২২ নভেম্বর ২০২৪
একুশের সেরা ২১

চিলেকোঠা

জয়নারায়ণ সরকার
জয়নারায়ণ সরকার
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:০৫
Share: Save:

আজ বিকেলে হাঁটতে বার হননি ভূপেনবাবু। হাই প্রেশারের রোগী হওয়ায় সাবধানে থাকেন। আরও বেশি সাবধানতা নেন স্ত্রী সবিতা আর ছেলে সুমন্তের কথা ভেবে।

যে বাড়িতে ছোট থেকে বড় হয়েছেন, সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছিল সাংসারিক নানা অশান্তির হাত থেকে বাঁচতে। প্রথম প্রথম কিছু বুঝতে পারেননি। তিন ভাইয়ের মধ্যে ভূপেনবাবু সব থেকে ছোট। সেই কারণে বাড়ির কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে হয়নি। দাদারাও অবশ্য তাকে কিছু বুঝতে দিতেন না। সবিতা সংসারে আসার পর নানা ফাঁকফোকর ধরা পড়তে শুরু করে। এরই মধ্যে বড়দা আর মেজদা হাঁড়ি আলাদা করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। শেষমেশ আলাদা হতে হয় ভূপেনবাবুকে। একই বাড়িতে থেকে কেউ কারও মুখ দেখেন না। ভূপেনবাবুকে বড্ড আঘাত করে। বেসরকারি কোম্পানিতে সামান অ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরিতে ঠিক মতো সংসার চালানো দায় হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ছেলে সুমন্ত এসে পড়ে জীবনে। এ দিকে শহরে চাকরি করতে আসা-যাওয়ার ধকল দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এ সব কারণে সবিতা জোর করে রাজি করিয়েছিল অফিসের কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট কিনতে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভূপেনবাবু রাজি হয়েছিলেন। শহরের একটা স্কুলে ভর্তি করেছিলেন সুমন্তকে। এক কামরার ফ্ল্যাটটা ব্যাঙ্কের থেকে লোন নিয়ে কিনেছিলেন। সংসার, ব্যাঙ্কের লোন আর সুমন্তের পড়াশোনার খরচ জোগাতে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। সেই সময় সবিতা বাড়িতে এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়াতে শুরু করে। আস্তে আস্তে এলাকায় সবিতার সুনামও ছড়িয়ে পড়ে। অন্য দিকে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সুমন্তকেও পড়াত সবিতা। তবে ব্যাঙ্কের ইএমআইয়ের বেশির ভাগ টাকাটা আসত সবিতার টিউশনি থেকে।

এর পর থেকে এজমালি বাড়িতে আর ফিরে যাননি ভূপেনবাবু। তবে এখনও মনের ভেতর ওই বাড়িটা দাগ কেটে আছে। বিশেষ করে ওই চিলেকোঠার ঘরটা। দেখতে দেখতে সুমন্ত বড় হয়ে উঠল। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরি করে। এখন সবিতাকে আর টিউশনি করতে হয় না। ধীরে ধীরে সংসারের হতশ্রী ঢাকা পড়তে থাকে।

রবিবার সকালে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন ভূপেনবাবু। সামনের ছোট কাচের টেবিলে চা রেখে গিয়েছে সবিতা। মনোযোগ দিয়ে কাগজ পড়ছেন। কখন যে সুমন্ত এসে পাশে বসেছে খেয়াল করেননি। হঠাৎ খুব কাছ থেকে সুমন্তের গলা পেয়ে খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকান। বাবাকে ও ভাবে তাকাতে দেখে সুমন্ত বলে, ‘‘কাগজ পড়াতে ব্যাঘাত করলাম। কিন্তু একটা কথা তোমায় না বলে পারছি না। জানো বাবা, আমরা আর মাস দু’য়েক পরেই সোসাইটির ফ্ল্যাটে উঠে যাব। ওটার পঁচিশ তলায় থ্রি-বিএইচকে ফ্ল্যাট!’’

কথাগুলো শুনে অবাক হয়েছিলেন ভূপেনবাবু। এত দিন সোসাইটি বলতে আশপাশের অঞ্চলকে জানতেন। বড় জায়গাকে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে কয়েকটা আকাশছোঁয়া বিল্ডিং! তাকে কি বলে সোসাইটি! মনে মনে দেখার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে ওঠেন।

সুমন্ত আবার বলে, ‘‘আজ ডেভেলপার কোম্পানি থেকে ফোন করেছিল। কাজ কমপ্লিট হলেই পজেশন দিয়ে দেবে। একটা ব্রোশিয়ারও দিয়েছে। পরে তোমায় ওটা দিচ্ছি।’’

ভূপেনবাবু হাঁ করে শুনছিলেন ছেলের কথা। সারা মুখে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট! নিজের উদ্যোগে করছে জেনে ভাল লাগে তাঁর। এখনকার চার তলার এই ফ্ল্যাটটা চিরকালই ঘুপচি মনে হয় ভূপেনবাবুর। প্রাইভেট কোম্পানির সামান্য অ্যাকাউন্ট্যান্টের চাকরি আর সবিতার টিউশনির টাকায় এর বেশি আর কিছু করতে পারেননি।

স্ত্রী সবিতা বলেছিলেন, ‘‘হোক ঘুপচি! এখানে থেকেই তো ছেলে পড়াশোনা করে আজ ভাল চাকরি করছে!’’ ভূপেনবাবু আস্তে আস্তে সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়েছিলেন।

যখনই কোনও ফ্ল্যাটের কথা শোনেন, তখনই ভূপেনবাবুর বেড়ে ওঠা বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। সংসারের অবাঞ্ছিত জিনিসপত্রে ঠাসা ছিল সেই ঘর। সে ঘরে ঠিকমতো হাওয়া-বাতাসও খেলত না। অপরিষ্কার ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসপত্র সরিয়ে একটু জায়গা বার করে বন্ধুদের নিয়ে রঙিন দিনযাপন। ইংরেজি এ লেখা, তাকে ঘিরে থাকা গোল দাগ পোস্টার পকেটে ভাঁজ করে এনেছিল প্রদীপ্ত। ওই ঘরই তো প্রাপ্তবয়স্ক হতে শিখিয়েছে। প্রদীপ্তের ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের জেরে বিষাদে ভারি হয়ে উঠেছিল ঘর। সেই দিন প্রদীপ্তকে ঘিরে বন্ধুরা বসেছিল ওই ঘরে। মা কিছু একটা টের পেয়েছিলেন! অনেক ক্ষণ নীচে না নামাতে মা চিৎকার করে ডেকেছিল। মায়ের গলা পেয়ে নেমে এসেছিলেন ভূপেন। মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে মা বলেন, ‘‘কী হয়েছে তোদের?’’

ভূপেনের বুকটা কেঁপে উঠেছিল। মা জেনে গেলে রাতে বাবার হাতে নির্ঘাত মার জুটবে। হালকা হেসে বলেছিলেন, ‘‘কই, কিছু হয়নি তো! আমরা চাকরির পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করছি।’’ চাকরির পরীক্ষার কথা শুনে মায়ের উৎকণ্ঠা ভরা মুখে মৃদু হাসি খেলে গেল। আর কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।

ছুটির দিনগুলোতে দাদাদের চোখ এড়িয়ে উঠে যেতেন ওই ঘরে। বন্ধুরাও এসে জুটত একে একে। দাদাদের অবশ্য ওই ঘর নিয়ে কোনও কৌতূহল দেখেননি ভূপেনবাবু।

সবার চোখের আড়ালে গোপনীয় কাজের গর্ভগৃহ ছিল ওই ঘর। বাড়িতে সে দিন কেউ ছিল না। সকালেই মা আর বাবা মাসির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন। রাতে ফিরবেন। দুই দাদা গিয়েছে খেলতে। সকাল একটু গড়াতেই একে একে বন্ধুরা এসে হাজির হয় ওই চিলেকোঠা ঘরে।

আড্ডা জমে ওঠার বেশ কিছু ক্ষণ পরে এসে হাজির হয় বিশু। পুরনো খবরের কাগজের ঢিবির উপর বসে বিশু পকেট থেকে রঙিন কাগজের প্যাকেট বার করতেই চমকে ওঠে সবাই! সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই! হাত ঘুরে ঘুরে জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে চেপে টান... সেই শুরু...

***

ঝাঁ-চকচকে পঁচিশ তলার ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে চুপচাপ থাকেন ভূপেনবাবু। ফ্ল্যাটে আসামাত্র বাড়ির সেই চিলেকোঠার ঘরটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চিলেকোঠার ঘরের থেকে বহু গুণ উঁচুতে হলেও সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটের কোথাও ও রকম ঘরের হদিস নেই। ফ্ল্যাটে ঢুকেই যে ঘরটা, সেটা ড্রয়িংরুম। বইয়ের আলমারি, শ্বেতপাথরের নারীমূর্তি, দেওয়ালে ঝোলানো বিভিন্ন নামকরা চিত্রশিল্পীদের পোর্ট্রেট। কখনও যদি সুমন্তের বন্ধুরা আসে, তখন এই আলো ঝলমলে ঘরে বসে আড্ডা দেয়। ঘরের দুই দিকে বড় বড় জানলা। আলো-বাতাসের অভাব নেই! কিন্তু একটা অভাবের আঁচ পান ভূপেনবাবু। সমস্ত কিছুই খোলামেলা। গোপনীয়তার কোনও স্থান নেই এখানে। ধরা পড়ার যে রোমাঞ্চ সারা বুকে খেলা করে, সেই রোমাঞ্চের শিহরন থেকে সুমন্তেরা চিরকাল বঞ্চিত থেকে গেল।

সুমন্ত হঠাৎ বলে, ‘‘বাবার মনে হয় পছন্দ হয়নি।’’

সুমন্তের কথায় ভূপেনবাবুর চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মাথা নেড়েছিলেন। তবে ভূপেনবাবুর ফেলে আসা অপরিষ্কার চিলেকোঠার ঘরটা ফিরে পেতে বড্ড ইচ্ছে করছে। নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন। বাবার মনের অবস্থা বুঝতে পারে সুমন্ত। দক্ষিণের হাওয়া যেখানে ঝাপটা মারছে, সেই খোলামেলা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায় দুজনে। ভূপেনবাবুর তবুও বড্ড অস্থির লাগে। সুমন্ত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy