌরের মতো সুন্দর নয়। নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ (১৯৫১)–এর আগেই নির্মিত হয়েছে এই ছবি। কিন্তু সেকালের রোমান্টিক জুটি নার্গিস ও করণ দেওয়ান অভিনীত এই ছবি বম্বে ঘরানার মেলোড্রামার মোড়ক থেকে বেরোতে পারেনি। শুধু এই ছবি কেন, ‘নাস্তিক’, ‘ছলিয়া’, ‘ধরমপুত্র’, ‘ধুল কা ফুল’ থেকে হাল আমলের ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ বা ‘বীর জারা’ ছবির মূল বিষয় দেশভাগ নির্ভর হলেও সস্তা বিনোদনের উৎকট পরিবেশনায় এই ছবিগুলো দেশভাগের শিল্পসম্মত কোনও বার্তাই বহন করে না। তবে পরবর্তীকালে মুম্বইতে দেশভাগ নিয়ে বেশ কিছু অন্য রকম ছবি তৈরি হয়েছে। সেই আলোচনায় আমরা পরে আসব।
যাঁদের হাত ধরে পাওয়া এই স্বাধীনতা, তাঁদের সম্পর্কে এগুলো জানেন?
বিজয় রাজ পরিচালিত ‘ক্যায়া দিল্লি ক্যায়া লাহৌর’-এর একটি দৃশ্য।
আমরা জানি, ছায়াছবির নির্বাক যুগ থেকেই কলকাতার স্টুডিয়োপাড়া বেশ জমজমাট। পঞ্চাশের দশক থেকেই উত্তম-সুচিত্রা জুটির জয়জয়কার শুরু। সেই আপাত মোহিনী মেলোড্রামার ভুলভুলাইয়ার মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ ছবিটি। পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চিরকালের মতো নিরাশ্রয় হয়ে বাস্তুহারার দল কীভাবে শিয়ালদহ স্টেশনে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে, খিদের তাড়নায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে, – ‘ছিন্নমূল’ হল সেই অতলান্ত দুঃখের জীবন্ত দলিল। দেশভাগের চার বছরের মধ্যে এই ধরনের ছবির নির্মাণ ছিল প্রকৃতপক্ষে এক দুঃসাহসিক প্রয়াস। আসলে তখনও উদবাস্তু মানুষের ঢল আসছে গোটা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জুড়ে। তবে বাস্তবের ভিডিওগ্রাফি আর শিল্পের নির্মাণ এক ব্যাপার নয়। তাই ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়া এই ছবি থেকে আর কিছু প্রাপ্য নয়। সলিল সেনের ‘নতুন ইহুদি’ (১৯৫৩) কিংবা শান্তিপ্রিয় চট্টোপাধ্যায়ের ‘রিফিউজি’ (১৯৫৪) ছবির বিষয় দেশভাগ হলেও শেষ পর্যন্ত তা এক স্মৃতিমেদুর হতাশা। তাই দেশভাগ নিয়ে ছবির জন্য আমাদের আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হয়। বস্তুত ঋত্বিক ঘটকই এই বিষয়টাকে তাঁর তিন তিনটি ছবিতে অত্যন্ত শিল্পসম্মত ভাবে ফুটিয়ে তোলেন। তাঁর ‘কোমল গান্ধার’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’ সত্যি সত্যি তিনটি অনন্য নির্মাণ। ঋত্বিকের পরে বেশ কিছু ছবি তৈরি হয়েছে দেশভাগকে আধার করে। ‘বিপাশা’, ‘আলো আমার আলো’ ইত্যাদি ছবিতে আবছা ভাবে দেশভাগ প্রসঙ্গ এলেও সেগুলো শেষ পর্যন্ত বিনোদন বিতরণের কাছেই মাথা নোয়ায়। বরং রাজেন তরফদার তাঁর ‘পালঙ্ক’ ছবিতে দেশভাগের প্রসঙ্গটিকে চমৎকার ভাবে নিয়ে আসেন। তবে ইদানীংকালে নতুন করে দেশভাগকে কেন্দ্র করে ছবি তোলার এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গৌতম ঘোষের ‘শঙ্খচিল’, বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কাঁটাতার’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘তাহাদের কথা’, সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজকাহিনি’ কিংবা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিসর্জন’ ও ‘বিজয়া’ শুধু দর্শকনন্দিতই হয় না, শিল্পের শর্ত মেনে দেশভাগ নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে শাখায়। অতি সম্প্রতি লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মাটি’ ছবিটি নতুন করে দর্শককে আকর্ষণ করছে। নবীন চলচ্চিত্রকার সব্যসাচী দে ‘রেড রিবন’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেছেন যার কেন্দ্রমূলে আছে সীমান্ত এবং তার কাঁটাতার। সৌমিত্র দস্তিদারের মত প্রামাণ্য চিত্রনির্মাতা দেশভাগ নিয়ে ছবি করেছেন। এই প্রবণতা দেশভাগকে নতুন করে আমাদের ভাবতে সাহায্য করছে। নতুন প্রজন্মকে ভাবাচ্ছে এই অবিমৃষ্য সিদ্ধান্তের কুফল সম্পর্কে।
ছবি দেখে চিনতে পারবেন স্বাধীনতার এই কারিগরদের?
তানভীর মোকাম্মেল অতি সম্প্রতি নির্মাণ করেছেন ‘সীমান্তরেখা’ নামে একটি সুদীর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র।
মুম্বই চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কেননা যতই বাণিজ্যের ঘেরাটোপ থাকুক না কেন ওখানেই তৈরি হয়েছে ‘গরম হাওয়া’, ‘তমস’, ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’, ‘পিঞ্জর’, ‘ভাগ মিলখা ভাগ’, ‘দি আর্থ ১৯৪৭’, ‘গদ্দর এক প্রেমকথা’ সমেত অনেক ছবি। তৈরি হয়েছে পঞ্জাবি ভাষায় ‘জোইসা’, ‘সূত্রনাগ’, ‘নুরান’ ইত্যাদি ছবি। এস এম সথ্যুর ‘গরম হাওয়া’ অসাধারণ এক শিল্পসম্মত ছবি। অন্য দিকে শ্যাম বেনেগালের ‘মাম্মো’ আমাদের নিয়ে যায় শিল্পের এক অনন্য নান্দনিক জগতে। গোবিন্দ নিহালনির ‘তমস’ এক অসামান্য নির্মাণ। মুম্বইয়ে নির্মিত প্রায় এই সব ছবির বিষয় পঞ্জাবের দেশভাগ। তবে দক্ষিণী পরিচালক জি অরবিন্দন তাঁর ‘বাস্তুহারা’ ছবিটির বিষয় হিসেবে নিয়েছেন বঙ্গব্যবচ্ছেদের উদ্বাস্তুদের। ভারতীয় প্রযোজনা নয়, কিন্তু গুরিন্ডর চাড্ডা নামে এক অনাবাসী ভারতীয় ‘ভাইসরয় হাউস’ নামে একটি ফিচার ছবি করে রীতিমতো বিতর্কের মুখে পড়েন। তাঁর ছবির বিষয়ও দেশভাগ, দেশভাগের প্রাক সময়। ছবিতে নেহরু ও জিন্না, দু’জনেই ছবির চরিত্র হিসেবে এসেছেন। দেশভাগ নিয়ে দু’জনের মতভেদ এই ছবিতে স্পষ্ট, আর সেখানেই এই ছবিটা হয়ে উঠেছে বিতর্কিত। পাকিস্তান সরকার সে দেশে ছবিটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এরই অভিঘাতে তিনি বিবিসি-র হয়ে একটি প্রামাণ্য ছবি নির্মাণ করেছেন ‘ইন্ডিয়া’জ পার্টিশন– আ ফরগটন স্টোরি’ এই নামে। করেছেন বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে। অতি সম্প্রতি নির্মিত নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ আমাদের আবার নতুন করে দেশভাগ নিয়ে নানা প্রশ্নের সামনে নিয়ে এসেছে। মান্টোর মতো এক জন প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক মানুষকে তার যোগ্য নিরাপত্তা দিতে পারেনি স্বাধীন ভারতবর্ষ, এ লজ্জা অনপনেয়। ব্রিটিশ প্রযোজনায় নির্মিত রিচার্ড অ্যাটেনবরো আশির দশকে ‘গান্ধী’ ছবিটি তুলে নতুন করে আমাদের নানা প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়। পরোক্ষ ভাবে হলেও এই ছবিতে দেশভাগের প্রসঙ্গ এসেছে।
তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’।
বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের ইতিহাস সদ্য ষাট পেরিয়েছে। এই ভূখণ্ডে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে চলচ্চিত্র শিল্প মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান পর্বের পনেরো-ষোলো বছরে কয়েকটি শিল্পসম্মত ছবি তৈরি হলেও তাতে দেশভাগ আসেনি। স্বাধীনতার পরে গোটা সাতের দশক জুড়ে যে সব ছবি তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন আলমগির কবির। আর ছিলেন শেখ নিয়ামত আলি ও মহিউদ্দীন শাকের। তাঁদের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ ছিল এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস। এই ছবিতে ’৪৭-এর প্রেক্ষাপটে সাধারণ গ্রাম্য হতদরিদ্র মুসলমান সমাজের অবস্থানের চিত্র ধরা পড়েছে। তাই দেশভাগ এই ছবিতে এসেছে পটভূমি হিসেবে। নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে আমরা পাই তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’। বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত এই ছবি কেবল দর্শকনন্দিতই হয়নি, শিল্পের মানদণ্ডে ছবিটি বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। পূর্ববঙ্গের এক হিন্দু পরিবারের দেশত্যাগের এক করুণ কাহিনি পরিচালক অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। এই তানভীর মোকাম্মেলই অতি সম্প্রতি নির্মাণ করেছেন ‘সীমান্তরেখা’ নামে একটি সুদীর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র। দেশভাগের সত্তর বছর পরেও মানুষের মনে এর স্মৃতি কতখানি জুড়ে আছে, সীমান্তের ব্যবধান দুই বাংলার মানুষের মাঝে কতখানি প্রভাব ফেলেছে তারই শ্রমসাধ্য অনুসন্ধান করেছেন পরিচালক। দুই বাংলার সীমান্তের মানুষ কেবল নয়, সুদূর আন্দামান থেকে নৈনিতাল, মানা ক্যাম্প থেকে অসম ও ত্রিপুরার প্রত্যন্ত প্রদেশের দেশত্যাগী মানুষের মুখের কথা উঠে এসেছে এই ছবিতে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে ‘খাঁচা’ নামের দেশভাগনির্ভর আর একটি অসামান্য ছবি। হাসান আজিজুল হকের দুটি গল্প ‘খাঁচা’ এবং ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ অবলম্বনে এই ছবিটির নির্মাতা আকরাম খান।
নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ আমাদের আবার নতুন করে দেশভাগ নিয়ে নানা প্রশ্নের সামনে নিয়ে এসেছে।
১৯৫৯ সালে অখণ্ড পাকিস্তানে তৈরি হয়েছিল ‘কর্তার সিং’-এর মতো ছবি। তার পর দীর্ঘ অপেক্ষা। অনেক পরে তৈরি হয় ‘তেরি ইয়াদ’, ‘লাখো মে এক’ এবং ‘খামোশ পানি’র মতো ছবি। এর মধ্যে শেষোক্ত ছবিটিই বিশেষ ভাবে উল্লেখ করার মতো। ২০০৩ সালে নির্মিত এই ছবির পরিচালক সাবিহা সুমার এতে দেশভাগ সৃষ্ট ক্ষতিকর মৌলবাদের দিকে আমাদের চোখ ফেরান। ‘মান্টো’ নামে পাকিস্তানেও একটি ছবি তৈরি হয়েছিল কয়েক বছর আগে। স্বয়ং পরিচালক (সারমদ খুশাদ) মান্টোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
স্বাধীনতা তথা দেশভাগের এত বছর পরেও ছায়াছবিতে যে ভাবে দেশভাগ ফিরে ফিরে আসছে তা কি ওই দুঃসহ ঘটনার গুরুত্বকেই বহন করে না?
বন্ধু শ্যাম চাড্ডার একটি কথায় (‘যদি দেখি দাঙ্গা বাঁধাচ্ছে মুসলমানরা, তবে তাদের তো বটেই, তোমাকেও মেরে ফেলতে পারি’) মান্টো দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। রাগের বশে বলে ফেলা বন্ধুর এই সংলাপের মধ্যে মান্টো অনুভব করেছিলেন, এই উপমহাদেশে দীর্ঘলালিত কুশিক্ষার স্পষ্ট ছাপ। বন্ধু তাঁকে আটকাতে গিয়ে বলেছিলেন, তুমি আবার কীসের মুসলমান? মান্টো উত্তর দিয়েছিলেন, মুসলমান তো বটেই, অন্তত মেরে ফেলার মতো।
বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষিতে মান্টোর এই কথাটি যে কতখানি প্রাসঙ্গিক তা আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy