‘যে যাই বলুক তিনি আমার মহানায়ক’
একুশ শতকের মাঝামাঝি পৌঁছেও বাঙালি আঁকড়ে আছে তার প্রাচীন দুটো গর্ব। এক, বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া। যেখানে ছাপ ফেলতে পারেননি উত্তমকুমারও। দুই, উত্তমকুমার স্বয়ং। মৃত্যুর ৪২ বছর পরেও তিনি সমসাময়িক। ৯৫ বছরেও বাঙালির মুগ্ধতা তাঁকে কিংবদন্তি তৈরি করে দিল। ২৪ জুলাই আর ৩ সেপ্টেম্বর আজও তাঁর জন্য বরাদ্দ।
এই দিন দুটো এলে আপনা থেকেই ভাবি, কেন আমরা এত উত্তম পাগল?
একাধিক কারণ আছে। উত্তমকুমারের মতো ও রকম হাসি আর কেউ হাসতেই পারলেন না! আজও না। আমার চোখ মাত্র দু’জন অভিনেতার হাসিতে সেই ছায়া দেখতে পেয়েছে। প্রথম জন মুম্বইয়ের প্রথম সুপারস্টার রাজেশ খন্না। দ্বিতীয় জন আমাদের তাপস পাল। কিন্তু সেটা ছায়ামাত্র। তার বেশি কিছু নয়। মহানায়কের ওই স্বর্গীয়, ঝলমলে হাসি তাঁকে না ভোলার কারণের অর্ধেক জুড়ে। বাকি তাঁর বাঙালিয়ানা। যদি কাউকে চোখ বন্ধ করে ভাবতে বলা হয়, ধুতি-পাঞ্জাবিতে সেজে ওঠা আদ্যন্ত এক বাঙালির কথা মনে করুন, ২৬ কোটি বাঙালি নির্দ্বিধায় মনে করবেন উত্তমকুমারকে। যে যাই বলুক তিনি আমার ‘মহানায়ক’। তাঁর প্রতিটি ছবি, তাঁর চলনবলন সেই বাঙালিয়ানার জীবন্ত প্রতীক। ওই রকম সুন্দর চেহারায় গিলে করা পাঞ্জাবি, চুনোট ধুতি পরে ভুবন ভোলানো হাসি হাসতে পারেন এক মাত্র উত্তমকুমার। তৃতীয় কারণ একটু অন্য রকম। উত্তমকুমারের নাম অরুণ চট্টোপাধ্যায় হলেও প্রথম নাম কিন্তু দাদুর দেওয়া ‘উত্তম’। তিনি তাই মধ্যম বা অধম নন, সব সময়েই উত্তম।
এগুলো তাঁর ‘ম্যাটিনি আইডল’ হওয়ার কারণ। অভিনেতা উত্তমকুমার আলাদা। অগ্রদূত পরিচালিত ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এ তিনি রোম্যান্টিসিজমের খোলস ছাড়তে পারেননি। অথচ পরিচালক পার্থ প্রতিম চৌধুরীর ‘যদু বংশ’ ছবিতে নিজেকে ভেঙেচুরে নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন তিনি। একটাও ছবিতে ‘নায়ক’ ইমেজ ভাঙতে না পারা উত্তমকুমার এই ছবিতে যথার্থ চরিত্রাভিনেতা। একই কথা বলব সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবি নিয়েও। ওই ছবির দ্বিতীয় সংস্করণ আর হবে না। কারণ, সেই পরিচালকও নেই, অভিনেতাও নেই। আমি নিজে বহু বার মহানায়ককে সযত্নে বেশ কিছু চরিত্রে অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি। আমার সেই অভিনয় অনুসরণের চেষ্টা হয়ে থেকে গিয়েছে। আমরা কেউ আর এক জন উত্তমকুমার হয়ে উঠতে পারলাম না। এক বার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, তাপস পাল আর আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সুযোগ পেলে ওঁর কোন চরিত্রে অভিনয় করব আমরা। বুম্বা, তাপস মতামত দিয়েছিলেন। আমি স্পষ্ট জানিয়েছিলাম, ওঁর অভিনয়ের ধারপাশে পৌঁছতে পারব না। সুতরাং, ওঁর কোনও চরিত্রে অভিনয়ের ধৃষ্টতাই আমার নেই। আজ বলছি, তার পরেও ‘যদু বংশ’-এর প্রতি আমার প্রচণ্ড লোভ!
এ বার আসি মানুষ উত্তমকুমারের কথায়। তাঁকেও সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমি তখন মাত্র ২২। ছবি পরিচালনার ইচ্ছে জেগেছে। সরাসরি মহানায়কের ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে গিয়ে যোগাযোগ করেছিলাম। একটি কয়লা খনির গল্প নিয়ে ছবির কথা ভেবেছিলাম। তাতে খনির প্রধান হবেন উত্তমকুমার। দাদা গল্প শুনে রাজি। বেণুদি অর্থাৎ সুপ্রিয়া দেবী কচুরি, কষা মাংস, মিষ্টি দিয়ে গিয়েছেন। মহানায়কের একটি ঘর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। কাঠের প্যানেল করা সেই ঘরে একটি ছোট শয্যা, কয়েকটি চেয়ার, টেবিল। দাদা খাটে বসে। আমি চেয়ারে। রূপটানহীন উত্তমকুমারের পরনে সাদা পাঞ্জাবি, সিল্কের লুঙ্গি। ওই পোশাক নিয়ে, হাসি নিয়ে, তাকানো নিয়ে, ম্যানারিজম নিয়ে মহানায়ক যেন গ্ল্যামারের চূড়ান্ত প্রতিমূর্তি। পুরুষ হয়েও সে দিন ওই রূপ দেখে আমার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল! এক জন মানুষ সব দিক থেকে এত সুন্দর কী করে হতে পারে? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও ভীষণ সুন্দর ছিলেন। নিখুঁত সুন্দর। তবু উত্তমকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো নয়।
দাদা চলে না গেলে আমার পরিচয় বোধহয় পরিচালক দীপক চক্রবর্তী হত। একেক সময় নিজেই ভাবি এই উত্তম ম্যাজিক আর কত বছর? মন উত্তর দেয়, যত দিন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া বেঁচে থাকবে। আজও দেবীপক্ষের সূচনার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’ না শুনলে দিনটা মাটি হয় বাঙালির। এই অনুষ্ঠান থেকে যাওয়া মানেই মহানায়কও থেকে যাবেন। মহালয়া শোনায় ভাটার টান এলে বুঝতে হবে, উত্তম যুগও অস্তাচলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy