কোয়েল মল্লিক। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
মহালয়ায় আবার দেবী দুর্গার সাজ। অভিনয়। আমি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাই। গত বছরও মহালয়ায় দুর্গা সেজেছিলাম। প্রতি বছর দেবীর বেশে সেজে ওঠার প্রস্তাব এলেও আমার একঘেয়ে লাগে না। কখনও মনে হয় না, এই তো গত বছর একই সাজে সেজেছিলাম! বরং প্রত্যেক বারই এক অন্য ধরনের নতুন আবেগ কাজ করে।
শৈশব থেকেই দেখে আসছি, আমার বাড়িতে প্রতিমা গড়া হয়। তার পর পুজো হয়। তাই দুর্গোৎসব মানেই আমার কাছে আবেগের স্মৃতিজাল। ঈশ্বর তো সব সময়ই আমাদের চালনা করছেন। কিন্তু এই নির্দিষ্ট সময়টা আমরা তাঁকে নিয়ে উৎসবে মেতে থাকি। মা দুর্গা আছেন মানে সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনি সবাইকে সুবুদ্ধি দেবেন। আমি এমনটাই ভাবি। যখন স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষ, তখন থেকেই মহালয়ায় দুর্গা সাজা শুরু আমার। প্রত্যেক বারই নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছি। মা দুর্গার কত রূপ! কখনও তিনি কাত্যায়নী, কখনও তিনি পার্বতী বা সতী। পুরাণে তাঁকে নিয়ে কত গল্প রয়েছে! পুরাণের গল্প নিয়ে আজকাল খুব একটা চর্চা অবশ্য হয় না। তাই এই ধরনের অনুষ্ঠান টিভির পর্দায় তুলে ধরলে বাচ্চারাও দেখে।
মা দুর্গার প্রতিটি রূপই অশুভ বধের জন্য নির্মিত। সেখান থেকেই শিখি আমরা কী ভাবে নিজের ভিতরের অশুভ বা নেতিবাচক শক্তি বা বোধ দমন করতে হয়। নিজের মনকে কী ভাবে শুদ্ধ করতে হয়, সেটাও এর থেকেই শেখা যায়। তাই মা দুর্গা সাজার প্রস্তাব এলেই আমি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। শুধু একটা নির্দিষ্ট রূপে সেজ অভিনয় করতে হবে, বিষয়কে এত হালকা ভাবে দেখি না। বয়সের সঙ্গে নিজের উপলব্ধিও বদলে যায়। পাঁচ বছর আগের আমি আর বর্তমানের আমি— একটা ফারাক রয়েছে। আর নিজে মা হওয়ার পরে এই অনুভূতিগুলো আরও বদলে গিয়েছে।
আমার ছোটবেলায় বাবা বেতারে মহিষাসুরমর্দিনী চালিয়ে দিতেন। ভোর চারটেতেই শুনতে হবে। তখন এই অনুষ্ঠান শোনার আর অন্য কোনও সময় বা উপায় থাকত না। আগের রাত থেকে বাবা সব প্রস্তুত করে রাখতেন। ছোটবেলায় হয়তো কিছুই বুঝতাম না। বাবা নিজের উদ্যোগে পুরোটা শোনাতেন। সেই জায়গা থেকে মনে হয়, পরের প্রজন্মকেও শোনানো তো আমাদের দায়িত্ব। তাই কবীরকেও আমি ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে তুলে মহিষাসুরমর্দিনী শোনাই। এত দিনে মহালয়া নিয়ে ওর একটা ধারণা তৈরি হয়েছে।
কবীর ছোট থেকেই দেখে আমি শুটিংয়ে যাই। কিন্তু ও জানত না, শুটিং ব্যাপারটা আসলে কী। ওর দেখা প্রথম শুটিং ফ্লোরই হল মহালয়ার অনুষ্ঠান। আমার সাজগোজ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। শুধু তৃতীয় নয়ন নিয়ে ওর মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছিল। সাজগোজ তুলে ফেলার পরে ওই তৃতীয় নয়নের খোঁজ করছিল। সেটা বোঝাতে গিয়ে তো আমি হিমশিম খেয়েছি।
এ বছরও স্টার জলসার মহালয়ার অনুষ্ঠান 'রণং দেহি'-এর শুটিংয়ে আমি নিজের কার্তিককে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। ও খুব মন দিয়ে সবটা দেখেছে। সে দিন দুর্গা ও অসুরের লড়াইয়ের দৃশ্যের শুটিং ছিল। আমি ওকে শেখাই, কখনওই মারামারি করবে না। সেই দিন ও নিজেই দেখল, মা নিজেই লড়াই করছে। পরে বোঝালাম, যে লড়াই করছিল, সে তোমার মা নয়। ওই লড়াইটা মহিষাসুরের সঙ্গে মা দুর্গা করছেন।
এ বছর মল্লিক বাড়ির দুর্গাপুজোর ১০০ বছর। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতি অন্য বারের মতো নয়। তাই অন্য বারের মতো আনন্দ উদ্যাপন হবে না। আরজি কর ঘটনার পরে প্রতি দিন নির্যাতিতার জন্য প্রার্থনা করেছি। একটা বিষয় আমার ভাল লেগেছে। এই শহরের প্রতিটি মানুষ অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ছেন। আমাদের ন্যায়বিচার চাই। অনেকেই ধৈর্য রাখতে পারছেন না। কিন্তু বিচারের তো একটা সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি রয়েছে। সেটা পেতে গেলে ধৈর্য ধরতে হবে। এর আগেও বহু ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই ঘটনার নৃশংসতা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। মায়ের কাছে তাই একটাই প্রার্থনা, এমন যেন আর কখনও না ঘটে।
এই প্রতিবাদী আন্দোলনে বহু তারকাও নেমেছেন পথে। কিন্তু, তাঁদের নিয়ে নানা কটাক্ষ করা হচ্ছে। কে কী ভাবে প্রতিবাদ করবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। এমনও দেখেছি, বন্ধু প্রতিবাদ করতে যাচ্ছেন, তাই তাঁকে সঙ্গ দিতে আরও এক জন যাচ্ছেন। এর তো কোনও দরকার নেই। এটা তো কোনও প্রতিযোগিতা নয়। এই প্রতিবাদে সৎ থাকাটাই জরুরি। মূল বিষয় থেকে নজর সরে যায়, এমন বহু কিছু ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আসলে যাঁরা নিজেদের জীবনে সুখী নন বা নিজেকে সর্বক্ষণ আতশকাচের নীচে রাখেন, তাঁরাই অন্যদের ভুল-ত্রুটি ধরতে থাকেন। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। তাই এ বছর মায়ের কাছে একটাই প্রার্থনা, মানুষের যেন সুবুদ্ধি হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy