Advertisement
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Kunal Vs Tollywood

মুখ্যমন্ত্রী কি দলীয় প্রচারমূলক ছবি চাইছেন? কুণালের শ্লেষে প্রশ্ন টলিউডের অন্দরেই

কেউ দলীয় প্রচারমূলক ছবির পক্ষে। কারও দাবি, এ ভাবে ছবি বানানো সম্ভব হতে পারে না। কেউ আবার মনে করছেন এটি দ্বিচারিতা হচ্ছে। কুণাল ঘোষের সমাজমাধ্যমের বক্তব্য নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে মুখ খুলল টলিউড।

Image Of Mamata Banerjee, Kaushik Sen, Haranath Chakraborty, Lovely Maitra, Kunal Ghosh

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, হরনাথ চক্রবর্তী, লাভলি মৈত্র, কুণাল ঘোষ। গ্রাফিক্স: সনৎ সিংহ।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২৪ ১৬:৫৭
Share: Save:

আপাতত কুণাল ঘোষের বক্তব্য ঘিরে জোর তরজা রাজ্য-রাজনীতিতে। শুক্রবার মুক্তি পেয়েছে সনোজকুমার মিশ্র পরিচালিত ছবি ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’। যদিও এ দিন ছবিটি পশ্চিমবঙ্গের কোনও প্রেক্ষাগৃহে দেখা যায়নি। কিন্তু খবর, অন্যান্য রাজ্যে এই হিন্দি ছবিটি মুক্তি পেয়েছে। ছবিমুক্তি নিয়ে আদালত কোনও আপত্তি না করলেও, এ রাজ্যের কোথাও কেন ছবিটি মুক্তি পেল না, তার কারণ এখনও রহস্যাবৃত। যদিও পরিবেশক শতদীপ সাহা (তিনি এই ছবি পরিবেশনার দায়িত্বে নেই) মনে করছেন, “ যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এই মুহূর্তে রাজ্য চলেছে, তাতে পরিবেশকেরা এই ছবি পরিবেশনার দায়িত্ব নিতে অসম্মত হবেন, এটাই স্বাভাবিক।” এই ছবি নিয়ে কুণালের বক্তব্য, নিজেদের প্রয়োজনে কিছু শিল্পী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে থাকেন, ছবিও তোলেন। কিন্তু শাসকদলের দুঃসময়ে তাঁরা বেপাত্তা! এখানেই থামেননি তিনি। বলিউডের উদাহরণ তুলে প্রশ্ন করেছেন, ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর পাল্টা ছবি কেন টলিউডে তৈরি হবে না? আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন বিধায়ক-অভিনেতা কাঞ্চন মল্লিক। তাঁর বক্তব্য, “আমি ছবি দেখিনি। তবে বাংলাকে কলঙ্কিত করতে কোনও ছবি হলে নিশ্চয় কথা বলব। পদের জন্য নয়। সাধারণ নাগরিক হিসাবে বলব। ছবি দেখিনি। দেখব।”

বক্তব্য রাখতে গিয়ে কুণাল যে সমস্ত টলিউড অভিনেতা ও পরিচালকের দিকে আঙুল তুলেছেন, তাঁদের ‘সুবিধাবাদী’ বলতেও পিছপা হননি। এই বক্তব্য মেনে নিচ্ছে টলিউড? জানতে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তী, অভিনেতা কৌশিক সেন, পরিচালক নেহাল দত্ত, বিধায়ক-অভিনেত্রী লাভলি মৈত্র, অভিনেতা রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

সাল ২০০১। বাম জমানায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী। সেই সময় হরনাথ চক্রবর্তীর ছবি ‘প্রতিবাদ’ মুক্তি পেয়েছিল। সেই ছবিতে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর ছায়ায় গড়ে ওঠা একটি চরিত্রে ছিলেন লাবণী সরকার। পরিচালকের দ্বিতীয় ছবি ‘তুলকালাম’ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে কেন্দ্রে রেখে তৈরি। মুখ্য অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী। এ দিন সেই দুটো ছবির কথা উল্লেখ করে বর্ষীয়ান পরিচালক বলেন, “আমিই প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে ছবি বানিয়েছিলাম। বাম নেতারা অনেক জায়গায় সেই ছবি মুক্তি পেতে দেননি। তার পরেও ছবি দুটো বাম্পার হিট।” তাঁর দাবি, তিনি আবারও মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ছবি বানাতে ইচ্ছুক। কিন্তু বাণিজ্যিক ছবি বানাতে যে খরচ বা সময় লাগে, সেই সব এখন পাওয়া দুষ্কর। ফলে তিনিও হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। পাশাপাশি, টলিউডের কিছু ব্যক্তিত্বকে ‘সুবিধাবাদী’ তকমা দেওয়া নিয়েও সরব তিনি। তাঁর আশ্বাস, যখনই প্রয়োজন পড়বে তখনই টলিউডকে পাশে পাবেন মুখ্যমন্ত্রী।

অতীতে বামদল ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত ছিলেন কৌশিক সেন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তাঁকে পথ নামতে দেখেছেন রাজ্যবাসী। বর্তমান পরিস্থিতিতে দলীয় ভাবমূর্তি রক্ষা করতে প্রচারমূলক ছবির সত্যিই কি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে? মঞ্চ-পর্দার জনপ্রিয় অভিনেতার মতে, “সিনেমা, থিয়েটার এ ভাবে তৈরি হয় না। এটা ফরমায়েশি জিনিস নয়।” তাঁর পাল্টা দাবি, কুণাল যে ছবি নিয়ে এত কথা বললেন সেই ছবির এতটাও জোর নেই যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বা তাঁর দলের উপরে প্রভাব ফেলবে, ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেবে। একই ভাবে তিনি বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল্‌স’ বা সুদীপ্ত সেনের ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র উদাহরণ দেন। বলেন, “এই ছবি দুটোও বিরোধী দলের প্রচারমূলক ছবি। সেগুলো যদি প্রভাব ফেলতে না পারে, তা হলে সনোজকুমারের ছবিও পারবে না।” কৌশিকের আরও উপলব্ধি, প্রচারমূলক ছবি করে কোনও লাভ হয় না। কুণাল অকারণ আশঙ্কিত হচ্ছেন। তাঁর দাবি, বাংলার পরিচালক-অভিনেতারা যথেষ্ট ভাল ছবি বানাচ্ছেন। আরও ভাল ছবি কী করে তৈরি করা যায় সে বিষয় নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। এই ধরনের বিষয় নিয়ে নয়। কুণালের দ্বিতীয় অভিযোগ মেনে নিয়েছেন কৌশিক। তিনি সমর্থন করে বলেছেন, “১৪ অগস্ট ‘রাত দখল’-এর রাত থেকে মঞ্চ এবং পর্দার এক জনপ্রিয় অভিনেত্রী প্রতিবাদে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন, নিজেকে ‘অরাজনৈতিক’ আখ্যা দিয়ে। তিনি ২১ জুলাইয়ের মঞ্চেও ছিলেন। ওই মঞ্চ কিন্তু পুরোপুরি রাজনৈতিক। ওই মঞ্চ থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বার্তা দেন। এ বার যদি শাসকদল তাঁকে প্রশ্ন করে, অরাজনৈতিক ব্যক্তি হলে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে কেন ছিলেন, কী উত্তর দেবেন?” অভিনেতার দাবি, যাঁরা সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন তাঁদের নিয়ে কোনও বক্তব্য নেই। কিন্তু যাঁরা রাজনীতিতে নেই অথচ রাজনৈতিক প্রচার, মিছিলে থাকেন তাঁদের এই বক্তব্যের মুখোমুখি হতেই হবে।

পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীর মতোই ২০১৯-এ মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ‘বাঘিনী’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন নেহাল দত্ত। কুণালের এই বক্তব্যের পরে তিনিও কি বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাববেন? জবাবে নেহালের দাবি, “আমি আবারও মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে ছবি বানাব। তার প্রস্তুতিও চলছে। কুণালদার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তাড়াতাড়িই কথা বলব।” কুণালের বক্তব্য সমর্থন করে তাঁর দাবি, “সত্যিই এখন এই ধরনের ছবি তৈরির প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী নিজে আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে পথে নেমেছেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এক অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার পরেও তাঁকে অকারণ কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে।“ নেহাল তাই মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে আবারও ছবি তৈরিতে রাজি।

আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে কুণাল প্রসঙ্গে নিজের মতামত জানাতে দ্বিধা করেননি বিধায়ক-অভিনেত্রী লাভলি। কুণাল ‘সুবিধাবাদী’ তকমা দিয়েছেন টলিউডের কিছু মানুষকে। লাভলি এই প্রসঙ্গে সরব। তাঁর কথায়, “আমার পরিষেবা, কাজকর্ম কী রকম, তা আমার নির্বাচনী এলাকার মানুষ সবচেয়ে ভাল বলতে পারবেন।” লাভলির মতে, ভাল সময় যেমন তিনি সারা ক্ষণ মুখ্যমন্ত্রীর পাশে থাকেন, খারাপ সময়েও থাকবেন। এটা নতুন করে বলে বোঝানোর কোনও মানে দেখছেন না তিনি। পাশাপাশি এও দাবি করেন, “শুধুই রাজনীতিবিদ অভিনেতারাই নন, যাঁরা আক্ষরিক অর্থে অরাজনৈতিক, তাঁরাও সময়ে-অসময়ে দিদির পাশে থাকেন। পায়ে পা মেলান। এটা সবাই দেখতে পান।” তাই কুণাল কেন এ রকম মন্তব্য করলেন, বুঝতে পারছেন না বিধায়ক-অভিনেত্রী। তবে তিনি ছোট পর্দার অভিনেত্রী, তাই ছবি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

রাহুল অরুণোদয় ইন্ডাস্ট্রি, ইন্ডাস্ট্রির বাইরে— সর্বত্র বাম-ঘনিষ্ঠ অভিনেতা বলেই পরিচিত। তিনিও কি কুণালকে সমর্থন করে টলিউডের একাংশকে ‘সুবিধাবাদী’ বলবেন? অভিনেতা কুণালের বক্তব্যকে একেবারে ফেলে দেননি। তাঁর মত, “কুণালদা আমাদের বলেননি, সেটা আমরা জানি। যাঁরা নিচ্ছেন তাঁদেরই বলেছেন। যাঁরা শাসকদলের আস্থাভাজন, তাঁদের উদ্দেশে এই বক্তব্য। আমার গায়ে তাই লাগছে না।” এ দিন তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, 'দ্য কেরালা স্টোরি’ এ রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীই মুক্তি পেতে দেননি, বিজেপির প্রচারমূলক ছবি, এই কারণ দেখিয়ে। আজ কোন মুখে সেই দলের একজন মুখপাত্র নিজের দলের প্রচারমূলক ছবি তৈরির বার্তা দিচ্ছেন?” রাহুলের যুক্তি, ভাবনা একমুখী হওয়া দরকার। একবার মুখ্যমন্ত্রী দলীয় প্রচারমূলক ছবি দেখাতে দেবেন না, আবার তাঁর দলের মুখপাত্র প্রয়োজনে নিজের দলের জন্য প্রচারমূলক ছবি বানানোর বার্তা দেবেন, এটা হতে পারে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE