Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫

লকডাউন পরবর্তী শুটিং-এ নায়ক-নায়িকার ঘনিষ্ঠ দৃশ্য কি বাদ পড়ছে?

চোখে, ঠোঁটে লেগে থাকার দিন বোধহয় শেষ হতে চলল। কারণ, করোনা।

'লাভ আজ কাল পরশু' ছবিতে মধুমিতা এবং অর্জুন।

'লাভ আজ কাল পরশু' ছবিতে মধুমিতা এবং অর্জুন।

বিহঙ্গী বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২০ ১৩:৫১
Share: Save:

নীল আকাশের নীচে ঘনিষ্ঠ হয়ে নাচছেন নায়ক-নায়িকা। পরমব্রত এসে রাইমাকে বলছেন, “আমার চোখে ঠোঁটে গালে তুমি লেগে আছ।” অর্জুন এবং মধুমিতার অন্তরঙ্গ দৃশ্য আচমকাই উষ্ণতার পারদ চড়িয়ে দিচ্ছে স্ক্রিন জুড়ে... এ সবই বোধহয় এখন অতীত! চোখে, ঠোঁটে, গালে লেগে থাকার দিন বোধহয় শেষ হতে চলল। কারণ, করোনা! লকডাউন উঠবে এক দিন। শুটিংও শুরু হবে ঠিক। কিন্তু অন্তরঙ্গ দৃশ্য, নায়ক-নায়িকার মাখো মাখো প্রেম, বেড সিন? করোনার চিন্তা মাথায় নিয়ে সে সব দৃশ্যে অভিনয় করতে কতটা স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন অভিনেতারা? আর সে সব বাদ দিয়েই বা কী করে ছবি বানানো সম্ভব? চিত্রনাট্যের সঙ্গে আপোস নাকি কলাকুশলীদের সুরক্ষা? এগিয়ে কে?

পরিচালক সুজিত সরকার অনেক দিন আগেই প্রশ্নটা তুলেছিলেন, “করোনাতঙ্ক কেটে গেলেও মনের আতঙ্ক কাটবে কী করে?” চুমুর দৃশ্য বাদই দিন, নিদেনপক্ষে হাত ধরাধরি বা কাছে এসে কথা বলা— সে সবেও যে সেন্সর! কী ভাবছে সিনে দুনিয়া? রাজ চক্রবর্তী কী বলছেন? “কলাকুশলীদের সুরক্ষার সঙ্গে আপস যেমন আমি করতে পারব না, ঠিক তেমনই আমার সিনেমার প্লট বদলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, পরিচালক হিসেবে আমি কখনওই চাইব না, সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে।” তা হলে উপায়? “যেহেতু আমি ধারাবাহিকের প্রযোজনাও করি সে ক্ষেত্রে কাটশটের ব্যবহার করা যেতে পারে। মানে ধরুন দু’জন মানুষের সিন। কিন্তু দু’জনের ডেট ম্যাচ করল না। এক জনের সিনটা আগে তুলে নিয়ে পরের জনেরটা অন্যদিনে তুলে দু’টিকে মিলিয়ে দেওয়া— এ ঘটনা তো আগেও হয়েছে। আর যেহেতু ফ্যামিলি ড্রামাগুলোতে খুব একটা ঘনিষ্ঠ দৃশ্য দেখানো হয় না, তাই কিছুটা কম্প্রোমাইজ করে ধারাবাহিকে কাজ চালিয়ে নেওয়া যেতে পারে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু সিনেমার ক্ষেত্রে গোটা ব্যাপারটাই বেশ অসুবিধের। তবে আমি এই মুহূর্তে সবসময় চাইছি সরকারি গাইডলাইন মেনে চলতে”, বলছিলেন রাজ।

তবে চিট শট হোক আর কাট শট, ক্যামেরার কারিকুরিতে সেই ‘ফিল’ নিয়ে আসা কি আদৌ সম্ভব? অভিনেত্রী প্রিয়ঙ্কা সরকার গোটা ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণই কনফিউজড। কাজে ফেরা যেমন জরুরি। একই সঙ্গে নিজের নিরাপত্তার কথাও মাথায় রাখতে হবে তাঁকে। বাড়িতে ছেলে ছোট, তার জন্য চিন্তা রয়েছে। বিপরীতে অভিনেতা যে করোনাবাহক হবেন না তার কী গ্যারান্টি? তবে এরই মধ্যে প্রিয়ঙ্কা বলছিলেন, “শুটিং শুরু হলে মেকআপ আর্টিস্টরা মেকআপ করবেন। টেকনিশিয়ান কলাকুশলী মিলিয়ে বেশ একটা বড় টিম। আমার মনে হয় যে মুহূর্তে এত জন মানুষের সংস্পর্শে আমরা আসতে বাধ্য হব, কোথাও গিয়ে হয়তো চিন্তাটাও কেটে যাবে। কারণ দূরত্ব বজায় রাখার গাইডলাইন মেনে হয়তো শর্ট ফিল্ম বা কিছু সিরিজ শুট করা যেতে পারে, কিন্তু ফুল ফ্লেজেড ছবি বানানো যাবে বলে মনে হয় না। ছবির প্রয়োজনে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য বা ফাইট সিকোয়েন্স তো আসবেই। সেটাই তো স্বাভাবিক।”

সুজিতের তোলা সেই প্রশ্ন বারে বারেই ঘুরপাক খাচ্ছে টলিপাড়ার অন্দরে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্ক্রিপ্ট লেখা তো প্রকারান্তরে ছবির গুণগত মানের সীমাবদ্ধতা বাড়াবে। ‘সোয়েটার’ ছবির পরিচালক শিলাদিত্য মৌলিক যেমন বললেন, “সত্যিই বুঝতে পারছি না এ ভাবে কী করে ছবি বানাব। চিত্রনাট্যও বা এ ভাবে লেখা হবে কী ভাবে?” শোনা যাচ্ছে, বলিউডেও নাকি ইতিমধ্যেই কাটছাঁট চলছে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের চিত্রনাট্যে।

সারেগামা ইন্ডিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্ধার্থ আনন্দ কুমার আশা করছেন, জুলাই থেকে তাঁদের আগামী প্রজেক্টের কাজ শুরু করতে পারবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে তিনি সুপারিশ করেছেন ব্লকিং টেকনিক। কী সেটি? ওই চিট শটের মতোই খানিকটা। যা যা অন্তরঙ্গ দৃশ্য রয়েছে, তা শুট করা হবে সবার শেষে, যাতে কোনও বিপদ হলেও প্রজেক্টে তার আঁচ না পড়ে। কিন্তু সেখানেও তো সুরক্ষা কোথাও না কোথাও গিয়ে বিপাকে পড়ছে। কী করণীয়? কেউ জানেন না। বাংলা ছবি-সিরিজের সাবালকত্ব নিয়ে প্রশ্নটা বহু দিনের।

ইদানিং ‘চরিত্রহীন’, ‘সিন’-এর মতো ওয়েবসিরিজের হাত ধরে তা সাবালকত্বের দিকে এগোলেও করোনাকালে আবারও সেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করার ভঙ্গিমায় নাচের যুগ বুঝি ফেরত আসতে চলেছে, তেমনটাই মনে করছেন ইন্ডাস্ট্রির একাংশ। এক পরিচিত পরিচালক তো কিছুটা রেগে গিয়েই বললেন, “একে তো আমার ছবির কাজ অর্ধেক হয়ে পড়ে রয়েছে। তার মধ্যে নতুন ছবির কাজ শুরু হলেও সেখানেও হাজারটা প্রশ্ন। কোন অভিনেতা চুমু খেয়ে রিস্ক নেবে বলুন তো? শয্যাদৃশ্য? ও সব তো ভাবতেই পারছি না। ছেড়ে দিন, একটা বিয়ের দৃশ্য শুট করতেও তো খান কুড়ি লোক দরকার। সে ক্ষেত্রে কী হবে? কিছুই জানি না। এ ভাবে আর যাই হোক, সিনেমা হয় না।” সঠিক উপায় যে কী সে উত্তরের খোঁজে ইন্ডাস্ট্রির সব মহল। সিনেমাটোগ্রাফার সুদীপ চট্টোপাধ্যায় যেমন বলছিলেন, ‘‘একটা জিনিস হতে পারে, যাঁরা এই সব দৃশ্যে অভিনয় করবেন তাঁদের কোয়রান্টিনে রাখা হতে পারে। শুট শুরু করার আগে তাঁদের শারীরিক চেকআপ করে নিলে রিস্ক ফ্যাক্টর কিছুটা কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।’’ কিন্তু কাস্ট এবং ক্রু মেম্বারদের কোয়রান্টিন করে রাখার মতো প্রস্তাব কি এতটাই সহজ? টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে ছবির বাজেট বলিউডের মতো বিশাল নয়। আর তা ছাড়া কলাকুশলীরাও এতে রাজি হবেন তো? প্রশ্ন রয়েই যায়!

অভিনেত্রী পার্ণো মিত্র বর্তমানে ‘কোড়া পাখি’ ধারাবাহিকের প্রধান চরিত্রে। পরিস্থিতি যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে চিত্রনাট্যেরও যে বদল আনতে হবে সে ব্যাপারে তিনি একমত। তাঁর কথায়, “ধারাবাহিকে সে ভাবে ঘনিষ্ঠ দৃশ্য না থাকলেও যতটুকু যা থাকে তাতে ওই ভরসা করতে হবে পরিচালক-চিত্র্যনাট্যকারদের উপর।’’ সুতরাং, করোনা-উত্তরকালে স্ক্রিপ্ট লেখার সময়েও বারে বারেই মাথায় রাখতে হবে এই সব নির্দেশিকা। হাত খুলে চিত্রনাট্য লেখার দিন কি তবে শেষ? লেখক যদি মন খুলে চিত্রনাট্য লেখার সুবিধাই না পান তা হলে যা ব্যক্ত করতে চাইছেন তা স্ক্রিনজুড়ে পরিস্ফুট হবেই বা কী করে?

অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরা যেমন মনে করছেন, এই গোটা ব্যাপারটায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ লেখকদের। ওই সমস্ত দৃশ্য বাদ দিয়ে কী ভাবে তাঁরা গোটা বিষয়টা সাধারণের কাছে তুলে ধরবেন তা দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছেন তিনিও। কিছু দিন আগে অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম বার ওয়েব সিরিজে কাজ করেছেন তিনি। বাড়িতে বসে তৈরি করা সেই সিরিজ দর্শকমহলে সাড়া ফেললেও যখন দু’-আড়াই ঘণ্টা ছবির শুট করতে হবে তা কী করে হবে, সে বিষয়ে সন্দিহান তিনি। “যা দিন আসছে তাতে সেটে কাছের বন্ধুদেরও অচ্ছুতের মতো ট্রিট করতে হবে। কিছু করার নেই। আউটপুট তো পরের কথা, আগে শুটিং ফ্লোরে কী ভাবে সব রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলব, সেটাই বুঝতে পারা যাচ্ছে না। তবে উপায় কী?’’ প্রশ্ন অঙ্কুশের।

আর এই গোটা বিষয়টিকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে চান প্রযোজনা সংস্থা ম্যাজিক মোমেন্টস-এর কর্ণধার এবং লেখক লীনা গঙ্গোপাধ্যায়। “ব্যক্তিমানুষ হিসেবেও তো কলাকুশলীদের আপত্তির প্রশ্ন থেকেই যায়। সুরক্ষার জন্য তিনি সেই দৃশ্যে অভিনয় না-ও করতে পারেন। এটা তো একটা নতুন চ্যালেঞ্জ আমাদের সবার কাছে। এ ভাবেই লিখতে হবে চিত্রনাট্য। আমার ব্যক্তিগত ভাবে এই চ্যালেঞ্জ নিতে কোনও আপত্তি নেই। কারণ, করোনা আবহ সম্পর্কে সাধারণ মানুষও ওয়াকিবহাল। আর গল্পের মধ্যেই যদি সেটা খানিক বলে দেওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে অসুবিধে না হওয়ারই কথা।’’

দিন কয়েক আগেই মুক্তি পেয়েছে পরিচালক অরুণাভ খাশনবীস পরিচালিত ওয়েব সিরিজ ‘সিন’। এই প্রথম বার বাংলা সিরিজে ‘ফুল ন্যুডিটি’ দেখান হয়েছে এই সিরিজে। কিন্তু যদি এই সিরিজের আইডিয়াই পরিচালকের মাথায় আসত করোনা কালে? কোনওভাবেই তো তা শুট করা সম্ভব হত না? অরুনাভ বলছিলেন, “সে তো একশবার। এই সময় এই সিরিজের ভাবনা মাথায় এলেও তা হোল্ডে রাখতে হত। কিন্তু তাই বলে তো সিনেমা, সিরিজ গোটা ইন্ডাস্ট্রি চুপচাপ বসে থাকতে পারে না? এটাই তো সময় যৌনতা, ঘনিষ্ঠ দৃশ্য বাদ রেখে অন্য কোনও টপিক নিয়ে ভাববার। কে বলতে পারে এই সময়টাই হয়তো ভাল ভাল কিছু গল্পের আইডিয়ার জন্ম দিতে চলেছে।

ঘনিষ্ঠ দৃশ্য, চুমু, বেডসিন এ সব না হয় বাদ-ই দেওয়া গেল কিন্তু ফাইট সিন? হাওয়ার মতো উড়ে এসে নায়ক ধাঁই করে ভিলেনকে উপড়ে ফেললো মাটিতে। গলা টিপে টানতে টানটে সোজা দেওয়ালে ঠুকে দিল মাথা। সে খানেও যে হিউম্যান টাচ! পরিচালক ইন্দ্রাশিষ আচার্য আবার এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটাই পন্থা দেখতে পাচ্ছেন। যে যে অভিনয় করবেন শুটিং শুরু করার আগে তাঁদের টেস্ট করানো। “যদি রিপোর্ট নেগেটিভ আসে তা হলে তো যে কোনও দৃশ্যেই অভিনয়েই আর বাধা থাকবে না”, বলছিলেন পরিচালক।

দিন কয়েক আগেই মুক্তি পেয়েছে পরিচালক অরুণাভ খাশনবীশ পরিচালিত ওয়েব সিরিজ ‘সিন’। এই প্রথম বার বাংলা সিরিজে ‘ফুল ন্যুডিটি’ দেখানো হয়েছে এই সিরিজে। কিন্তু যদি এই সিরিজের আইডিয়াই পরিচালকের মাথায় আসত করোনা কালে? কোনও ভাবেই তো তা শুট করা সম্ভব হত না? অরুণাভ বলছিলেন, “সে তো একশোবার। এই সময় এই সিরিজের ভাবনা মাথায় এলেও তা হোল্ডে রাখতে হত। কিন্তু তাই বলে তো সিনেমা, সিরিজ, গোটা ইন্ডাস্ট্রি চুপচাপ বসে থাকতে পারে না? এটাই তো সময় যৌনতা, ঘনিষ্ঠ দৃশ্য বাদ রেখে অন্য কোনও টপিক নিয়ে ভাবার। কে বলতে পারে, এই সময়টাই হয়তো ভাল ভাল কিছু গল্পের আইডিয়ার জন্ম দিতে চলেছে।

ঘনিষ্ঠ দৃশ্য, চুমু, বেডসিন— এ সব না হয় বাদই দেওয়া গেল। কিন্তু ফাইট সিন? হাওয়ার মতো উড়ে এসে নায়ক ধাঁই করে ভিলেনকে উপড়ে ফেলল মাটিতে। গলা টিপে টানতে টানতে সোজা দেওয়ালে ঠুকে দিল মাথা। সেখানেও যে হিউম্যান টাচ! পরিচালক ইন্দ্রাশিস আচার্য আবার এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটাই পন্থা দেখতে পাচ্ছেন। যাঁরা যাঁরা অভিনয় করবেন শুটিং শুরুর আগে তাঁদের টেস্ট করানো। “যদি রিপোর্ট নেগেটিভ আসে তা হলে তো যে কোনও দৃশ্যেই অভিনয়েই আর বাধা থাকবে না”, বলছিলেন পরিচালক।

সবাই যখন চিন্তিত, কেউ কেউ যখন ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয়ে সরাসরি না বলে দেবেন বলে জানিয়েছেন, ঠিক সেই সময়েই মধুমিতা সরকারের মুখে উল্টোপুরাণ, “বডি টেম্পারেচার মেপে কাজে আসতে হবে। চরিত্রের প্রয়োজনে যদি আমাকে করোনা-কালেও ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করতে হয় করব। এত প্যানিক করে কী করব?’’

কী হবে কেউ জানেন না। তবু কলাকুশলী থেকে টেকনিশিয়ান... সেটে ফিরতে মরিয়া সবাই। কত দিন রোল, ক্যামেরা, অ্যাকশনে মুখর হয়নি টলিপাড়া!

অন্য বিষয়গুলি:

lockdown tollywood raj chakraborty madhumita sarkar Coronavirus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy