গুলাবো সিতাবো ছবির একটি দৃশ্য।
বন্ধ হয়েছে মাল্টিপ্লেক্স। সিনেমা হলে ঝুলছে তালা। অ্যামাজন, নেটফ্লিক্স সমেত বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম সুযোগ বুঝেই কষিয়েছে ছক্কা। অমিতাভ-আয়ুষ্মান অভিনীত ছবি ‘গুলাবো সিতাবো’ অ্যামাজনে মুক্তি পেতে চলেছে আগামী ১২ জুন। বিদ্যা বালন অভিনীত ‘শকুন্তলা দেবী’-র জন্যও বেছে নেওয়া হয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্মকেই।
ফ্যান্সি ড্রেস আর হাজার আলোর ঝলকানিতে প্রিমিয়ার পার্টি নয়। করোনা-কালে হিট ছবির প্রিমিয়ার হচ্ছে ড্রয়িংরুমে, বেডরুমে, বালিশে মাথা রেখে।
শুধু এই দুই ছবিই নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাষার সুপারহাইপড ছবিগুলোর জন্য পরিচালক-প্রযোজকরা বেছে নিচ্ছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্মকেই। জ্যোতিকা অভিনীত দক্ষিণী ছবি ‘পোনামগল বনধল’, কীর্তি সুরেশ অভিনীত তামিল ছবি ‘পেঙ্গুইন’, মালয়ালম ছবি ‘সুফিয়ান সুজাতায়াম’ এবং দু’টি কন্নড় ছবি ‘ল’ এবং ‘ফ্রেঞ্চ বিরিয়ানি’ও মুক্তি পেতে চলেছে সেই অ্যামাজনেই।
আরও পড়ুন: আচমকাই চার ধারাবাহিক বন্ধের সিদ্ধান্ত, প্রতিবাদে মুখর টেলিপাড়া
অ্যামাজন প্রাইমের ব্যপ্তি সুবিশাল। প্রায় ২০০টি দেশের মানুষ এই প্ল্যাটফর্মে ছবি, সিরিজ দেখতে পারেন। সুতরাং এই প্ল্যাটফর্মে ছবি মুক্তি মানে শুধু দেশের মানুষের কাছেই নয়, ছবি পৌঁছে যাচ্ছে বিদেশের মাটিতেও।
কিন্তু সিনেমা মাধ্যমের রদবদল, তা তো ইতিহাসে প্রথম বার! এমনটাও যে হতে পারে তা তো এর আগে ধারণা করতে পারেননি কেউই। ছবি মুক্তি পাবে, মানুষ পপকর্ন-কোল্ড ড্রিঙ্কস সহযোগে বন্ধুবান্ধব, পরিবার নিয়ে দেখতে যাবে, এমনটাই তো রেওয়াজ ছিল এত দিন। বিনোদন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না, আর এই মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখা, একটু খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়েই মানুষ খুঁজে নিত মুক্তির আস্বাদ। দু’মাসে হঠাৎই চিত্রবদল।
এই পুরো ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন কারা? পরিচালক? না। প্রযোজক? না। অভিনেতা? না। তা হলে? বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সের মালিক এবং সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলের কর্মকর্তারা। আর শুধু কর্মকর্তারাই বা বলা যায় কী করে? যে মানুষটি সিনেমা হলে টিকিট দেখতেন, যে ছেলেটি অন্ধকার হলে আলো দেখিয়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতেন, তিনি আজ বেকার। শহরতলির বেশ কিছু সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমা হলের ঝাঁপ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। “একে রোজগার নেই, তার উপর খাবারে থাবা বসিয়েছে ওটিটি। এই অবস্থায় সিনেমা হল চালানো তো দূর, দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পারব কি না, তাই জানি না”, বলছিলেন ব্যারাকপুরের এক সিনেমা হলের মালিক।
“মাঝে এমন অবস্থা হয়েছিল দু’বেলা খাবার জোটাতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। ত্রাণ নিয়ে সংসার চালাচ্ছি। জানি না এ ভাবে আর কত দিন”, বলছিলেন শহরতলির সিনেমা হলের এক টিকিট বিক্রেতা। এরই মধ্যে ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কি লকডাউন পরবর্তী সিনেমা হলের ভবিষ্যৎ আরও খানিক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিল?
যে মানুষটি সিনেমা হলে টিকিট দেখতেন, যে ছেলেটি অন্ধকার হলে আলো দেখিয়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতেন, তিনি আজ বেকার। ছবি: সংগৃহীত।
প্রথমত, মানুষের মনে করোনা ভীতি এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস যে ভাবে মনে গেঁথে গিয়েছে, লকডাউন পরবর্তী কালে সিনেমা হল খুললেও হলেও কি সেখানে ভিড় জমাবে জনতা? দ্বিতীয়ত, একটা বেশ বড় সংখ্যক মানুষের পকেট শূন্য। সে ক্ষেত্রে সিনেমা হলে গিয়ে পপকর্ন সহযোগে সিনেমা দেখার মতো বিলাসিতা কি তাঁরা আদৌ দেখাবেন? অ্যামাজন, নেটফ্লিক্সে যেখানে একবারেই টাকা ভরিয়ে নিলে চোখের সামনে হাজির হয়ে যায় লাখখানেক সিনেমা, হাজার খানের ওয়েবসিরিজ, সেখানে দাঁড়িয়ে সিনেমা হল কি ক্রমেই ব্রাত্য হয়ে যেতে চলেছে? প্রশ্ন রয়েই যায়।
আরও পড়ুন: হাতে কাজ নেই, পেটে ভাত নেই, বিনোদনের দুনিয়ায় চোখের জলও নেই: রুদ্রনীল ঘোষ
গোটা বিষয়টি নিয়ে আইনক্সের তরফ থেকে শুক্রবারই একটি প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। সেখানে সমস্ত পরিচালক প্রযোজককে বলা হয় যাতে তাঁরা থিয়েটার রিলিজ থেকে এ ভাবে মুখ ঘুরিয়ে না নেন। একই বিবৃতি প্রকাশ করা হয় পিভিআর-এর পক্ষ থেকেও।
তবে আইনক্সের প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গিল্ডও তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। টুইটারে গিল্ডের তরফে লেখা হয়েছে, ‘দামি সেট ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। শুটিং বন্ধ অথচ ব্যাঙ্কে সুদের হার চড়ছে। সিনেমা হল খুললেও, সেখানকার পরিস্থিতি হলফ করে বলা যায় না। বিদেশে ছবির ব্যবসাও অনিশ্চিত। এই সব ভেবে ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য কিছু প্রযোজক ডিজিটালের পথে হাঁটছেন।’
এ দিন আইনক্সের পক্ষ থেকে পঙ্কজ লাডিয়া বলেন, “খুব তাড়াতাড়ি মাধ্যমটা ঘুরে গেল। দু’মাসের মধ্যেই প্রযোজক, পরিচালক ঠিক করে নিলেন তাঁরা অনলাইন রিলিজ করবেন। কারণ তাঁরাও বুঝছেন মানুষ এখন বাড়িতে। আর এ সময় তাঁর চোখ আটকে রয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই। এখানেই ছবির ব্যবসা হবে। সে দিক থেকে তারা ঠিক। কারণ বিজ্ঞাপনের খরচ বেঁচে যাচ্ছে, প্রোমোশনও করতে হচ্ছে না। সেই টাকাটা পুরোটাই প্রযোজকের পকেটে থেকে যাচ্ছে। মানুষ ছবিটিও দেখছে। সেখান থেকেও লাভ হচ্ছে।’’
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাষার সুপারহাইপড ছবিগুলোর জন্য পরিচালক-প্রযোজকরা বেছে নিচ্ছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্মকেই। ছবি: সংগৃহীত।
অর্থাৎ যদি ৮০/৯০ কোটি বাজেটের ছবি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যায়, তা হলে সেই ছবির প্রযোজকের জন্য কিন্তু তা বেশ লাভের। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, বড় বাজেটের ছবি যেমন ‘সূর্যবংশী’, ‘৮৩’, এইগুলোর ভবিষ্যৎ কী হতে চলেছে?
পঙ্কজ আশাবাদী এই ছবিগুলো বড় পর্দাতেই মুক্তি পাবে। কিন্তু মানুষ সিনেমা হলে যাবে? সোশ্যাল গ্যাদারিং করবে? আইনক্স লেজারের সিইও অলোক টন্ডন বললেন, “দর্শকের সুরক্ষাই আমাদের কাছে সবার আগে। তাই সিনেমা হল খুললে কোনও পেপারের মাধ্যমে কোনও খাবারের অর্ডার নেওয়া হবে না। সমস্ত সদস্যের থার্মাল স্ক্রিনিং হবে। স্যানিটাইজার স্টেশন করা হবে। ঘন ঘন জীবাণুনাশক দিয়ে সিনেমা হল পরিষ্কার করা হবে। যেখানে জনসমাবেশ বেশি সেখানে এক ঘণ্টা অন্তর স্যানিটাইজ করা হবে। প্রত্যেক শো-র পর প্রেক্ষাগৃহ স্যানিটাইজ করা হবে। কর্মীদের গ্লাভস এবং মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হবে। সবাই যাতে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলেন সে ভাবেই টিকিট দেওয়া হবে। এমন ভাবে সিনেমার শো রাখা হবে যাতে যাতে দর্শকেরা একই সঙ্গে না ঢোকেন এবং বেরোন।”
একই সুর শোনা গেল নবীনা সিনেমা হলের মালিক নবীন চৌখানির গলাতেও। দর্শকের সুরক্ষার জন্য একগুচ্ছ ভাবনাচিন্তা যে তিনিও করেছেন সে কথাও জানালেন তিনি। আর ওটিটির খাঁড়া? সে নিয়ে অবশ্য বিশেষ ভাবিত নন তিনি। বললেন, “ব্যবসা তো মানুষ করবেই। সবাই সমস্যায় রয়েছে। এ অবস্থায় যদি সেই প্রযোজক কিছু রোজগার করতে চান তো করুন না। আমি নিশ্চিত, সিনেমা হল খুললে আবার মানুষ আসবে। আর মানুষ যাতে সুস্থ থাকে, সুরক্ষিত থাকে, সে দায়িত্বও আমরা যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করব।”
লকডাউন পরবর্তী কালে মানুষ আবারও হলমুখো হবে কি না সে উত্তর সময়ই দেবে। তবে হাল ছাড়তে নারাজ শহর, শহরতলির ছোট, বড় সিনেমা হল। মালিকেরা আশাবাদী মানুষ আবার হলমুখো হবেন। প্রিয় হিরোর এন্ট্রিতে শিস, যুগলের কোয়ালিটি টাইম কাটানোর মুহূর্তে, কোলাহলে আবারও মুখর হয়ে উঠবে সিনেমা হল, এই আশায় বুক বাঁধছেন সকলেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy