মোনালিসা মুখোপাধ্যায়।
বলতেই পারি যে, পুরুষ আর নারী সমান। প্রকৃতি দু’পক্ষের প্রতি একই ভাবে সদয়। তবু কোথাও গিয়ে মেনে নিতেই হয় যে, প্রকৃতির তরফ থেকে বেশ কিছুটা পক্ষপাতিত্ব থেকেই গিয়েছে। প্রকৃতি পুরুষকে করেছে শারীরিক ভাবে বলশালী। নারীকে করেছে মানসিক ভাবে সংবেদনশীল। এর প্রমাণ আমরা পাই মহিলা চিত্রপরিচালকদের ছবির বিষয় নির্বাচনে। সেই বিষয়ের অভিব্যক্তিকরণে এবং তার সঞ্চালনায়ও। ১৯৩৪-এ মায়া ডেরন তাঁর স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘মেশেস অব দ্য আফটারনুন’-এ যে স্বপ্নদৃশ্যের ব্যাখ্যা করেছেন, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তার নজির অতুলনীয়। ১৪ মিনিটের ছবিতে এতগুলো স্তর এবং তাতে ধরা দেওয়া মানসিক টানাপড়েন, খুব বেশি ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।
যেখানে কোনও স্বল্প চর্চিত বিষয়ে নারীর বক্তব্য রাখাটাই এই সমাজে একটা চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে সেলিন সিয়ামা তাঁর ‘পোর্ট্রেট অব দ্য লেডি অন ফায়ার’ ছবিতে সমকামিতা নিয়ে অত্যন্ত পরিণত, সূক্ষ্ম ভাবে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছেন। এ ছবি যেন কবিতা। যেখানে মাধ্যমের আলাদা করে আর কোনও গুরুত্ব থাকে না এবং দর্শক মাধ্যমের খোলস পেরিয়ে গল্পের বিষয়বস্তুর রস আস্বাদন করে তার মধ্যে ডুবে যেতে পারে, সেখানেই এক জন গল্পকারের সার্থকতা।
চলচ্চিত্রকারকে লিঙ্গগত পরিচয় আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। আমি তাতে ১০০ শতাংশ সহমত। কিন্তু দৃষ্টিকোণ আর অনুভূতির বিষয়ে যখন কথা হয়, সেখানে তার লিঙ্গের গুরুত্ব কী ভাবে অস্বীকার করা যেতে পারে! মান্টো খুব কাছ থেকে নারীদের দেখেছেন, অনুভব করেছেন, তাদের কথা লিখেছেন। কিন্তু যখন ইস্মত চুঘতাই সেই বিষয়ে লিখলেন, তখন তা নিয়ে সাড়া পড়ে গেল।
‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’-এ অপর্ণা সেন এক অতি স্বল্প চর্চিত বিষয় নিয়ে কথা বললেন। সেই সঙ্গে জেনিফারের অভিনয় তাকে অন্য মাত্রা দিল। ভারতীর কয়েক লক্ষ ছবির মধ্যে সেই ছবি এখনও এক অন্যতম নিদর্শন। যেখানে আর্ট-হাউস ছবির ক্ষেত্রেও হিট জুটির প্রয়োজন হত। যেমন নাসির-স্মিতা, শাবানা-ওম। সেখানে অপর্ণা সেন প্রৌঢ় মিসেস স্টোনহ্যামকে ছবির মুখ্য চরিত্র হিসাবে নির্বাচন করলেন।
এ বার আর একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, এমন একটা সময় ছিল, যখন অভিনয় করলে, গান গাইলেও মহিলাদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠত। সুরাইয়া, নূর জাহান, দেবিকা রানি— এঁদের সমাজের কাছ থেকে কম অবমাননা সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু, সেই সময়েই ঊনবিংশ শতকের শুরুতে জদ্দনবাঈও ছিলেন, যিনি সমাজের পরোয়া না করে সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তিনি গান গেয়েছেন, সুর দিয়েছেন এবং ছবি প্রযোজনা পর্যন্ত করেছেন। মা হিসাবেও তাঁর যোগ্যতা কোথাও কম নয়। তাঁর কন্যা নার্গিসকে আমরা কে না চিনি? আমার মনে হয়, বেদনার সঙ্গে শিল্পের যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন। সমাজ যত নির্মম ভাবে নারীদের আঘাত দিয়েছে, নারীরা তাকে ততটাই সুন্দর করে গল্প-অভিনয় মাধ্যমে, গায়কির মাধ্যমে এবং ছবির বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে অভিব্যক্ত করে এসেছেন। মধুবালা, মীনাকুমারী, সুরাইয়া, রেখা, শ্রীলা মজুমদার, মমতা শংকর— ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন নাম অগুনতি।
এ সবের থেকে আরও খানিকটা দূরে, আরও একটা বিষয় আছে, যেটা আরও বেদনাদায়ক। সমাজ নারীদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। বিয়ের আগে, বিয়ের পরে, কর্মক্ষেত্রে, সর্বত্র নারীর প্রতি শোষণ চলেছে। নারীকে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। ধীরে ধীরে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে একটা জায়গা তৈরি করলেও, সেখানেও তারা পুরুষের জালে জড়িয়ে পড়ছে। কত মেয়েরা অভিনয় করার জন্য, গান গাওয়া বা ছবি পরিচালনার সুযোগ পাওয়ার জন্য কী না করছে। দমন, শোষণ, তার পরে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য ফের শোষণ। এটা আমাকে সত্যিই ভাবায় এবং ব্যথিত করে। এতটাই নিরাশ করে মনে হয়, সবই ব্যর্থ। এবং তার পরে আবার মার্জিন সাত্রাপেঁর ‘পার্সেপোলিস’ সামনে এসে দাঁড়ায় আর বলে, চরৈবেতি, চরৈবেতি, চরৈবেতি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy