কাগজটাতে কী লেখা আছে! সুধাময় পড়বার চেষ্টা করেন। নাহ্, কিছুতেই শব্দগুলো উচ্চারণ করা যাচ্ছে না। কাগজটাকে ছোট করে ভাঁজ করে পকেটে রাখলেন। ‘‘আজ ‘টুনির মা’ একটা মাছরাঙা মেরেছে, তোমরা এত লাই দাও ওটাকে… দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠছে।” সাধনা বেশ চিৎকার করে বকছেন। সুধাকর ‘টুনির মা’র দিকে খানিক তাকিয়ে থাকেন। নাতি বিরজু ‘টুনির মা’কে কোলে নিয়ে ছদ্ম রাগ দেখায়। খানিক আদর করে মাটিতে ছেড়ে দেয়। ‘টুনির মা’ থাবা চাটে। মাছরাঙা কেমন দেখতে সুধাময় মনে করতে পারেন না। ভোরবেলা শিস দিচ্ছিল একটা পাখি, তার কী নাম? আচ্ছা যদি এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া যায়, তা হলে কি সেই মুচিটাকে মোড়ের মাথায় দেখা যাবে? কী যেন নাম তার! সাধনা কি খুব বকবে, যদি মুচির নামটা জিজ্ঞেস করা হয়? মুচি ঘাড় গুঁজে কাজ করে। আচ্ছা, যে গাছটার জন্যে ব্লক অফিসটা দেখা যায় না ওই গাছটার নাম কী? কী সুন্দর ফুল হত! ওটার নাম জিজ্ঞেস করতে হবে। চোখে ঘুম নামে সুধাময়ের। চেয়ারে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে ঘুমোতে থাকেন। সাধনা আবার বকে ওঠেন, “যাও, বিছানায় যাও। বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমাও। ঘাড় ব্যথা হবে।’’
মুখ তোলেন সুধাকর। খুব ধীরে সাধনাকে বলেন, “তুমি জানো, আমি সেতার বাজাতাম।”
সাধনা বিরক্ত হয়ে যান, চিৎকার করে বলেন, “আমি জানি না! সংসার তখন কে করছিল তোমার সঙ্গে… কে দেখেছে তোমার ছেলেপুলেদের… কে বাজার-দোকান-ওষুধ, এই সব করেছে! নিজে সব ভুলে গেল… চিরকালের স্বার্থপর। সব ভুলে গেলেই হয়ে গেল। জীবনে কখনও কোনও দায়িত্ব নিলে না তুমি…”
আরও অনেক কথা দুঃখ করে বলতে থাকেন সাধনা। ভুলে যাওয়ার রোগে কিছু মনে রাখতে পারেন না সুধাময়। তাঁর খুব কাছের কিছু মানুষ বহু বার খুব খারাপ ব্যবহার করেছে সেটা মনে রাখেননি। তিনি তাদের সঙ্গে এমন ভাবে ব্যবহার করেছেন যে, তারা ভেবেছে তারা ঠিক কাজ করেছে। যার ফলস্বরূপ সাধনা আর তার সন্তানদের সেই এক ভাবে পুনরায় অপমানিত হতে হয়েছে। সুধাময় সেই তাপ-উত্তাপের কিছুই বুঝতে পারেননি। আজকাল সব কিছুই কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া। নাতি তাঁর বিছানায় পড়ার বই, রংপেন্সিল, পেন ফেলে রেখে খেলতে চলে গিয়েছে। তাই দেখে আজকে খুব লিখতে ইচ্ছা করল তাঁর। সুধাময়ের নাতির খাতায় পেন্সিল দিয়ে লিখতে ইচ্ছা করে। গ্রামের নন্দী খুড়ো দোয়াতে খাগ ডুবিয়ে লিখত। আচ্ছা, খাগের কলম পাওয়া যায়। কিংবা সুলেখা কালির পেন। ঝর্না কলম। ফুরফুর করে লিখতেন তখন। এখন আর লেখা যাবে। পেন চাইবেন সাধনার কাছে। পেন দিয়ে কিছু লিখবেন। একটা ডট পেন আছে টেবিলে। পকেটে কাগজটা আছে। টেবিলে পুরনো ডায়েরি আছে। সেটাতেই লিখবেন। ঘুম এসে যায় এ সব ভাবতে ভাবতে। মুখ হাঁ করে ঘুমিয়ে যান। স্নান করবার জন্যে আয়া মেয়েটি মৃদু স্বরে ডাকে। স্নানের টুলে বসে মনে করবার চেষ্টা করেন কী যেন একটা কাজ করবেন ভাবছিলেন। কী কাজ? অন্য দিন যা করেন তার চেয়ে আলাদা একটা কাজ। খাওয়া শেষ হল। বহু দিন পর কেবল তার মনে হচ্ছে, কী যেন একটা কাজ করবেন। খাওয়ার পর স্মৃতি সচল রাখার জন্যে জিজ্ঞাসা করা হয় কী কী খেয়েছেন? কোনও দিন পারেন, কোনও দিন পারেন না। আজ কাতলা মাছ আর মুগের ডাল বলতে পেরেছেন। অন্য দিন বিকেলে চা, খাবার সময় সুধাময় জানালা লাগানোর জন্যে উৎপাত করেন। জানালা বন্ধ করার কথা না বলে সুধাময় সাধনাকে বললেন, “দুপুরে আমার একটা কী কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল বলো তো?”
সাধনা টিভি দেখতে দেখতে হেসে ফেলে বললেন, “আমি কী করে বুঝব বলো তো তোমার কী করতে ইচ্ছে করছিল। তুমি তো আমাকে জানাওনি।”
ব্যাপারটা নিয়ে ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি, আয়া সবার মধ্যেই একটা হাসির উদ্যাপন হল। সুধাময় অন্যদের হাসি দেখে মুখে একটা মিষ্টি হাসি নিয়ে বসে রইলেন। কিন্তু কী একটা কাজ করবেন ভেবেছিলেন। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল। রাতের আয়া চলে এল। তার গায়ে একটা বিশেষ গন্ধ আছে। সেই গন্ধটা ভাল লাগে না। কিন্তু এর কণ্ঠস্বরটা মৃদু। হাতের তালুটাও খসখসে নয়। রাতে গভীর ঘুম হয় না সুধাময়ের। বারে বারে উঠে বাথরুমে যেতে হয়। আয়া জেগে ফোন দেখে। রাতে বিছানায় অন্য দিনের মতো কিছুক্ষণ বসে রইলেন সুধাময়। তাঁর মনে পড়েছে, ওই যে ডায়েরি। লিখবেন কিছু। “এই মেয়ে, আলো জ্বালো তো। টেবিলের ওপর ওই ডায়েরি আছে ওটা দাও।” আয়া মেয়েটির নাম তপতী। এর আগে এক দিন ভোর তিনটের সময় তাকে ভৈরবী আর সুহাগি তোড়ি শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। সে হেসে বলে, “কী করবেন দাদু, গান করবেন?”
“না, না।” তীব্র প্রতিবাদ করেন সুধাময়। ডায়েরি আর ডটপেন নিয়ে লিখতে বসলেন সুধাময়।
সাধনা সকালের ওষুধ, কুসুম গরম জল নিয়ে মশারির কাছে এসে দেখলেন ডায়েরি খুলে রেখে সুধাময় পাশ ফিরে গভীর ঘুমোচ্ছেন। ডায়েরির পাতায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে বেশ কিছু পাখির নাম, কিছু সরগম, দশ বছর আগে মরে যাওয়া কাজের লোকের নাম, পুরনো শহর, জন্মস্থানের নাম আর সব শেষে ‘সাধনা’ লিখে তার চারপাশে বেশ কয়েক বার গোল করে রেখেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy