পড়াশোনার পাশাপাশি শখ ছিল অভিনয় আর ছবি তোলার। দ্বিতীয় শখকেই জীবনের প্রথম পেশা করেছিলেন। শিক্ষানবিশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ফোটোগ্রাফি সংস্থা, দিল্লির এ দাস অ্যান্ড কোং-এ। বজায় ছিল অভিনয়ের নেশাও। রামলীলা-য় সীতার ভূমিকায় অভিনয় করবেন বলে শিমলায় গিয়েছিলেন। তাঁর বিপরীতে রামের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন হিন্দি ছবির আর এক অভিনেতা ও অমরীশ পুরীর ভাই মদন পুরী। প্রকাশ্য মঞ্চে এটাই ছিল প্রাণের প্রথম অভিনয়।
১৯৪২ সালে মুক্তি পায় প্রাণের প্রথম হিন্দি ছবি ‘খানদান’। এই ছবিতে তিনি পুরোদস্তুর রোমান্টিক নায়ক। তাঁর নায়িকা নুরজাহানের তখন বয়স মাত্র ১৫। লম্বায় অনেকটাই খাটো। ফলে ক্লোজ আপ শটে নায়ক-নায়িকার উচ্চতার বৈষম্য বিসদৃশ লাগল। সমস্যা দূর করতে প্রাণের পাশে নুরজাহানের পাশে দাঁড়াতে হত ইটের পাঁজার উপর। যাতে ক্যামেরায় সামঞ্জস্যপূর্ণ লাগে।
মুম্বইয়ে প্রাণ কয়েকদিন চাকরি করেছিলেন মেরিন ড্রাইভের ডেলমার হোটেলে। ১৯৪৮ সালে ফের শুরু করেন অভিনয়। লেখক সাদাত হোসেন মান্টো এবং অভিনেতা শ্যামের সাহায্যে প্রাণ অভিনয়ের সুযোগ পান বম্বে টকিজের ছবি ‘জিদ্দি’-তে। এই ছবিতে নায়ক-নায়িকা ছিলেন দেব আনন্দ এবং কামিনী কৌশল। সুপারহিট এই ছবি দেব আনন্দের কেরিয়ারে বড় ব্রেক ছিল।
ক্রমে তিনি নিজেকে সরিয়ে আনেন শুধুমাত্র নেগেটিভ চরিত্রেই। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, নায়িকার সঙ্গে নাচগান করা তাঁর সঙ্গে মানানসই হচ্ছে না। বিশেষ করে ছবিতে নায়কের নাচের দৃশ্যে তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। ফলে বেছে নেন নেগেটিভ চরিত্রই। দিলীপকুমার, দেব আনন্দ এবং রাজ কপূরের মতো অভিনেতা প্রাণকে পছন্দ করতেন তাঁদের ছবিতে খলনায়ক হিসেবে। নানাভাই ভট্ট, বিমল রায়, আই এস জোহার, শক্তি সামন্ত, নাসির হুসেন-সহ প্রাণের সমসাময়িক বড় পরিচালকরাও ছিলেন তাঁর অভিনয়ের ভক্ত।
খলনায়কের ভূমিকাকে প্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন চরিত্রাভিনেতার পর্যায়ে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৮২ অবধি তিনি পার্শ্বচরিত্রাভিনেতাদের মধ্যে সবথেকে বেশি পারিশ্রমিক পেতেন। ‘বড়ি বহেন’ ছবি থেকে প্রাণ তাঁর অভিনয়ের অন্যতম অংশ করে নিয়েছিলেন মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়ার রিং ছাড়ার ম্যানারিজমকে। পরবর্তী কালে তাঁর বেশ কিছু ছবিতে ফিরে এসেছে এই ম্যানারিজম।
প্রাণের ফিল্মোগ্রাফিতে উল্লেখযোগ্য হল ‘উপকার’, ‘আজাদ’, ‘দেবদাস’, ‘মধুমতী’, ‘দিল দিয়া দর্দ লিয়া’, ‘রাম অউর শ্যাম’, ‘আদমি’, ‘জিদ্দি’, ‘মুনিমজি’, ‘চোরি চোরি’, ‘জাগতে রহো’, ‘অমরদীপ’, ‘ববি’, ‘যব প্যায়ার কিসি সে হোতা হ্যায়’-এর মতো ছবি। তাঁর সমসাময়িক নায়করা সরে গিয়েছেন চরিত্রাভিনয়ে, অথচ প্রাণ দাপটের সঙ্গে খলনায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে গিয়েছেন।
১৯৯৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন প্রাণ। এরপর অভিনয় প্রায় ছেড়েই দেন তিনি। শুধু অমিতাভ বচ্চনের অনুরোধে অভিনয় করেছিলেন বচ্চনের হোম প্রোডাকশনের ছবি ‘তেরে মেরে সপনে’ এবং ‘মৃত্যুদাতা’-য়। ২০০০ সালের পরে গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স ছাড়া তাঁকে কার্যত দেখাই যায়নি। একবারই মাত্র ছবি প্রযোজনা করেছিলেন প্রাণ। ১৯৯১ সালে মুক্তি পেয়েছিল তাঁর প্রযোজিত ও অভিনীত ছবি ‘লক্ষ্মণরেখা’। অভিনয় করেছেন বাংলা ছবিতেও।
দীর্ঘ ছয় দশকের কেরিয়ারে প্রাণ অভিনয় করেছেন ৩০০টিরও বেশি ছবিতে। জনজীবনে এতটাই প্রভাব ছিল তাঁর বলিষ্ঠ অভিনয়ের, বলা হয় দীর্ঘদিন অবধি ভারতীয় বাবা-মায়ের পুত্রসন্তানের নাম ‘প্রাণ’ রাখতে বেশ কয়েকবার ভাবতেন। যদি পরে সে নিজের জীবনে খলনায়ক হয়! ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর সম্মানিত সম্বোধন ‘প্রাণ সাহাব’। তাঁর কণ্ঠে ‘বরখুরদার’ বলিউডে আইকনিক সংলাপের মধ্যে অন্যতম।
২০১৩ সালের ১২ জুলাই ৯৩ বছর বয়সে প্রয়াত হন প্রাণ। বলিউডের তথাকথিত নায়ক বা খলনায়ক, কোনও ছাঁচেই বোধহয় ফেলা যায় না তাঁকে। ছবিতে তাঁর মেক আপের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল চোখে হাল্কা কাজলের ছোঁয়া। সেই কাজলরেখার মতোই তাঁর ভূমিকা ছিল অভিজাত, অনন্য এবং উজ্জ্বল। নীরবেই চলে গেল তাঁর জন্মশতবর্ষ। (ছবি: আর্কাইভ ও ফেসবুক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy