অ্যালেক্স রাদারফোর্ড এর ‘এম্পায়ার অব দ্য মুঘল, রেইডারস ফ্রম দ্য নর্থ’ বইটির ছায়া অনুসারে নির্মিত সিরিজ ‘দি এম্পায়ার’।
প্রায় ছ'শো বছর আগেকার ইতিহাস, তারই ঘূর্ণিপাকে ঘটনার ঘনঘটা মোট আটটি এপিসোড জুড়ে। দর্শকের মগজ এবং চেতনা জড়িয়ে পড়ে বহু পরিচিত চরিত্র এবং ঘটনার পরতে পরতে।
অ্যালেক্স রাদারফোর্ড এর ‘এম্পায়ার অব দ্য মুঘল, রেইডারস ফ্রম দ্য নর্থ’ বইটির ছায়া অনুসারে নির্মিত সিরিজ ‘দি এম্পায়ার’। পরিচালক মিত্রাক্ষরা কুমার। প্রযোজক মনীষা আদবানি এবং মধু ভোজয়ানি।
কাহিনীর শুরু ১৪৯৪ সালে, ফরঘনা প্রদেশ থেকে। ভাবী মুঘল সম্রাট বাবর তখন চোদ্দ বছরের। ফরঘনার অধিপতি বাবরের পিতা উমর শেখ। পুত্র বাবরের সঙ্গে তিনি কাব্য আলোচনা করেন, হিন্দুস্তান যাওয়ার স্বপ্ন এঁকে দেন কিশোর পুত্রের চোখে। কিন্তু সেই সময়েই পিতার মৃত্যু কিশোর বাবরকে এক ধাক্কায় সাবালক করে দেয়।
ও দিকে সমরনায়ক সাইবানি খান অত্যাচার চালাচ্ছে, সমরখন্দ, ফরঘনায়। সবাইকে তার বশ্যতা স্বীকার করতে হবে। সাইবানির দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ ডিঙিয়ে বাবর সমরখন্দে প্রবেশ করলেন; কিন্তু শেষরক্ষা হল না। দুর্ধর্ষ সাইবানি ফরঘনায় এসে আটক করল বাবরের প্রিয় দিদি খানজাদা এবং মা কুতলুগকে। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে বাবর সমরখন্দ জয় করেন। মুক্ত করেন বন্দিদের। বাবরের জীবনের প্রথমে তাঁর নানি এবং পরবর্তীতে দিদি খানজাদার গুরুত্ব দেখানো হয়েছে বিপুল পরিমাণে।
রাজতন্ত্রের আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে গল্প এগিয়ে চলে। ক্ষমতার জন্য সর্বস্ব পণ, প্রাসদের মধ্যেই নানা ষড়যন্ত্র, সম্রাটের অহং, অভিমান, যন্ত্রণা... চেনা জীবনের বাইরে রাজকীয় যাপনের গল্প। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস; জীবন এবং মৃত্যু... গা ঘেঁষে চলতে থাকে সমান্তরাল রেখায়। ভালবাসা এবং বিশ্বাসের সঙ্গেই অবিশ্বাস এবং হত্যার অভিঘাত দর্শককে বিমুঢ় করে রাখে।
তারই মধ্যে বাবরের বিয়ের উৎসব, যুদ্ধের দামামার মাঝখানে হঠাৎ আলোর ঝলকানি। হিন্দুস্তান প্রবেশের পথ কাবুল। দিদি খানজাদার পরামর্শে কাবুলের রাজপরিবারের সঙ্গে বাবর বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে বাধ্য হন। এ দিকে সাইবানি খানের অত্যাচারে বিপর্যস্ত আশপাশের সমস্ত উপরাজ্য। সবাই জোট বাঁধতে শুরু করে। এরই মধ্যে সাইবানি ফরঘনায় আসে আবার; করায়ত্ত হন খানজাদা। তাঁর আত্মত্যাগের বিনিময়ে মুক্তি পান রাজপরিবারের সবাই। কিন্তু বাবর প্রিয় দিদির এই হেনস্থা মেনে নিতে পারেননি। তিনি সমরখন্দের বাইরে অপেক্ষা করেন, সাইবানিকে পরাস্ত করার জন্য। অবশেষে সাইবানির মৃত্যু এবং ভাইবোনের মিলন। যদিও এর পিছনে ছিল বোন খানজাদার গূঢ় পরিকল্পনা এবং আত্মত্যাগ।
আসলে যে কোনও সাফল্য ও উত্তরণের পিছনেই থাকে একক এবং যৌথ আত্মত্যাগ। জীবনের দর্শন তাই বলে। আর ইতিহাস তো জীবনেরই প্রতিফলন।
সময় লাফিয়ে এগিয়ে যায় আরও ১৮ বছর। প্রবেশ ঘটে বাবরের পুত্র, সদ্য কৈশোর পেরনো হুমায়ুন এবং কামরানের। ১৪৯৪ থেকে গল্প পৌঁছে যায় ১৫২৬-এ... দর্শক মুখোমুখি হয় প্রথম পানিপথের যুদ্ধের। বাবরের আজন্মের স্বপ্ন হিন্দুস্তান। প্রবল প্রতিপক্ষ ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্ত করে সেখানে প্রবেশ বাবর এবং তাঁর সৈন্যদের কাছে একেবারেই অলীক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই অসম্ভবই সম্ভব হল বারুদের ব্যবহারে। জয় হল বাবরের। হিন্দুস্তানের সম্রাট হলেন বাবর। কিন্তু পুত্র হুমায়ুনের তীব্র অসুস্থতা বাবরকে ভেঙে চুরমার করে দিল। অবধারিত মৃত্যু এসে দাঁড়াল পাশে! ভাইয়ের আসন্ন বিচ্ছেদ মেনে নিয়ে খানজাদা লিখে যাচ্ছেন 'বাবরনামা'। সেই সঙ্গে হুমায়ুনের সম্রাট হওয়ার ঘোষণার মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যায়ে পৌঁছয় কাহিনি।
ইতিহাস যখন চলচ্চিত্রে পদার্পণ করে, কিছু মায়া এসে বসে তার পরিসরে, সে পরিবর্তিত হয়।এ ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, ইতিহাস এখানে একা নয়। তাকে আশ্রয় করে আছে কাহিনির বিপুল তরঙ্গ।
ভাল লাগে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া দুর্গ, রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল, গল্পের বিস্তৃত ব্যাপ্তির সঙ্গে টুকরো টুকরো চেনা, অচেনা ছবি। অস্ত্র শিক্ষারত বাবর এবং অলিন্দের আড়াল থেকে তা দেখে দেখে অস্ত্র শিক্ষা শাহাজাদী খানজাদার। বরফকুচি মেখে প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা বাবর এবং তাঁর সেনাবাহিনী। ঘোড়ার খুরে উড়ে আসা ধুলো, উট, হাতির প্রবল দাপাদাপি, ছ'শো বছর আগেকার জনজীবন এবং বাজারের টুকরো ছবি।
চিত্রনাট্য অবশ্যই নিপুণ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন বাবরের নানিজান। এ চরিত্রটিতে শাবানা আজমি অপূর্ব। বাবরের চরিত্রে কুনাল কপূর চমৎকার অভিনয় করেছেন এবং তাঁকে মানিয়েও গেছে। কিশোর বাবর মেহরুস মিরও বেশ ভাল। ভাল লাগে খানজাদার ভুমিকায় দ্রাস্টি ধামি এবং হুমায়ুন রূপে আদিত্য শীলকে। আর সাইবান খানের সেই মনোবিকারগ্রস্ত চরিত্র, চরম নৃশংসতা্র সঙ্গে গোপনে চেপে রাখা অবমাননা, প্রেম ইত্যাদি ডিনো মোরিয়ার অভিনয়ে সঠিক ভাবেই ফুটে উঠেছে।
পরিচ্ছদ মোটামুটি মানিয়ে গেছে। তবে গ্রাফিক বেশ দুর্বল। আর একটা বিষয় খামতি রয়েছে, তা হল সময়ের ব্যবধান, যা যথাযথ মানা হয়নি। হিন্দুস্তান জয়ের পরেই যেন দ্রুত বাবরের মৃত্যু এবং হুমায়ুনের অভিষেক। কিন্তু ইতিহাসের হিসেব বলছে, মাঝখানে কয়েকটি বছর রয়ে গেছিল, হিন্দুস্থানের সম্রাট হিসেবে বাবরের অবস্থান!
আর একটা বিষয় হল, পানিপথে বাবরের কাছে বারুদ যে ভাবে আসার কথা, সেটা যেন ঠিক দেখান হল না। ইতিহাসকার ইখতেদার আলম খান ও আরও কিছু ইতিহাসবিদদের তথ্য অনুযায়ী, পানিপথে সাধারণ তোপের সঙ্গে তখনকার যুগের বিভিন্ন ধরনের বন্দুকও ছিল।
এত বড় আয়োজনে কিছু ত্রুটি তো থাকেই। সে সমস্ত পেরিয়ে ‘দি এম্পায়ার’ দর্শককে নিয়ে যাবে ইতিহাস এবং রাজকীয় জীবনের গভীরে। যার এক দিকে উটের লম্বা গলার মতো নিস্পৃহতা, অন্য দিকে হাতির বিপুল উপস্থিতির আভিজাত্য, ঘোড়ার খুরের অনুষঙ্গে তীব্র গতিময়তা। ইতিহাসের সুর দর্শককে মুগ্ধ করবে, হৃদয় ছুঁয়ে যাবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy