(বাঁ দিকে) শুভ্রজিৎ মিত্র, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় (ডান দিকে)। ছবি: সংগৃহীত।
২৮ বছরের সম্পর্ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক। ঋতুপর্ণ ঘোষের একটি ধারাবাহিকে দ্বিতীয় সহকারী পরিচালক হিসাবে বিনোদন দুনিয়ায় হাতেখড়ি। তখনও পড়াশোনা করছি। বুম্বাদা সেই ধারাবাহিকের প্রযোজক। ফলে, ওঁকে পরিচালনা করব, তাই নিয়ে বাড়তি কোনও প্রস্তুতি বা চাপ আমার ছিল না। বরং আমি নিশ্চিন্ত। বুম্বাদা এত বছর ধরে অভিনয়ের ফলে প্রযুক্তির দিক থেকে নিখুঁত। নিজে পরিচালনা করেছেন। ফলে, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল দুর্দান্ত বোঝেন। আমার কোনও ত্রুটি থাকলে দাদা দায়িত্ব নিয়ে সেটা সামলে দেবেন, জানতাম। দাদা আমাকে চাপে ফেলেছেন অন্য বিষয়ে। তখন আমরা বোলপুরে ‘দেবী চৌধুরাণী’র শুটিংয়ে। ও দিকে এলাকায় খবর চাউর, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এসেছেন। ব্যস, মেকআপ ভ্যানের বাইরে তিলধারণের জায়গা নেই। পিলপিল করছে নানা বয়সের লোক। তাঁরা সবাই একবার বুম্বাদাকে দেখবেন। নিজের মেকআপ ভ্যান থেকে দাদার মেকআপ ভ্যানে পৌঁছতে পারছি না! ওঁর দেহরক্ষীরা রয়েছেন। বাড়তি দেহরক্ষীও আনা হয়েছে। এত জন মিলে ভিড় সামলানো যাচ্ছে না! ভ্যান থেকে শুটিং লোকেশনের দূরত্ব মিনিট দশেকের। দাদা হাঁটছেন। বাকিরা যেন দেবদর্শন সারছেন! শহরতলি বা শহরের বাইরে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এখনও ‘মুকুটহীন সম্রাট’। আজ জন্মদিনে তাই দাদার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় আজীবন যেন পুরুষের ঈর্ষা, রমণীর গর্ব হয়ে থাকেন।
এ বার আসি ওঁর নিয়মানুবর্তিতা প্রসঙ্গে। এই অংশটুকু পড়লেই আপনারা বুঝবেন, কেন বয়স ওঁকে ছুঁতে ভায় পায়! বুম্বাদার সংযম শেখার মতো। সেটে যত ক্ষণ থাকেন, বেশির ভাগ সময় তরল খাবার খান। যাতে শরীর ভারী না লাগে। কাজ করার শক্তি বজায় থাকে। দুপুরেও কোনও দিন ভরপেট খেতে শুনিনি। মেকআপ ভ্যানে যখন বিশ্রাম নিতেন তখনও তিনি অভিনীত ‘চরিত্র’। বাড়তি কথা নয়। হয় সংলাপ পড়ছেন, নয়তো চোখ বুজে অভিনয় নিয়ে ভাবছেন। সেটে আসার আগে মনোযোগী ছাত্রের মতো আমাকে প্রশ্ন করতেন, “রাজা, আজ কী ভাবে শুটিং করছিস?” আমি এঁকে ওঁকে বুঝিয়ে দিতাম। ওঁর মস্তিষ্ক যেন কম্পিউটার। ওই যে গেঁথে যেত, আর ভুলতেন না। অনেক সময় আমরা আলোচনা করে শুটিংয়ের স্টাইল, অভিনয়ের ধারা নিজেদের মতো করে বদলে নিয়েছি। আমরা ওঁর সময়ানুবর্তিতার কাছে হেরে যেতাম। দাদা বরাবর আমাদের থেকে পাঁচ মিনিট এগিয়ে। নিজের ছবির চিত্রনাট্যকার নিজেই। কারণ, পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিত্রনাট্য লেখা হলে শুটিংয়ের সময় খুব সুবিধে হয়। তাই প্রথম দিন থেকে ‘দেবী চৌধুরাণী’র ‘ভবানী পাঠক’ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। আমি তো জানি, ওঁকে নিলে আমাকে বেশি খাটতে হবে না।
সত্যিই খাটতে হয়নি। ওঁর উপন্যাস আগেই পড়া। তার পরেও আবার পড়েছেন। আমার গবেষণার সমস্ত কিছু পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন। সে সব খুঁটিয়ে বুঝে নিয়েছেন। বললে হয়তো আপনারা বিশ্বাস করবেন না, বুম্বাদার ফিটনেস যে কোনও অল্পবয়সিকে লজ্জায় ফেলে দেবে। এমনকি অ্যাকশন দৃশ্যেও। তাই ওঁকে বাকিদের মতো বেশি প্রশিক্ষণ নিতে হয়নি। চরিত্রের খাতিরে ওজন বাড়িয়েছেন। গোঁফদাড়ি রেখেছেন। যাতে রূপসজ্জা নিখুঁত দেখায়। বাকিটা সোমনাথ কুন্ডুর র হাতযশ। প্রত্যেক দিন ধৈর্যের সঙ্গে এক ঘণ্টা ধরে রূপটান নিতেন। আবার শুটিং শেষে এক ঘণ্টা ধরে তুলতেন। প্রথম যে দিন রূপটান নিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন, আমার অর্ধেক দুশ্চিন্তা ওঁকে দেখেই মিলিয়ে গেল! আমার জীবন্ত ‘ভবানী পাঠক’। অ্যাকশন দৃশ্যে ওঁর অভিনয় দেখে আমিই থ! ওঁর বয়সে আমি এলে আমিই পারব না! সব রকম সতর্কতা নিয়েই বিশাল বটগাছের উপর থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন। ওঁকে দেখতে দেখতে ‘দ্য লাস্ট অ্যাকশন হিরো’ ছবিটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমরা যৌথ পরিবার। বাবা-কাকা-জেঠু মিলিয়ে প্রচুর লোকজন। আমাদের বাড়িতে মহানায়ক, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের নিত্য আনাগোনা ছিল। সেই জায়গা থেকে শুটিং শেষে অনেকেই জানতে চেয়েছেন, উত্তমকুমারের সার্থক উত্তরসূরি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়? এই একটা উত্তর কেবল আমার কাছে নেই। আমার দাদা আমার ছবিতে কাজ করে গিয়েছেন। নিজ দায়িত্বে। বাকিদের আগলে নিয়ে। পরিবারের মাথা যেমন হন আর কি! এটাই আমার কাছে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। দুই কালজয়ীর মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার করা আমার পক্ষে অসম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy