নবকৃষ্ণের ছানার পায়েস
দোল এলেই বড়বাজারের রমেশকুমার অগ্রবালের কথা মনে পড়ে যায় আমার। বড়বাজারের কটন স্ট্রিটে ‘লেংড়া শরাফ ঘণ্টেওয়ালা’র দোকানের ম্যানেজার। প্রায় এক দশক আগে নিষিদ্ধ রোম্যান্সের হাতছানিতে বুঁদ এক ভিতু যুবককে যিনি অভিভাবকসুলভ ভঙ্গিতে বকে-ঝকে দূর করে দিয়েছিলেন।
ঠান্ডাইয়ের দোকানে কিঞ্চিৎ সিদ্ধির কামনা নিয়ে হাজির হয়েই এমন দাবড়ানি খেতে হল! আনাড়ি তরুণকে কিছুতে এ লাইনে দীক্ষা দেবেন না তিনি। বেজায় রেগেমেগে ভদ্রলোকের সেই ডায়ালগ ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো। অগ্রবালমশাই বলেছিলেন, “এ আপনাদের শরাব নয়। ইয়ে শঙ্কর ভগবান কি চিজ হ্যায়। শরাব লুটাতা হ্যায়, ভাং উড়াতা হ্যায়!’’
সিদ্ধির এমন খাপে খাপ সংজ্ঞা আর কোথাও শুনিনি। হিট বলিউডি গানায় খোদ বিগ বি ঠোঁট মিলিয়েছিলেন, ‘ভাং কা রং জমা হো চকাচক, ফির লো পান চবায়ে/ অ্যাইসা ঝটকা লাগে জিয়া পর পুনরজনম হোই জায়ে।’ কিন্তু অগ্রবালের বিশ্লেষণকেই এগিয়ে রাখব। অভিজ্ঞতাটা এমন অনায়াসে কিন্তু নিখুঁত ভাবে আর কেউ বুঝিয়ে দিতে পারেননি।
এক দশক আগের সেই বড়বাজার-কটন স্ট্রিটে এমন বীরপুঙ্গবদের দেখা যেত, ফি-সন্ধেয় পানশালায় স্বাস্থ্যপান করার ঢঙে কালচে সবুজ সিদ্ধিবাটার শরবত কাচের গেলাসে ভরে খাচ্ছেন। সিদ্ধির সবুজরঙা লাড্ডু বা মাজুনও দিব্যি জনপ্রিয় ছিল। আর বেশির ভাগ রসিকের জন্য থাকত, ঠান্ডাইয়ের শরবত। অভিজ্ঞ শরবত কারবারিরা জানতেন, দুধ-বাদামাদি সহযোগে মশলাদার শরবতে ঠিক সহনীয় মাত্রায় আসল জিনিসটি ‘পাঞ্চ’ করতে। রমেশ অগ্রবাল ঠান্ডাইয়ে সিদ্ধি মেশাতে প্রত্যাখ্যান করলেও তাঁর পড়শি দোকানদার প্রেমশঙ্কর সিংহ ফিরিয়ে দেননি।
খিদে চাগিয়ে তোলা এমন শরবত বাস্তবিক কমই আছে। কিন্তু কখন তার ওড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে, বলা মুশকিল। মদ্যপান করে যত সহজে খানিকটা ‘তালে ঠিক’ থেকে প্রগলভ হওয়া যায়, শিবলোকের ব্র্যান্ডেড পানীয় সিদ্ধির ক্ষেত্রে ততটা স্পর্ধা না দেখানোই ভাল।
বলরামের ঠান্ডাই
আজকের বড়বাজারে ভাঙের ঠেকের চেহারাটা দেখলে অবশ্য কিছুটা মন-খারাপই হয়। মাঝে ভাঙের ঠেকগুলো প্রায় উবেই গিয়েছিল। এখন তা আছে, তবে অনেকটাই চোরাগোপ্তা। এবং এ তরল ভাঙ বলেই একটু বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণও বাদ দিতে পারছি না। খুব বিশ্বস্ত ‘গাইড’ ছাড়া সিদ্ধিলাভের চেষ্টা খানিকটা বিপজ্জনক।
তবু এই দোল বরাবরই ঈষৎ স্খলিত বা বেলাগাম হওয়ার লাইসেন্স দেয়। গোবলয়ের বাসিন্দা, গোটা শ্রাবণ মাস বিশুদ্ধ শাকাহারী ঈশ্বরবিশ্বাসীদেরও দেখেছি, হোলি উপলক্ষে দিন চার-পাঁচ ছুটি নিয়ে উদ্দাম হওয়ার ছাড়পত্র জাহির করতে। সিলসিলায় অমিতাভ-রেখার পরকীয়াও তো দোলেই ঘটেছিল।
কলকাতার সাবেক বনেদি বাড়িতেও দোলের সৌজন্যে নানা ধরনের দেওয়াল ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। মানে, অন্য দিনে লোকের যা সচরাচর একা বা সমবয়সীদের সান্নিধ্যে করার রেওয়াজ ছিল, দোল সেই আড়াল ভেঙে দেয়। শোভাবাজার রাজবাড়ির বিখ্যাত ‘টিপসি পুডিং’ও যেমন দোলকে আলাদা মাত্রা দিত।
এই পুডিংয়ে স্পঞ্জ কেকের ফালির মধ্যে ঘন ক্ষীর, ভ্যানিলা, ডিমের হলুদ ঠেসে উপরে ডিমের সাদার ফেনায়িত মুকুট পরিয়ে দেওয়া হত। তবে এই টিপসি পুডিং-এর নামমহিমা নেহাতই নামমাত্র নয়। পুডিং-এর গোলায় রাম বা ওয়াইন মেশানোও রীতি। রাজবাড়ির অন্যতম অভিভাবক অলককৃষ্ণ দেবের কাছে শুনেছি, দোলে এই ‘মেশানো’র পরিমাণটা একটু বেশিই ঘটত। এ বাড়ির দোলের শুরু দোলেরও আগে। চাঁচর বা ন্যাড়া পোড়ানোর সন্ধেয়। রঙিন সুগন্ধী ফাগ ছড়িয়ে দাউদাউ আগুনের সামনে পারিবারিক রীতি মেনে ঠাকুরবাড়ির উঠোনে শুধু কি সবাই মিলে গানই হবে, ‘লাল নিধুবন লাল শ্যামধন, লালে লাল আজি প্যারী’?
অলকবাবু বললেন, “শুধু গানে কী চিঁড়ে ভেজে কখনও!” তিনি নিজে বরাবরই ও রসে বঞ্চিত। তবে দাদা-কাকারা টিপসি পুডিং-নির্মাণ পর্বেই রাঁধুনিকে কড়া নির্দেশ দিতেন, পুডিং কিন্তু এমন হবে, যাতে হেঁটে বাড়ি ফিরতে না পারি! এই ফুরফুরে মনটাই দোলের মূল সুর বেঁধে দিত।
বড়-বাড়িতে দোলের হাজারো নিয়ম। শোভাবাজার রাজবাড়িতে গোপীনাথজি তাঁর গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে ঠাকুরদালানে এসে বসবেন। ১০৮ ঘটি জলে স্নান সেরে দই, দুধ, ডাবের জলে অভিষেকের পরে সিংহাসন সাজিয়ে রাজবেশে সাজবেন। কিন্তু, এ দোল নিছকই বৃন্দাবন-লীলার ভক্তিভরা উদযাপন কখনওই নয়।
প্যানথেরাস
‘এক্সক্লুসিভ কুক’ চাটগাঁই মগ অন্নদার হাতের ছোঁয়া ছাড়া দোল কখনও দোল বলে মনে হবে না। তখন চাঁচরের মেনুতে টিপসি পুডিং-পর্বের আগে আরও নানা ধরনের ‘ম্লেচ্ছ পদ’ রাঁধতেন অন্নদা। এর মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য প্যানথেরাস ও ক্রিম কাটলেট। মাংসের পুরু খামের মতো ডিপফ্রায়েড পাটিসাপ্টা প্যানথেরাস এখন সুন্দরবনের বাঘের মতোই বিপন্ন। আর ক্রিম কাটলেট হল, মেওনিজ ঠাসা উৎকৃষ্ট মাংসের কাটলেট— যা বাগবাজারের ঘাটের ইলিশের মতোই স্মৃতি।
এ কালে শোভাবাজার রাজবাড়িতে পর পর দু’দিন চাঁচরের মজলিস, সদলে দোল সব অটুট থাকলেও মেনুতে শুধু লুচি-মাংস। আর সুরাপান নিয়ে মধ্যবিত্ত সংস্কার উবে যাওয়ার দিনে টিপসি পুডিং-এর নিষিদ্ধ আমেজও খানিকটা ফিকে।
বড়-বাড়ির চৌহদ্দি পেরিয়ে বাজার, দোকানে ঢুঁ মারলেও সে কালের দোলকে ছোঁয়া সহজে ঘটে না। মার্বেল প্যালেসের মল্লিকবাড়ির কর্তা হীরেন মল্লিক মঠ-ফুটকড়াইয়ের মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছিলেন। “গরিব বন্ধু সুদামার কুণ্ঠা দূর করে তাঁর দেওয়া সামান্য চিঁড়ে মুখে দিয়ে কৃষ্ণ তা অসামান্য করে তুলেছিলেন। মঠ-ফুটকড়াইয়ের বৈচিত্র্যেও আদতে চিনির চেনা স্বাদকে অসামান্য করে তোলার ভাব।”
ঠান্ডাই সন্দেশ দিলবাহার রং দে বাসন্তী চন্দ্রকলা
‘ক্যারামেল পপকর্ন’-এর টাবে আকছার হাত ঢোকাতে অভ্যস্ত আজকের ঘন-ঘন মাল্টিপ্লেক্সগামী একেলেও কি পারতেন এ ভাবে ভাবতে? জানি না! তবু মার্বেল প্যালেসের নারকেলের মোড়কে ভরা চিনির ডেলা রসকরার কথা শুনলে কেমন রোমাঞ্চ হয়। গুড়ের রসকরাও হয় অবশ্য। ছোট আলুর পুরভরা যত্নের পাতলা খোলের শিঙাড়াই হোক বা রাধাকান্ত-গোপীচাঁদ বল্লভদের গুরুত্বপূর্ণ পথ্যি গোলমরিচ-মৌরি বিশিষ্ট মালপো— এ সব আমজনতা কোথায় পাবে। শুনলেও বাঙালিকে নিজভূমে পরবাসী মনে হয়।
ভবানীপুরে বলরাম ময়রার দোকানে দোল মানে, এখন ঠান্ডাইয়ের সন্দেশ। ১০-১২ রকমের মশলা মেশানো স্বাদু। ক্ষীরের পুরঠাসা দুর্দান্ত স্পেশাল গুলাবজামুন, তিনরঙা রং দে বাসন্তী, সরভাজা, মালপোও আছে বটে। তবু কোনও অতীতই তো আর অবিকল ফিরে আসে না!
বৌবাজারের নবকৃষ্ণ গুঁইয়ের হাতেও বেঁচে আছে সাবেক কলকাতার দোলের এক মধুর ট্র্যাডিশন। ঘিপোয়া। ওড়িশার ঘি-পিঠার প্রেরণায় এই সৃষ্টির চর্চা গত আট দশক ধরে কলকাতায় চালিয়ে আসছে নব গুঁই। কামিনী চালের গুঁড়ি বা সবেদা, আখের গুড় ও আরও কিছু মশলাযোগে এক ধরনের ডিপফ্রায়েড পিঠে। এই গ্লোবালাইজেশনের যুগেও বৌবাজারের বেনেপাড়া দোলের সময়টা রাত্তিরে গোটা কতক ঘিপোয়া মেরে ঢকঢকিয়ে জল খেয়ে শুয়ে পড়ে! আর কিছু লাগে না। সন্দেশের ছানার পায়েস আর মালপোতেও নব গুঁই করিতকর্মা।
ঘিপোয়া মালপোয়া
গড়পরতা বাঙালির কাছে দোল ভোল পাল্টে ক্রমশ হোলি হয়ে উঠছে। তাই চন্দ্রকলা বা গুজিয়ার মানেটাও গিয়েছে পাল্টে। গুজিয়া আর সেই চিনি-ক্ষীরের আংটার মতো খুদে খুদে মিষ্টি নয়। বরং গোলাকার পেটমোটা এক ভাজা মিষ্টি। মোটা ময়দার খোলের মধ্যে ক্ষীর-নারকোল গোছের পুর ভরে কাজু-পেস্তার গয়নায় সাজিয়ে দেওয়াটাই দস্তুর। বলরাম এখন কলকাতার অবাঙালির মিষ্টির কারবারিদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে গুজিয়া সৃষ্টিতে দড় হয়ে উঠেছে।
গুছিয়ে ভূত হয়ে দোল খেলার পরে এ সব চড়া মিষ্টি খেতে বেশ। কিন্তু গুজিয়ারও যে একটা বাঙালি নাম ছিল, তা ভুলেই গিয়েছি আমরা। সামোসা আর বাঙালি শিঙাড়ার ফারাকটা যেমন মোটা ও পাতলা ময়দার খোলের বৈচিত্র্যে ফুটে ওঠে, গুজিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। বাঙালি নামটাও ঢের সুন্দর। ‘ক্ষীরকান্তি’।
বাঙালিয়ানার এই জয়গানের মধ্যে প্লিজ প্রাদেশিকতার ঘ্রাণ খুঁজবেন না। তবে মিষ্টির পণ্যায়নের স্বাভাবিক পরিণতিতে উৎকর্ষের খামতি নিয়ে হা-হুতাশ থাকবেই। সত্যি বলতে ঠিকঠাক ক্ষীরকান্তি আর সাধারণত কলকাতায় মেলে না। ক্ষীরকান্তি মানে পাতলা কিন্তু মুচমুচে নিখুঁত ভাজা ময়দার খোলে ক্ষীরের সুস্বাদু পুরের ক্ষীরকান্তি। এখন কদাচিৎ এমন যথার্থ ক্ষীরকান্তির দেখা মেলে। এর জন্য রিষড়ার ফেলু মোদকের শরণ নিতে হবে।
দোলের যাবতীয় হুল্লোড়ের মধ্যে কোনও কোনও রসিক খাইয়ে এ সব স্মৃতি চোরা দীর্ঘশ্বাসের মতোই লুকিয়ে রেখেছেন।
ছবি: শুভেন্দু চাকী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy