ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য
দূর দূর! কে বলল? এই তো তোদের মুশকিল, বাঙালি মানেই আত্মনিন্দুক। কেবলই আত্মনিন্দা করে মহানন্দ। কী? না, আত্মশোধন হচ্ছে! ক্যানো রে? পাপটা কী করলুম যে শোধন করতে হবে? তবে হ্যাঁ, একটা কথা বলতেই পারিস, বাঙালি হয়ে জন্মেছি, এই মহাপাপটা করে ফেলেছি। তো, সেটা ঢাকতে কি কম চেষ্টা করছি এখন?
বাঙালি মানেই মগজপ্রধান! তার মতো স্বচ্ছ, গভীর, বোধ ও বুদ্ধির এমন মিশেল (=ফুকো? সোনালি পাঠের পুঁথি? না কি সোনালি কাচের ফুঁকো-পুঁতি?) কে কবে কোথায় দেখেছে শুনি? আত্মজ্ঞান কি সহজ জ্ঞান? শুধু বাঙালিই পেরেছে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে অন্য চোখে নিজের দিকে তাকাতে। ওই যে, ‘বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত আগামী কাল তা ভাববে’— মহামতি লোকেরাই বলতেন তো? আর এখন? চেয়ে দ্যাখো দিকি বাঙালির দিকে? আর তাকাও কলকাতায় প্রবাসী মারোয়াড়ের, পঞ্জাবের, গুজরাতের, কি আরও সুদূর সিন্ধু প্রদেশের অধ্যবসায়ী মানুষদের দিকে? কেমন ঝরঝরিয়ে বাংলা বলে, আর কালীপুজোর দিনে লক্ষ্মীগণেশ পুজো করে, বাঙালির কষ্টেসৃষ্টে উপার্জন করা টাকাকড়ি হাসতে হাসতে নিজের রাজ্যে নিয়ে চলে যাচ্ছেন, তাতে আমাদের কি শিক্ষা হচ্ছে না? হচ্ছে তো। আমরাও লোভে পড়ে ব্যবসায়ে নামছি, কিন্তু ধীরে সুস্থে ব্যবসা করতে কি আমরা পারি? বাঙালি মানেই অধৈর্য, অল্প সময়ে অধিক লাভ চাই। আজ তাই ব্যবসায়ে বাঙালি মানেই অচল, কিংবা অসৎ।
বাঙালি মানেই আলসে! না জানে হাতের কাজ, না পারে গায়ের জোরের কাজ। জানে শুধু মাস্টারি আর গান-গপ্পো-কবিতা। আমাদের নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে জরুরি ছিলেন কারা? এই রাজ্যে শ্রেষ্ঠ কলের মিস্ত্রিরা ওড়িশা থেকে আসতেন। রান্নার ঠাকুর আর মালিরাও। মোটরের মিস্ত্রিরা হয় ওড়িশাবাসী, নয় শিখ। কলকাতার জীবন নির্বাহে অপরিহার্য কুলি-মজুর, রিকশাওলা, ঠেলাওলা, ফুচকাওলা, ফলওলা, ছাতা-সারাই, শিল-কাটাই ইত্যাদি রোদে-ঘোরা ফিরিওলারা, আর দারোয়ান, পিওন, পুলিশ কনস্টেবল কিংবা মুচি। তাঁরা প্রধানত আসতেন বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে। এ সব শ্রমসাধ্য কাজে রুচি ছিল না শহুরে বাঙালির। ট্যাক্সি, বাস আর ট্রাকে একচেটিয়া ছিলেন শিখ চালকেরা। সর্বশ্রেষ্ঠ কফির দোকান দিতেন কেরলের মানুষেরা, পানের দোকানগুলো যেন ওড়িশা থেকে তৈরি হয়েই আসত। শহরের জীবনযাত্রায় অপরিহার্য এত বেশি কাজে বাঙালির অরুচি ছিল বলেই হয়তো গতিক বুঝে বাধ্য হয়ে আমরা ‘নন-বেঙ্গলি’ বলে একটা শব্দ বানিয়েছি, ‘অ-বাঙালি’। অন্যান্য প্রদেশে এমন অদ্ভুত নেগেটিভ বর্ণনার শব্দ তৈরির দরকারই হয়নি, ‘নন-ওড়িয়া’ কিংবা ‘নন-বিহারি’ বলে শব্দ নেই।
বাঙালি মানেই যদি হয় অলস আর অকর্মা, বইমুখো আর চালিয়াত, বাঙালি মানেই পরচর্চা, চায়ের দোকান, তবে আমাদের ‘বাঙালি’ নিয়ে বাড়াবাড়ির উল্টো পিঠ, করিৎকর্মা ‘অবাঙালি’ হয়ে যাওয়াই তো ভাল।
অল্পশিক্ষায় অহংকারী বাঙালির পছন্দের আত্মপরিচয় ছিল কেরানিগিরি, মাস্টারি আর কবিতাচর্চা। বাঙালি মানেই ‘আবৃত্তি পরিষদ’, আর অন্তত পক্ষে হাতে-লেখা পত্রিকা। কে না জানে, বাঙালি মানেই ভোজনরসিক? মাছ-ভাত, রসগোল্লা, না, কবিতা-ফুটবল?
বাঙালি মানেই হুজুগ, আর বাঙালির হুজুগ বলতে প্রধান ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের বড় খেলা। সারা শহর থমকে যেত, কী-হয় কী-হয়। আজ ইলিশ, না চিংড়ির বিক্রি বাড়বে? এখন বাঙালি গ্লোবাল। ম্যাঞ্চেস্টার, না লিভারপুল? ব্রাজিল, না আর্জেন্টিনা? বাঙালি এখন ফুটবল দেখে অবাঙালির নিরাসক্ত চোখে। যেমন, সৌরভহীন ক্রিকেটে বাঙালির আগ্রহ কমে গেছে।
বাঙালি মানেই আর ‘নির্লোভ বিপ্লবী’ নয়। ‘আদর্শবাদী শিক্ষক’ নয়। ‘অল্পে তুষ্ট কেরানি’ নয়। বাঙালি মানেই অভ্রভেদী লোভ। বিশ্ববাজার খুলে গিয়েছে, ব্যাপক লোভের সামনে দাঁড়িয়ে বাঙালি আত্মহারা। সারদা, সাহারা, উত্তরে চাই, দক্ষিণে চাই, কিছু নাই আর কিছু নাই— শুধু লজ্জা! বাঙালির পকেটে এখন অঢেল টাকা। আর মাথায় অঢেল পাপের বোঝা। পিতৃপিতামহের ভদ্রাসন ভেঙে গুঁড়িয়ে কাঁচা টাকা করাই এখন অদূরদর্শী বাঙালির প্রিয়তম উপার্জনের রাস্তা।
বাঙালি মানেই সুবিধেবাদী। দরকার বুঝে নিজেকে ভেঙেচুরে অন্যের মতো করে গড়তে এমন করে আর কেউ পারে না! বহুরূপী বাঙালি নিজেকে চিনে ফেলেছে, সে অকম্মা, তাই সে আর বাঙালি থাকতে চাইছে না। ‘নন-বেঙ্গলি’ আগে ছিল নেগেটিভ, এখন কিন্তু পরম পজিটিভ শব্দ। সফল হতে চেয়ে আমরা আগে ‘সাহেব’ হতুম, এখন ‘অবাঙালি’ হচ্ছি।
সে দিন সন্ধ্যায় রাস্তায় গান-বাজনার ঝংকার শুনে বারান্দায় দৌড়ে গিয়ে দেখি, আরে বাঃ! আলোর সারি নিয়ে বরযাত্রী যাচ্ছে! শাড়ি-কাঁচুলি, ঘাগরা-উড়নিতে মেয়েরা, কালো ধুতি-লাল পাঞ্জাবি-সোনালি উত্তরীয়তে ছেলেরা, ব্যান্ড বাজিয়ে, বাংলায় ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ গেয়ে পুষ্পসজ্জিত মোটরগাড়ির আগে-আগে রাস্তা দিয়ে নাচতে নাচতে চলেছেন। আবির ছিটোনো হচ্ছে, তুবড়িও পুড়ল। বরের গাড়ি, না বিসর্জনের, বোঝা দায়। নাচ তো খুশিরই ব্যাপার। কিন্তু হকচকিয়ে গিয়ে খুশি হব কি হব না, বুঝতে পারিনি। আহ্লাদে নীলু বললে, ‘দিদি, দিদি, দেখুন, বাঙালি বিয়েও কী সুন্দর, ঠিক হিন্দুস্থানিদের মতো হচ্ছে!’
অবাঙালিদের বিয়ের আগে ‘সংগীত’ অন্তঃপুরের উৎসব, শুধু মেয়েরাই নাচে, গায়, ঢোল বাজিয়ে ফুর্তি করে, কিন্তু বাঙালির কোনও ফুর্তি থেকেই ছেলেদের বাদ দেওয়া অভাবনীয়! তাই খাস কলকাতায় দেখেছি, দু’পক্ষই দিশি বাঙালি, এমন বিয়ের আগেও ইদানীং ‘সংগীত’ হচ্ছে, সেখানে হবু বেহাই-বেহানরা সবাই মিলেমিশে দিব্যি হিন্দি ছবির গানের সঙ্গে নাচছেন।
ভুবনগ্রামের বাসিন্দা তো, আহা রে! চিরকেলে সংসারের বাঙালির ছেলে-মেয়েদের তাই এখন বাংলা বলতে হয় কত কষ্ট করে! টিভির বিজ্ঞাপন থেকে সযত্নে শিখে নেয় ভুল ব্যাকরণ। ভুল উচ্চারণ। ভুল অ্যাটিচুড। ‘দু’চোখ ভরে খান’, কিংবা ‘দেওয়াল, যা নজর কেড়ে নেয়’, ‘তার পিছনে পড়ে যায় শক্তির ভূত’— এ সব পরমাশ্চর্য বাংলা বিজ্ঞাপন কারা লিখছে? হিন্দিতে এমন ঘটে না কিন্তু! বিজ্ঞাপনের বীভৎস বাংলার তো কোনও নিয়ামক নেই। ৫০/৬০ বছর আগে প্রবাসী বাঙালি বাচ্চারা যেমন হিন্দি বাগ্ধারাতে সকরুণ বাংলা বাক্য গঠন করত, ঠিক তেমনি করে আজকের কলকাতার (বাংলা মাধ্যমেরও) উচ্চাশী বঙ্গসন্তানেরা অতি কষ্টেসৃষ্টে বাঁকিয়ে-চুরিয়ে অবাঙালির উচ্চারণে বাংলা বলেন হিন্দি-ইংরিজি মিশিয়ে। বাঙালি এখন ব্যস্ত তার ‘ভেতো’ আত্মপরিচয় ঢাকতে। সাজে, ভাষায়, ভঙ্গিতে, খাদ্যে আমরা যেন বাঙালি নই, যেন কোন সাগরপারের অতিথি! নিদেন পক্ষে দিল্লি-মুম্বই থেকে এসেছি! ‘বাংলাটা, নাঃ, পড়া হয় না!’
একটা সময় ছিল ভারতে, যখন বাঙালি মানেই ছিল অভিজাত। অবাঙালিরা ভালবেসে বাংলা শিখতেন, বাঙালি নাম দিতেন ছেলেমেয়েদের— শরৎ, সুভাষ, নন্দিনী, পার্বতী। সে ম্যাজিক কেটে গিয়েছে। বাঙালিই এখন উঠেপড়ে অবাঙালি হচ্ছে! নাম দিচ্ছি ঋষভ, করিশ্মা, আয়ুষ, নেহা। এ পাড়ায় বাড়ি ছিল সুধর্মা, ইলাবাস, তপোধাম, ভালো-বাসা। এখন? ফোর্ট-সিরিন, নাভনীত, সিদ্ধিদাতা, স্কাইলাইন-ভিনায়ক। বাঙালিয়ানা মুছতে কী আকুলিবিকুলি!
যেমন ডিসেম্বরে চাইনিজ নিউ ইয়ার হয়, মিড এপ্রিলে আসছে বাঙালির হ্যাপি নিউ ইয়ার। এই তো সুযোগ! সম্প্রতি চন্দ্রকোনায় মাটি খুঁড়ে কী আবিষ্কার করেছে বলুন দিকি পাঁচতারা হোটেল? পুরাকালের রন্ধন প্রণালী!
‘এ বারের ১লা বৈশাখ সেলিব্রেট করুন খাঁটি, ঐতিহাসিক গৌড়-বঙ্গীয় স্বাদে। মাত্র পৌনে চার হাজার টাকায় দু’জনের (ঈশ! কী ইন-এক্সপেন্সিভ নিউ ইয়ার্স ডিল, ন্যাচারালি, ড্রিংকস এক্সট্রা!) অথেনটিক বেঙ্গলি কুইসিন!’ প্রথমে ওয়েলকাম ড্রিংক, ফলের শরবত। শুক্তো থেকে শুরু, কাঁচা লঙ্কা, গন্ধরাজ লেবু, ঘি, সোনা মুগের ডাল, লম্বা (ও মা, মা, দ্যাখো দ্যাখো, বেগুনের ল্যাজ আছে!) বেগুনভাজা, গয়না-বড়িভাজা (ও মা, জাস্ট লাইক আলপনা!), নারকোল-মোচা, চিংড়ি-এঁচোড়, ডাব-চিংড়ি, ভেটকি-পাতুরি, ভাপা-ইলিশ। এ বারে আসবে দুটি ফুলকো লুচি আর পাঁঠা, চাটনি, পাঁপড়, আম-দই, চকলেট-রাবড়ি আর বেক্ড রসগোল্লা। আর অতি অবশ্যই বেনারসি পান! আইটেম কত রকম হল? একুশ তো? (কী স্ট্রেঞ্জ, মা, এটা তো গৌড়বঙ্গের আর্কিয়োলজিকাল ফাইন্ড। কিন্তু কাকু বলছেন, এটা বনেদি কলকাতার চালু মেনু!)
দূর দূর, বাঙালি মানেই চালিয়াতি আর মিথ্যেকথা। বাঙালি মানেই বাড়াবাড়ি! বাঙালি বড্ড আদেখলে বাপু! অবাঙালি খাওয়াদাওয়া কত ব্যালান্সড! উত্তরে ডাল-রোটি-আচার! দক্ষিণে দোসা-চাটনি-সম্বর! অবাঙালি হয়ে বাঁচা কত টাইম সেভিং! কত ইকনমিক্যাল।
ওই দ্যাখো, বাঙালি মানেই নিন্দুক। খাবেদাবে, নিন্দে করবে। এমনকী নিজেরও? তোমরা বাপু যে যা-ই বলো, বাঙালির মতো এমন করে কেউ তো আত্মনিন্দা করতে পারে না। কে-উ না! সেই তুমি আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োদের থেকেই ধরো না কেন? বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তকে মনে পড়ে?
ওটা পারি, কেননা বাঙালি মানেই অহং, বাঙালি মানেই আমিই প্রথম! আর বাঙালি মানেই (কেন্দ্রের দোষে, কিংবা ভাগ্যদোষে) তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত। মার্কনি আর জগদীশচন্দ্র বসুর ঘটনাই তো একমাত্র নয়, সত্যেন বসুরটাও না। আমাদের কত উদ্ভাবনই যে জনসমক্ষে এসে পৌঁছোনোর আগেই দুর্ভাগ্যের চড়ায় ‘গেলো ঠেকি’। ওই যে তাজমহল। কেউ কি জানেন, তার প্ল্যান করে দিয়েছিলেন এক বাঙালি স্থপতি, যিনি মনে মনে মমতাজের প্রেমে পাগল ছিলেন? কাজ সমাপ্ত হতে, তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিষাক্ত সুরা পান করিয়েছিলেন সম্রাট। কেননা, তিনি টের পেয়েছিলেন, কতটা প্রেম থাকলে এমন একটি সৌধ গড়ে তোলা যায়! তাঁর মনে ঈর্ষা জেগেছিল, মমতাজও কি...? কিন্তু সেই তরুণ স্থপতি তো বাঙালি, তাই কোনও ইতিহাসেই তাঁর নামটুকুও লেখা নেই।
বাঙালি মানেই ন্যায্য পাওনায় বঞ্চিত। তাই আজ বাঙালি মরিয়া হয়ে পরিবর্তন চাইছে, চাইছে ‘বাঙালি মানেই অবাঙালি’ এই পরিচয়। যদি তাতে অদৃষ্ট বদল হয়?
বাঙালির অহংকার যাদের নিয়ে, সেই মানুষগুলোর তো দেড়শো বছর পেরিয়ে গিয়েছে!
এখন ভাল বাঙালি মানেই অবাঙালি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy