গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
বন্ধ মাচা থেকে শহরের কনসার্ট। রেকর্ডিং স্টুডিয়োয় সুর নেই। জমছে অন্ধকার। এই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত অনেক মানুষ ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন। বাড়ছে লকডাউনের দিন। ফুরিয়ে আসছে সঞ্চয়। এই ইন্ডাস্ট্রির নেই কোনও ফেডারেশন বা গিল্ডও সক্রিয় নয়। এখানে একক ভাবে মানুষ আর তার দল গড়ে ওঠে। মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি!
লকডাউনের জেরে আগামী এক বছর মুখ থুবড়ে পড়বে বাংলা গানের জগৎ, এমনটাই আশঙ্কা করছেন শিল্পীরা। খবর নিল আনন্দবাজার ডিজিটাল।
মুম্বই থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন শান্তনু মৈত্র, ‘‘লকডাউনের পর জীবন স্বাভাবিক হলেও মাচা হবে না। কনসার্টে মানুষ গান শুনতে আসবে না। ওই সময় যন্ত্রশিল্পীদের জন্য সরকারকে এবং নামী শিল্পীদের এগিয়ে আসতেই হবে। নয়তো অনুষ্ঠান নির্ভর মিউজিশিয়ানরা বাঁচবেন না।" তবে শান্তনুর বিশ্বাস, মানুষ যে পরিস্থিতিতেই থাক গান শুনবেই।
শিল্পী শুভা মুদগল ইতিমধ্যেই ভারতীয় মিউজিশিয়ানদের জন্য তহবিল তৈরি করেছেন। সেখানে এ আর রহমান দু’লক্ষ, শান এক লক্ষ টাকা দিয়েছেন। আনন্দবাজার ডিজিটালকে এই খবর দিলেন সঙ্গীত আয়োজক দেবজ্যোতি মিশ্র। তাঁর কথায়: ‘‘পুরিয়াধনেশ্রীর কড়ি মা নিয়ে আর আগ্রহী নই। আমাদের একজোট হয়ে এ বার কাজ করা উচিত।" তিনি নিজেও ওই তহবিলে ৫০ হাজার টাকা দান করেছেন।
এই লকডাউনে বাংলা গান নিজেই তার ছন্দ হারিয়েছে। — ফাইল চিত্র
ইউটিউবে নিজের চ্যানেলে গান করছেন রূপঙ্কর। ফেসবুকেও একে অন্যকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে গান গাইছিলেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তিনি বললেন, "মানুষের হাতে গানের জন্য খরচ করার আর পয়সা থাকবে না। আগে ৩০টা অনুষ্ঠান হলে এ বার দশটা হবে। পারিশ্রমিক কমে যাবে। যন্ত্রশিল্পীদের অবস্থা আরও খারাপ। শো নেই। তাঁদের টাকা নেই। অন্য শিল্পী দেখব আমার চেয়ে কম টাকায় অনুষ্ঠান করে চলে যাবে। শো পাওয়া নিয়ে ভয়ঙ্কর খেয়োখেয়ি হবে শিল্পীদের মধ্যে। ভয়ঙ্কর সময় আসছে। ২০২১-এর পুজোর আগে বাংলা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।"
ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শান্তনু মৈত্র অবশ্য বলছেন, "মানুষ এখন যে ভাবে ঘরে বসে গানবাজনা করছেন সে ভাবেই বেশ কিছু দিন চলবে। অভ্যেস হয়ে গেলে এই কনটেন্টগুলোই মনিটাইজ করা হবে। সেখান থেকে রোজগারের পথ তৈরি হবে।"
সঙ্গীতশিল্পী, লেখক, সুরকার অনুপম রায় যদিও শান্তনুর সঙ্গে একমত হতে পারেননি। তাঁর মতে, "আমার কাছে মানুষের একটা প্রত্যাশা আছে। আমি ঘরে বসে রেকর্ডিং করে সেই খারাপ গান মানুষকে কোনও দিন শোনাব না। স্টুডিয়ো ইতিমধ্যেই ক্ষতির মুখ দেখছে। সিনেমা নেই! তাই সিনেমার কাজও নেই। অন্য দিকে যে মানুষ মাচায় বাঁশ বাঁধে, যে মানুষ অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে টাকা পায় তাদের অবস্থা আরও খারাপ!"
আরও পড়ুন: ‘সাম্প্রদায়িক পোস্ট’, টুইটার থেকে সাসপেন্ড কঙ্গনার দিদি রঙ্গোলি
বাড়িতে ফোনের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছেন সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তী। বললেন, "এই ভয়ঙ্কর সময়ে গান গাওয়ার মাধ্যম একটু একটু করে বদলাতে শুরু করবে বলে আমার মনে হয়। আমি গান রেকর্ড করে এক বন্ধুকে পাঠালাম, সে এডিট করল। সেই গানের বাড়ি থেকেই ভিডিয়ো হল। এই ভাবে কিন্তু গান তৈরি হবে। এই লকডাউন শিখিয়ে দিল শুধু গান জানলেই হবে না টেকনিক্যালি সাউন্ড হতে হবে আমাদের।" বললেন ইমন, যিনি লকডাউন পরবর্তী সময়ে সরকারের উদ্যোগে সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে কোনও সংগঠন তৈরি হতে পারে, এমন আশাও করছেন। সংগঠন তৈরি হওয়া দরকার, মনে করেন অনুপম-ও।
শেষে ইউটিউব কি আলো ফেলবে সুরের জগতে? অনুপম বললেন, "একেবারেই না। আমার গানের পরিচিতি আছে। কিছু টাকা পেয়েছি। ওই অবধি। নতুনদের এই সময় এখান থেকে খুব একটা রোজগার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদি না কেউ সম্পূর্ণ বেসুরো কদর্য কিছু করে সকলের নজর কাড়ে। ইউটিউব আসলে খিচুড়ি প্ল্যাটফর্ম। আর এখন তো ইউটিউবে বিশ্বে মন্দার জন্য বিজ্ঞাপন নেই।" রূপঙ্করও জানালেন, নিজের চ্যানেল থেকে দারুণ কিছু টাকা তিনি পাননি। " পয়সা খরচ করে যত সংখ্যক ভিডিয়ো কনটেন্ট নিয়মিত আপলোড করতে হয় তা এখন সম্ভব নয়," সাফ কথা রূপঙ্করের।
আরও পড়ুন- এ সব সেক্সিস্ট কমেন্ট কিন্তু কর্ণ বা আদিত্যকে হজম করতে হয়নি: রেহা
৬০০-র কাছাকাছি ছাত্রছাত্রী তাঁর। কিন্তু লকডাউনের সময়ে সুর নয়, আতঙ্ক নিয়ে বললেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী শ্রাবণী সেন, "কমিউনিটি গ্যাদারিং -এর ভয়ে সামনের এক বছর আর শো হবে না। সব ছাত্রছাত্রীকে তো অনলাইনে গান শেখাতে পারছি না। আর গান না শিখিয়ে আমি টাকা নিতে পারব না কোনও দিন। খুব খারাপ সময়। জানি না শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনানোর জন্য আর অনুষ্ঠানে ডাক পাব কি না!"
লকডাউন শেষে অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে কি আলো দেখতে পারবে বাংলা গান?— ফাইল চিত্র
সামনের কয়েক মাস ধরে কুয়েত, লাস ভেগাস, অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল শিল্পী মনোময় ভট্টাচার্যের। করোনার জেরে সব বাতিল। "এই মুহূর্তে জীবনের কোনও মানে খুঁজে পাচ্ছি না। আগে তো মানুষ খাবে তার পর গান শুনতে কনসার্টে যাবে। আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে বিনোদন কিন্তু বিলাসিতা। পারিশ্রমিক কমবে। শো নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে। মানুষ বলবে, গান? ও ফেসবুকেই শুনে নেব। এখন প্রয়োজন মিউজিশিয়ান গিল্ড। আমাদের মধ্যে কোনও মিল নেই। সহশিল্পীর গান শুনে মানুষ 'আহা' বলতে ভুলে গিয়েছে বা অতিরিক্ত 'আহা' বলছে। এই কি সময়?" প্রশ্ন মনোময়ের।
আরও পড়ুন- লকডাউনে ‘বিশেষ বন্ধু’ ইউলিয়া ভন্তুরের সঙ্গেই পানভেলের ফার্মহাউজে আটকে সলমন?
নিয়মিত মঞ্চের আলো তৈরি করেন তিনি। উত্তীয় জানা দর্শক থেকে শিল্পী, সকলের আলোদাত্রী। এই উত্তীয় জানার ঘরে আজ অন্ধকার! "অনুষ্ঠানের ভিত্তিতে ডেলি পেমেন্ট পাই আমরা। এখন তো বাদই দিলাম। সামনের এক বছর হলগুলো খাঁ খাঁ করবে। আগে মানুষ হলের জন্য দু’-তিন মাস অপেক্ষা করত। এখন যেচে দিলেও কেউ হল নেবে না। জমায়েতে কে যাবে? ক’জন মানুষ টাকা খরচ করে মঞ্চে আসবে? এখন সবাই সঞ্চয় করবে। জানি না, আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তাদের কত দিন টানতে পারব!"
ইতিমধ্যেই জুনিয়র আর্টিস্ট, বিশেষ করে মিউজিশিয়ানদের নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছেন সঙ্গীতশিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য। "এই ছেলেমেয়েদের কেমন করে সাপোর্ট দেওয়া যাবে? সেটাই ভেবে চলেছি। দিশাহারা হয়ে যাচ্ছি। আমি জানি এই ছেলেমেয়েদের কেউ দামি যন্ত্র কিনেছে। ভেবেছে অনুষ্ঠানের টাকায় শোধ করবে। লোন, বাড়ির দায়িত্ব, আমার মনে হয় লকডাউন উঠে গেলে এরা আর কি এই ইন্ডাস্ট্রিতে থাকবে?"
আরও পড়ুন- শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি মাধবী মুখোপাধ্যায়ের স্বামী নির্মল কুমার
বরাবর দলের কথা ভেবে আসছেন সঙ্গীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র। তিনি জানালেন, "এমন অনেক সময় হয়েছে, বাইরে শো করতে গিয়েছি, আমার দলের সব মিউজিশিয়ান যেতে পারেনি। যে যায়নি তাকেও টাকা দিয়েছি। কিন্ত এখন তো আমিই বন্ধ হয়ে গিয়েছি। কী হবে জানি না! আমরা গান গেয়ে জীবন চালাই। এই সময় বিনা পয়সায় রোজ যদি মানুষকে গান শোনাই ভবিষ্যতে কী হবে আমাদের? নতুনরা এই সময় গান করুক। আমরা করলে কিন্তু বিপদ!" এই বিপদের জায়গা থেকে শিল্পীদের বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে। শান্তনু মৈত্র সে প্রসঙ্গেই বললেন, "ডিজিটালে গানবাজনা হোক। কিন্তু সে ক্ষেত্রে মনিটাইজেশন জরুরি। নইলে শিল্পীরা বাঁচবে না।"
বিপদ থাকলেও একঘেয়ে গৃহবন্দি জীবন থেকে মানুষ অবশেষে ফিরবে গানের কাছেই বিশ্বাস শান্তনু মৈত্র থেকে অনুপম রায়ের। গৃহবন্দি মানুষ গানেই মুক্তির পথ দেখবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy