Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

কবীরের সার্টিফিকেট চাই না

কবীর সুমন বলেছেন আমি ওঁকে ঈর্ষা করি। কবীরসাহেবকে ঈর্ষা করব কেন? আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী। আর উনি আধুনিক গানের শিল্পী।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৩ ২২:২৩
Share: Save:

কবীর সুমন বলেছেন আমি ওঁকে ঈর্ষা করি। কবীরসাহেবকে ঈর্ষা করব কেন? আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী। আর উনি আধুনিক গানের শিল্পী। আমাদের মাধ্যম সম্পূর্ণ আলাদা। পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করার মানসিকতা আমার নেই। অটোর পেছনে লেখা ‘লুচির মতো ফুলবি’-সূচক মন্তব্যে কেবল বক্তার রুচিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। কবীর সুমনের সার্টিফিকেট আমি চাইনি। ওঁকে আমি জিজ্ঞেস করিনি তো উনি আমাকে চেনেন কি না। তাও বলে রাখি ১৯৭৫ সাল থেকে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স, দিল্লি হেরিটেজ ফেস্টিভ্যাল, ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সয়ের মতো অনুষ্ঠানে আমি নিয়মিত গাই। আর ১৯৮৭ সাল থেকে বি-হাই শিল্পী হিসেবে রেডিয়োতে গান গাইতে আরম্ভ করি। এখন উনি যদি এই অনুষ্ঠান বা রেডিয়ো-র গান না শোনেন তাতে আমার বলার কিছু নেই।

দেখলাম বাঙালি সম্পর্কে উনি অত্যন্ত নিচুস্তরের মন্তব্য করেছেন। একজন গায়কের ধর্ম হল সঙ্গীত। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলিকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল উনি নমাজ পড়েন কিনা? তাতে উনি বলছিলেন, “আমি গান গাই। এটাই আমার ধর্ম।” প্রশ্ন উঠেছে আমার বাঙালিত্ব নিয়েও। কবীর সুমনের কি কোনও অসুবিধে আছে আমি যদি বাঙালি হই?

দ্বিতীয়ত আর একটা কথা, কিশোরকুমার, লতা মঙ্গেশকর এঁরা কি গান লিখতেন? লিখলেও সেগুলো জনপ্রিয় হয়নি। গায়ক হতে গেলে গান শিখতেই হবে এমনটাও নয়। যদিও জানিয়ে রাখি ‘শ্যামরঙ্গ’ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অত্যন্ত জনপ্রিয় কম্পোজিশন। আমারই করা। আমি একশো পঞ্চাশটি মধ্য, বিলম্বিত লয়ের খেয়াল, ঠুমরি কম্পোজ করেছি। এ ছাড়াও সুফিগান, ভজন ও গজলে সুর দিয়েছি। এগুলো উত্তর ভারতে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমার এই কাজগুলোকে কি সুর দেওয়া বলে না?

কবীর সুমন তাঁর সাক্ষাত্‌কারে বলেছেন, “আমার চেয়ে রাবীন্দ্রিক সঙ্গীতকার ত্রিভুবনে আর নেই।” আমার কথা হল রাবীন্দ্রিক সঙ্গীতকার হয় নাকি? উনি কি নতুন করে রবীন্দ্রনাথের গানে সুর দিয়েছেন? এত অহঙ্কার ভাল নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলে গিয়েছেন, “আমার গানে যেন স্টিম রোলার না চালানো হয়।” গান গাইতে গেলে রবীন্দ্রনাথ একটু পড়তেও হবে। ‘পঁচিশে বৈশাখ’, ‘২২শে শ্রাবণ’য়ে যে হুল্লোড় হয়, সেখানে পাইকারি দরে যে সব শিল্পী গান করেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই অশিক্ষিত গলা। মাত্র দু’এক জন ভাল শিল্পী সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে কোনও মন্তব্য আমি আমার সাক্ষাত্‌কারে করিনি। জোর করে নাম এনে এ ক্ষেত্রে ঝগড়া বাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করা হয়েছে।

আমি শ্রীকান্ত আচার্য, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, শ্রাবণী সেন, ইন্দ্রাণী সেনপ্রত্যেকের গানের প্রশংসক। এঁদের সঙ্গে আমার চমত্‌কার সম্পর্ক। যদিও মনোময়ের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কিন্তু ওর গান ভালবাসি।

স্বরলিপি দেখে যিনি অজানা গান তুলতে পারবেনআমি ধরেই নিচ্ছি নির্দিষ্ট পাঠক্রম এবং গুরুর কাছ থেকে অজানা গান তোলার শিক্ষা তিনি পাচ্ছেন। সঙ্গীত কেবল গুরুমুখী নয়। শ্রবণবিদ্যাও। সঙ্গীত শিক্ষার পাশাপাশি চল্লিশ বছর ধরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেনের গান শুনে আসছি। কিছু না শুনে, কিছু না শিখে, কেবল স্বরলিপি পড়ে গান তোলা যায় এমন কথা কখনও বলিনি।
সবাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রতিভা নিয়ে জন্মান না। এ দেশের বাউলশিল্পীরা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত না শিখলেও দীর্ঘদিন ধরে সাধনা করছেন। আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চা বলতে স্বরের সাধনার কথা বলছি। পূর্ণদাস বাউল, সনাতন দাস বাউল সাধনার জন্যই বিখ্যাত। সব বাউলই কি সুরে গান? বললেই হল? নতুন প্রজন্মের যাঁরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছেন তাঁরা অবশ্যই শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিখবেন। রবীন্দ্রনাথ কেন বেহাগে কোন কথার খাতিরে কোমল নি লাগালেন সেই মজাটা তাঁরা বুঝতেই পারবেন না যদি বেহাগ না জানেন।
শান্তিনিকেতন আমার প্রাণ। আমি শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতের শিক্ষক। আমি কেবল সঠিক ভাবে গান গাওয়ার চেষ্টা করে চলেছি। এ ভাবেই যেন সবাই আমাকে মনে রাখে।

তাঁদের মত
আমি মোহন সিংহ ও কবীর সুমন দু’জনেরই বক্তব্য পড়েছি। আমার মনে হয় কার গান ভাল, কার গান খারাপ এ সবের বিচার করবেন শ্রোতা। বৃহত্তর অর্থে বিচার করবে মহাকাল। কেউ কাউকে প্রাণ ভরে গাল পাড়তেই পারেন, কিন্তু দেখা গেল যে শিল্পীকে গাল দেওয়া হচ্ছে, তিনি হয়তো শ্রোতা আর সমকালের বিচারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হয়ে বসে আছেন। তখন এই গালবিনিময় একেবারে ব্যর্থ হয়ে যায়। আমার মনে হয় যাঁরা এই ধরনের গালাগাল, প্রতি-গালগাল করেন তাঁদের কোনও হরমোনজনিত সমস্যা আছে। ঈর্ষা, ক্ষিপ্ততা, অসহিষ্ণুতা, রূঢ়ভাষী হওয়া সবই আসলে হরমোনের ভারসাম্যহীন ক্ষরণ থেকে হয়। বিশ্বভারতীর কোনও এক জন অধ্যাপিকা এক ঘরোয়া আসরে আমার অনুপস্থিতিতে বলেছিলেন, “কে বলেছিল স্বাগতালক্ষ্মীকে বসে বসে দু’হাজারখানা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে?’’ যিনি বলেছিলেন এ কথা, তাঁর ইচ্ছে হয়েছিল বলেই বলেছিলেন। কেউ যদি সমালোচনা করেন, তার পাল্টা একটা সমালোচনা করতেই হবে এমন কোনও যুক্তি নেই। আমাদের আসল কাজ তো গানটা গাওয়া। কিছু দিন আগে আমি নিজেই একটা ইন্টারভিউয়ে সোমলতার ‘মায়াবনবিহারিণী’র সমালোচনা করেছিলাম। পরে দেখলাম সোমলতাও একটা কাগজে আমার সম্পর্কে বলেছে, “উনিও তো পিয়ানো বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গান।” আসলে সোমলতা জানেই না, রবীন্দ্রনাথের পরিবারে পিয়ানো ছিল পারিবারিক যন্ত্রানুষঙ্গ। এই ইন্টারভিউটার থেকে শিখেছি যে বেশি কথা বলে কোনও লাভ নেই। কথায় কথা বাড়ে। শেষে একটা কথা না বললেই নয়, দেবব্রত বিশ্বাসের গানে কোনও দিন কালোয়াতি দেখিনি। মোহন সিংহ কালোয়াতি পেয়েছেন তাঁর গানে। এটা খুব বিভ্রান্তিকর।
স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত

যেহেতু মোহন সিংহ এবং কবীর সুমন দু’জনেই অনেক সিনিয়ার, তাই এই রকম একটা বাদানুবাদ অনভিপ্রেত ছিল। আমার বলার শুধু এইটুকুই।
শ্রীকান্ত আচার্য

মোহন সিংহ এবং কবীর সুমনের সাক্ষাত্‌কার পাশাপাশি রেখে পড়লে মনে হচ্ছে যেন বাচ্চাদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। মোহন সিংহ তাঁর ইন্টারভিউতে বলেছেন যে শিল্পীরা শক্ত তালের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে চান না। এটা আমার ক্ষেত্রে খাটে। আমি ইচ্ছে করেই শক্ত তালের গান গাই না, কারণ চাই শ্রোতারাও আমার সুরে সহজে সুর মেলান। সহজ তালের গান মনোরঞ্জক ভাবে গাওয়াটাও কিন্তু কঠিন। আর গিটার হাতে কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলে যে সেটা সুখশ্রাব্য হবে না, তাও নয়। তবে কবীরদা খুব ভাল গীতিকার-সুরকার। হয়তো সেই জন্যই তিনি বলেছেন রবীন্দ্রনাথের কোনও গানে অন্য ভাবে সুর দেওয়ার কথা। সুরকারেরা এক্সপেরিমেন্ট করতেই পারেন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর-লয়-তাল আগাগোড়া যেমনটি স্বরলিপিতে আছে, তেমনটা থাকাই ভাল।
শ্রাবণী সেন

মোহন সিংহ বা কবীর সুমন কেউই তাঁদের সাক্ষাত্‌কারে আমার নাম উল্লেখ করেননি। তাতে বুঝেছি শিল্পী হিসেবে আমার কোনও নম্বর নেই তাঁদের কাছে। তাই আমি কেনই বা দু’ জনের মতামতের প্রতিক্রিয়া জানাব? পাঠক হিসেবে বলতে পারি, মোহন সিংহ যে বলেছেন অধিকাংশ গান ‘অশিক্ষিত গলার’এটার সঙ্গে একেবারেই সহমত নই। এমনটা বলা মানে শুধু শিল্পীদের নয়, সেই সব শ্রোতাদেরও অপমান করা যাঁরা এখনও এই অসম্ভব ফাস্ট যুগেও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন বা শোনার অভ্যেস রাখেন। গীতিকার কবীর সুমন সম্পর্কে খুবই শ্রদ্ধা রেখে বলছি তিনি মোহন সিংহের পাল্টা সাক্ষাত্‌কারে যে সব বক্তব্য রেখেছেন তা নিয়ে কিছুই বলার নেই। কারণ উনি কেমন মানুষ, কী ভাবে কথা বলেনসেটা এত দিনে সবাই জেনে গেছেন।
ইন্দ্রনীল সেন

খুব জলঘোলা হচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে এই কাদা ছোড়াছুড়ি। গিটারের সঙ্গে সুমনদার রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভাল লাগে মোহন সিংহের গানও। কথা হল এখন রবীন্দ্রসঙ্গীতে কপিরাইট উঠে যাওয়ার পর নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট তো চলবেই। তা নিয়ে সমালোচনা করার কিছু নেই। আর সমালোচনা করলেও কেউ ঈর্ষা করছে এটা ভাবাও ঠিক নয়। মোহন সিংহ ‘অশিক্ষিত গলা’ কথাটাকে ঘুরিয়ে অন্য ভাবে বলতে পারতেন। অন্য দিকে ‘দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি’ জাতীয় মন্তব্য আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে যায় না। শেষমেশ একটা কথাই মনে হচ্ছেভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, তাই না এত কথা! না থাকলে কাকে নিয়ে এত কথা হত!
লোপামুদ্রা মিত্র

সাক্ষাত্‌কার: সংযুক্তা বসু।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy