সমুদ্র ভালবাসেন তুহিনা।
কাঁথির মেয়ে আমি, সাগরকন্যা। দিঘা আমার বাড়ি থেকে গাড়িতে বড়জোর ১৫ মিনিট। ছুটি কাটাতে সচরাচর দেখেছি সমুদ্রপাড়েই হাজির হই। এ বার যেমন চলে গিয়েছিলাম গোয়ায়।
বড়দিনের আগে গোয়া যেন দ্বিতীয় পার্ক স্ট্রিট! আলোয় আলো চারপাশ। কালো কালো মাথা গিজগিজ করছে। ছোট-বড় গির্জায় মাঝ রাত থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে ক্যারল। গত দু’বছর অতিমারির চোখরাঙানিতে সবাই কুঁকড়ে ছিলেন। এ বছর যেন প্রাণ পেয়েছেন। সেই আনন্দ উস্কে দিতেই ঢালাও আয়োজন রাজ্য জুড়ে। অবশ্য এ বছর নয়, প্রতি বছরই গোয়া বড়দিনে এ ভাবেই উষ্ণ, প্রাণবন্ত। মার্চ পর্যন্ত চলে তার রেশ।
আগেও বড়দিনে গোয়ায় এসেছি। দেখেছি, সমুদ্র-রাজ্যে বড়দিনের সন্ধে যেন মেয়ের বিয়ের এক রাত। সারা মাস জুড়ে তার আয়োজন। গলি থেকে রাজপথ সেজে ওঠে আলোকমালায়। ছোট-বড় নিশিঠেক, রেস্তরাঁ থেকে পাঁচতারা হোটেলগুলো যেন সেজেগুজে স্বপ্নপুরী। গান বাজছে। ক্রিসমাস ট্রি প্রতি রেস্তরাঁর দোরগোড়ায়। তাতে রঙিন তারা, ঘণ্টা, উপহারের বাক্স, জরির ফিতে। আর খানা-পিনার অঢেল আয়োজন। প্রায় কেউই রেস্তরাঁয় বসে খান না। বাইরে হাল্কা ঠান্ডায় চলে ভুরিভোজ। দূর থেকে বইছে সমুদ্রের নোনা হাওয়া। এই আনন্দ, এই রোমাঞ্চ গিয়ে উপভোগ করার।
তাল মিলিয়ে রয়েছে কেক-পেস্ট্রি-কুকিজ আর গোয়ার বিশেষ পদের সুস্বাদ। আমি ভীষণ মেছো। সমুদ্রের কোলে বেড়ে ওঠা বলেই হয়তো। মাছ-ভাত পেলে আর ওজনের কথা মাথায় থাকে হয়! গোয়াতে গিয়েও তাই মাছের পদ খুঁজি। গোয়ানিজ সামুদ্রিক মাছের কারি আর ভাত, বরাবরের প্রিয় মেনু। আমরা যে রকম চালের ভাত খাই, তেমন নয় কিন্তু। একটু বেঁটে, মোটা দেখতে হয়। খুব স্বাদু। এ ছাড়া স্থানীয় তাওয়া ফ্রাই, রাভা ফ্রাই তো আছেই। আর আছে কম খরচে রকমারি পানীয়। গোয়ায় যাবেন, কিন্তু পান করবেন না- পারবেনই না। ওখানকার বাতাসও যেন সুরার গন্ধে নেশাতুর! এক কিলোমিটারের মধ্যে ওখানে কম করে তিনটি দোকান চোখে পড়বে। আমি অবশ্য এই নিয়ে বেশি পরীক্ষানিরীক্ষায় যাই না। ওয়াইনেই আটকে থাকি। তবে স্থানীয় কিছু বিয়ার রয়েছে। বার্লি বা গম থেকে তৈরি। শুনেছি যেমন সুস্বাদু তেমনই হাল্কা।
গোয়ায় গেলে কলকাতার সঙ্গে আরও একটি মিল চোখে পড়বে। উত্তর কলকাতা যেমন সব সময় যেন উৎসাহ, উদ্দীপনায় কাঁপে। আর দক্ষিণ কলকাতা নিজের মধ্যেই বুঁদ। সেখানে যে যার, সে তার। উত্তর গোয়াও সে রকমই। গানে, আলোয়, লোকের ভিড়ে, খাওয়াদাওয়া মিলিয়ে রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র। দক্ষিণ গোয়া বরং নিঝুম। ছায়া ছায়া অন্ধকারে মোড়া। ছোট ছোট কয়েকটি রেস্তরাঁ। সেখানে রাত ১২টার মধ্যে খানাপিনার পাট চুকে যায়। অঞ্চলের বাসিন্দাদের এত হুল্লোড় যেন না-পসন্দ।
গোয়ায় এই শীত-উৎসবে জড়ো হন বিশ্বের নানা প্রান্তের বাসিন্দারা। সমুদ্রপাড়ে মানুষের ঢল নামে। ওঁরা কী ভীষণ স্বাধীনচেতা! অন্তর্বাস ছাড়াই ঢোলা টপ আর পালাজো পরে ঘুরছেন। সাঁতারের পোশাকে সি-বেডে শুয়ে সেঁকে নিচ্ছেন রোদে। কেউ ও ভাবেই হয়তো চুলে গোয়ার বিশেষ বিনুনি বাঁধছেন। গোয়া এ ভাবেই জীবনকে যেন আগল মুক্ত করে দু’হাত বাড়িয়ে ডাকে সারাক্ষণ।
সে ডাক ছড়িয়ে পড়ে মাথার উপরের খোলা নীল আকাশেও। তার ছায়ায় সমুদ্র হয়ে ওঠে আসমানি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy