(১৯৬৫—২০১৫)
প্রতিটি মানুষ তার জন্মমুহূর্তে ঈশ্বরের থেকে একটি ফতোয়া পায়। তা হল মৃত্যুর। আমৃত্যু সে ওই ফতোয়া নিয়ে চলে। উল্লাসে-প্রেমে-বিচ্ছেদে-প্রতিশোধে-ঈর্ষায়-আনন্দে-বেদনায়-সংরক্ত সেই চলার সঙ্গে সঙ্গে গুঁড়ি মেরে থাকা ওই ফতোয়াটিও চলে। মাঝে মাঝে সে রহস্যময় ঘোমটার আড়াল থেকে তার মুখ দেখায়। আমরা তখন ততটা বুঝি না। অবশেষে একদিন সেই ভয়ঙ্কর রাতটি আসে যখন আমরা এই ধোঁয়া-ধুলো-নক্ষত্র পরিকীর্ণ পৃথিবীতে শেষ বারের মতো পা রাখি। ওই ফতোয়া তখন তার পুরো বোরখা খুলে আমাদের সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আমরা কেউ কেউ আমাদের জীবনের সমস্ত ‘পারা’ নিয়ে তখন তার মুখোমুখি হই। কেউ কেউ তার ‘না-পারা’ নিয়ে হয়। কেউ কেউ হয়তো এক অবুঝ অভিমানে ওই ‘পারা’, ‘না-পারা’র সঙ্গে সর্বাত্মক বোঝাপড়া করে উঠতে পারে না। তবু ওই ফতোয়াটি তাকে পড়তেই হয়। কেউ কিছু দিন আগে পড়ে। কেউ দু’দিন পরে — এই যা।
আমার বন্ধু পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে মৃত্যু বিষয়ক ‘এলিজি’ লেখার অর্থ আসলে আমাদের তথাকথিত বাঁচার মাঝখানে ওই ফতোয়াটি ঘোমটার আড়াল থেকে একবার দেখা। তাকে পড়া। শারীরিক সমস্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া খসিয়ে একেবারে শিথিল বাকরহিত হয়ে শূন্য দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকা। এই ধরনের খবর হয়তো শক থেরাপির মতো আমাদের জানান দেয় যে, খুবই আশ্চর্য ও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমরা বেঁচে আছি। এখনও। কখনও মড়া হয়ে, কখনও ভেন্টিলেশনে, বা মর্গে বা হৃদয়ে সেপ্টিসেমিয়া নিয়ে চলতে চলতে আমরা বেঁচে আছি। এখনও। আর মাঝে মাঝে এ রকম কাছাকাছি বয়সের কোনও বন্ধু হাত নেড়ে হাসি মুখে ‘অলবিদা’ জানিয়ে বলে যায় ‘‘ফতোয়াটি মাঝেমাঝে ঝালিয়ে নিচ্ছ তো? মনে পড়ছে তো?’’ আমার এই আশ্চর্য ছেলেমানুষ অভিমানী বন্ধুটির সঙ্গে গত দশ-বারো বছর ধরে মোট পাঁচটি থিয়েটার ও একটি চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে ভালবাসায়-প্যাশনে-কান্নায়-হাসিতে-চিৎকারে-জটিলতায়-দংশনে-ভুল বোঝাবুঝিতে জড়িয়ে ধরায় এমন এক অপ্রতিহত রসায়ন আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল যা কখনও আমার মস্তিষ্কের ভিতর থেকে চলে যাবে না। কখনও না।
পাঁচটি থিয়েটার মানে ‘ভাইরাস এম’, ‘সতেরোই জুলাই’, ‘সিনেমার মতো’, ‘বাবলি’, ‘মৃত্যু-ঈশ্বর-যৌনতা’। প্রথম তিনটিতে আমার নির্দেশনা, পরের দু’টিতে অন্যের। চলচ্চিত্রটি মানে ‘তিস্তা’। উত্তরবঙ্গে আউটডোর। আর থিয়েটার নিয়ে সারা দেশ ঘোরা। রাত জেগে আড্ডা মারা, তর্ক করা, পরস্পরকে বোঝা, গল্প করা, ঝগড়া করা। তার পর ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়া। কত কিছু মনে পড়ছে। যা মনে পড়ে তার সবটা কি বলে ওঠা যায়? সম্ভব? অনেকটাই হিমশৈলের মতো ভেতরে পড়ে থাকে। তার পর জলের মতো ঘুরে ঘুরে সেই স্মৃতির সঙ্গে সংলাপ আর প্রলাপ শুরু হয়। তখন দু’জন মিলে নাটকটা লিখি। একদম সেলিম-জাভেদের মতো। ২০০৩ সাল। পীযূষকান্তি সরকারের একক শুনতে গেছি রবীন্দ্রসদনে এক শীতের সকালে। পীযূষ বলল, ‘‘থিয়েটারটা আবার করতে চাই। (ও তখন টেলিভিশন ও সিনেমায় যথেষ্ট খ্যাতনামা) হতে পারে?’’ আমি বললাম, হতেই পারে। ব্যস, শুরু হল ‘ভাইরাস এম’। পরের বছর ‘সতেরোই জুলাই’। তার পরের বছর ‘বাবলি’। ২০০৪-এ ‘তিস্তা’। মাঝে ‘মৃত্যু-ঈশ্বর-যৌনতা’। তার পর লম্বা বিরহ ও বিচ্ছেদ। আবার ২০১৩তে ‘সিনেমার মতো’। কিন্তু আমরা দু’জন কখনও মানসিক ভাবে একে অন্যকে ছেড়ে যাইনি। নির্দেশক ও অভিনেতার মধ্যে তো সেটাই প্রকৃত গাঁটছড়া। একেবারে দাম্পত্যের মতো। আমার দলের শেষ বক্তৃতা এ বছরই তো পীযূষ দিল। বিষয় ছিল: ‘নির্দেশক-অভিনেতার সম্পর্ক’।
একদম সকাল বেলায় স্নানটান করে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, চুলটুল আঁচড়ে লেখার খসড়া হাতে করে পীযূষ হাজির। পুরনো দিনের মতো দু’জনেই চমৎকার মুডে। তুতুন (পীযূষের স্ত্রী)ও এসেছিল। সবাই মিলে হাসি, তামাশা, হইচই একদম পুরনো দিনের মতো। ফরসা মুখ আর কোঁকড়া চুল নিয়ে পীযূষ হাসছিল। সেই বিখ্যাত ছেলেমানুষি হাসি। আমাদের দলের জন্মদিনে ও শেষ অভিনয় করল এই সেপ্টেম্বরে। ‘সিনেমার মতো’। দু’জন কত দিন পর মঞ্চ ভাগ করলাম। ও সে দিন গোড়ায় একটু ডিসটার্বড ছিল। ডিসটার্বড ছিল ভেতরে ভেতরে। কেন কে জানে? রিঅ্যাক্ট করছিল। ওই ধাত আমার চেনা। ও-ও জানে আমি ইগনোর করব। শোয়ের শেষে আবার যে কে সেই। জড়িয়ে ধরে বলে গেল, পুজোর পরেই আমাদের ওর বাড়িতে খাওয়াবে। লোকে তখন ওকে ঘিরে ধরেছে। ওর অভিনয়ের তারিফ করছে। আর ওর মুখটা আস্তে আস্তে আবার ছেলেমানুষের মতো হয়ে যাচ্ছে। সেই হাসিটা হাসছে। ওর হাতে স্ক্রিপ্ট। ওর সংলাপের তলায় যত্ন করে হলুদরঙা পেনসিলে দাগ দেওয়া। খাতার উপরে নাটক, নির্দেশক আর ওর চরিত্রের নাম লেখা। অভিনেতা তখন প্রায় ঈশ্বরের মতো। তার মাথা তখন নিজের শরীর ছাপিয়ে অ্যাকাডেমির সিলিং ছুঁয়ে ফেলে।
পীযূষেরও কত বার ছুঁত। এ আমার নিজের চোখে দেখা। ‘ভাইরাস এম’য়ের নীলাঞ্জন, ‘সতেরো জুলাই’য়ের রাকেশ চট্টোপাধ্যায়, ‘সিনেমার মতো’তে দীপায়ন, ‘বাবলি’র কোরক — আমি কোনটা ছেড়ে কার কথা বলব? আর অভিনয়ের শেষে? দু’জনে দাঁড়িয়ে থাকি ফাঁকা গ্রিনরুমে। কখনও দু’জনের চোখে চোখ। কখনও পিছলে যাচ্ছে। একদম ‘ননীদা নটআউট’য়ের শেষ দৃশ্যের মতো। আমি জানি পীযূষ আজও স্কোয়ার ড্রাইভ, পুল, হুক, স্কোয়ার কাট — সব ক’টা মেরেছে। গোড়ায় স্লিপে দু’-একটা ক্যাচ দিয়েছে বটে, কিন্তু তা মামুলি। তার তীব্র শরীরী অভিব্যক্তিতে, দ্রুত উচ্চারণে, আবেগের আততিতে, উত্তেজনার নির্গমনে, শান্ত শীতলতায় এবং নিখুঁত চরিত্রায়ণে সে আজও অভিনেতার সেই পরম কাঙ্ক্ষিত তুঙ্গ বিন্দুটি ছুঁয়ে ফেলেছে। তবুও আমরা তাকাব পরস্পরের দিকে। ও জিজ্ঞাসু চোখ মেলে তাকাবে আমার দিকে। আমি বলব, দারুণ। পরের শোয়ে আরও ভাল করতে হবে। তবু কোনও কোনও শোয়ের পরে বুদ্ধিমান অভিনেতা বুঝে যাবে পরিচালক সম্পূর্ণ তৃপ্ত নয় আজ। অভিনেতা তখন অতৃপ্ত হয়ে পড়বে। সে একটা ছটফটে টাট্টুঘোড়া হয়ে যাবে। আর পরের শোয়ে নিজের পুরোটা বের করে দেবে। এই খেলা চলবে আজীবন। হয়তো জন্মান্তরেও।
পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায় আমার দেখা সেই শ্রেষ্ঠ অতৃপ্ত অভিনেতা। যে কখনও তৃপ্ত হতে শেখেনি। এই ‘আমিই প্রধান’য়ের মতো তৃপ্ত, আত্মসর্বস্ব, ‘আমাকে দেখুন’ মার্কা মজন্তালিদের ভিড়ে পীযূষদের মতো কোনও কোনও অতৃপ্ত শিল্পী থাকেন যাঁরা শান্তি পান না। তৃপ্ত হন না। দেব আপোল্লোনের অভিশাপের আঙুল তাঁর শরীরে স্পর্শ করে আর লালন খ্যাপার সাঁই দৌড় শুরু হয়, চলে একদম চিতা পর্যন্ত। আর সেই অভিমানী বোঝেও না এর মধ্য দিয়েই সে কখন যেন অ-মর হয়ে যাচ্ছে রসিক হৃদয়ে। ফিনিক্স পাখির মতোই। আমাদের সব জাড়-সাঙ্ঘাতিক যাপন-শিল্পের উত্তাপ-সমসময়ের তীব্র বৈদ্যুতিক ঘাত-প্রতিঘাত ছেনে মহাসময় তার গর্ভে কাউকে কাউকে ডেকে আদর করে কাঁসার থালাবাটিতে শাকান্ন ও পরমান্ন খাওয়ায়। আমার ভাবতে ভাল লাগছে, আমার বন্ধু এখন খুব করে সেই আদর পাচ্ছে। আর আমরা বাকি অগ্রদানীরা নিজ পিণ্ড নিজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষায় আছি। আনন্দে আছি। বিরহে আছি। শোকে আছি। কবে সেই পুরোহিত আসবেন। এসে বাকি চক্কোত্তিদের খুঁজবেন।
পীযূষ, তুই যেখানেই থাকিস ভাল থাকিস। তুতুন-তাতাই ঠিক থাকবে। চিন্তা করিস না।
আমরা অছি হয়ে আছি।
থাকব। দেখা হবে আবার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy