শুরুতে তিনি নিন্দিত, এখন তাঁকে ছাড়া দর্শক অচল! ‘চিরসখা’ ধারাবাহিকে অপরাজিতা ঘোষ দাসের বিপরীতে সুদীপ মুখোপাধ্যায়। খবর ছড়ানোমাত্র বেঁকে বসেছিলেন বাংলার ছোট পর্দার দর্শক। কারণ, এখনও তাঁদের মনে ‘এখানে আকাশ নীল’-এর আমেজ। অপরাজিতার বিপরীতে ঋষি কৌশিককে দেখতে চেয়েছিলেন দর্শক। তবে ধারাবাহিক যত এগিয়েছে, ততই ছবিটা বদলেছে। কিছু দিন আগে, সুদীপকে সরিয়ে ঋষি কৌশিককে আনা হচ্ছে, এমন খবর ছড়াতেই প্রতিবাদে মুখর সেই দর্শকই। তাঁরা সুদীপের জায়গায় অন্য কাউকে দেখতে রাজি নন।
প্রায় প্রতি দিন সুদীপের অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ের এই ধারাবাহিকের সৌজন্যে। তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ দুলাল লাহিড়ি। বর্ষীয়ান অভিনেতা হোয়াট্সঅ্যাপে সুদীপকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন। লিখেছেন, তিনি রোজ অভিনেতার অভিনয় দেখছেন। রোজ তার প্রেমে পড়ছেন। এই ধারাবাহিক তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘গানের ও পারে’ ধারাবাহিকের কথা। যেখানে বাঙালিয়ানা শেষ কথা ছিল।
‘চিরসখা’র মাধ্যমে বহু দিন পর ধারাবাহিকে ফিরলেন অপরাজিতা ঘোষ দাস। এই ধারাবাহিকের হাত ধরে অনেক দিন পরে অভিনয়ে ফিরেছেন বিধায়ক লাভলী মৈত্রও। রয়েছেন অনসূয়া মজুমদার, ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায়, রাজন্যা মিত্র, দিগন্ত বাগচী-সহ আরও অনেকে। কিন্তু সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন ধারাবাহিকের নায়ক ‘স্বতন্ত্র’। কেন?
জানতে চেয়েছিল আনন্দবাজার ডট কম। নিজের অভিনীত চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন সুদীপ। যেমন, অধিকাংশ সময় হয় তিনি ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ চরিত্রে নয়তো ভয়ঙ্কর খলনায়ক। সারা ক্ষণ পর্দায় চিৎকার করছেন! সেই তিনিই যে এত পেলব, রোম্যান্টিক হতে পারেন— ভাবতে পারছেন না অনেকে, জানিয়েছেন অভিনেতা। তাঁর প্রতি আকর্ষণের প্রথম কারণ এটাই। এই যদি জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির প্রথম ধাপ হয় অভিনেতার মতে দ্বিতীয় ধাপ, ধারাবাহিকের গল্প এবং ‘স্বতন্ত্র’ চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য। পরকীয়া, শাশুড়ি-বৌমার কূটকচালি সরিয়ে এমন এক বন্ধুত্বের গল্প বলছে ‘চিরসখা’ যেখানে শরীরী প্রেম নয়, দু’টি মন পরস্পরের প্রতি মুগ্ধ। কবি চণ্ডীদাস তাঁর কাব্যে নায়িকার রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে যেমন লিখেছিলেন, ‘নিকষিত হেম, কামগন্ধ নাহি তায়।’
সেই অনুযায়ী বিয়ের আগে থেকে ‘কমলিনী’ তাঁর স্বামীর বন্ধু ‘স্বতন্ত্র’কে ভালবাসে। জানানোর আগেই তাঁর ‘স্বতন্ত্র’-এর বন্ধুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। বন্ধুর প্রেমের বার্তা নায়িকার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন নায়ক নিজে! স্বামীর মৃত্যুর পর ‘সখা’ ‘চিরসখা’ হয়েছে। সব সময় আগলে চলেছে ‘প্রিয়া’কে। তবে ‘কমলিনী’র সঙ্গে নতুন করে সংসার পাতেনি। উল্টে নায়িকার সংসারকেই আপন করে নিয়েছে সে। সুদীপের দাবি, “এই ধরনের গল্প বাংলা বিনোদন দুনিয়ায় ঘুরেফিরে এসেছে। যেমন, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘আমি সে ও সখা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি বাংলা ছবি বা তার হিন্দি সংস্করণ ‘বেমিসাল’-এ দুই বন্ধুর এক নারীর প্রতি গাঢ় প্রেমের গল্প বড় পর্দায় দেখানো হয়েছে। অভিনয় করতে গিয়ে বার বার সাহিত্যের সেই স্বাদ পেয়েছি। যার জেরে অভিনয় ভাল হচ্ছে।”
আরও পড়ুন:
সুদীপের মতো একই বক্তব্য বর্ষীয়ান অভিনেতা দুলালেরও। আনন্দবাজার ডট কম তাঁর সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। তাঁর কথায়, “বাঙালি সমাজে যা দেখা যায় সেই গল্প এখনকার ধারাবাহিকে খুব কম বলা হয়। যে ধারাবাহিকে দেখানো হয় সেই ধারাবাহিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দেখতে ভাল লাগে। তাই ‘চিরসখা’ দেখতে ভুলি না।” এই প্রসঙ্গেই তিনি ‘গানের ও পারে’ ধারাবাহিকের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে, ওই ধারাবাহিকেও বাঙালির খুঁটিনাটি বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছিলেন প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ। সেই সঙ্গে সুদীপের অভিনয় প্রসঙ্গে তাঁর মত, এত দিন ঠিক ভাবে অভিনেতার প্রতিভা ব্যবহৃত হয়নি। লীনার ধারাবাহিকে একই অভিনেতা অন্য রূপে হাজির হতেই দর্শক এত ভালবাসছেন।
সমাজে কামগন্ধহীন প্রেম প্রায় সোনার পাথরবাটি-সম। তাই কি ‘স্বতন্ত্র’ সকলের এত প্রিয়? অনেকটা ‘শ্রীময়ী’ ধারাবাহিকের ‘রোহিত সেন’ চরিত্রের মতো?
সুদীপ এবং দুলাল উভয়েই জানিয়েছেন, এই ধরনের সম্পর্ক আগেও ছিল। এখনও আছে। এটা বলা যেতে পারে, নিয়মিত এই ধরনের গল্প বলা হয় না বলেই হয়তো চাপা পড়ে যায়। সময়ের ধুলো সরিয়ে প্রকাশ্যে এলেই সেই গল্পের প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়েন সকলে।