Advertisement
০৫ জুলাই ২০২৪
Tathagata Mukherjee takes up the pen for Others Payal

টলিগঞ্জে রোজ পায়েল, অনসূয়াদের মত প্রতিভারা খুন হচ্ছে

পায়েল-অনসূয়ার কান সাফল্যের প্রেক্ষিতে, নতুনদের প্রতি টালিগঞ্জের অনাস্থা নিয়ে সরব তথাগত

Image Of Anasuya Sengupta, Payal Kapadia, Tathagata Mukherjee

অজস্র পায়েল, অনসূয়াদের জন্য কলমে তথাগত মুখোপাধ্যায় নিজস্ব চিত্র।

তথাগত মুখোপাধ্যায়
তথাগত মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২৪ ১৬:০৭
Share: Save:

হ্যাঁ, আমি পায়েল কাপাডিয়া এবং অনসূয়া সেনগুপ্তকে নিয়ে কোথাও কিছু লিখিনি, কিংবা বলিনি। কারণ, প্রশংসা করতে যোগ্যতা লাগে। ঠিক যে ভাবে সমালোচনা করতে যোগ্যতা লাগে। অন্তত এই শিক্ষাতেই আমি বেড়ে উঠেছি। আর, আমি তো রোজ খুন হতে দেখি অনসূয়ার মতো অভিনেত্রীদের! যাঁদের বিভিন্ন অজুহাতে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। কখনও টিপিক্যাল বাঙালি ‘সুন্দরী’র মত দেখতে নয় বলে। কখনও গায়ের রঙের অজুহাতে। কখনও ‘পিআর’-এর অভাবে। কখনও বা ক্ষমতাশালী পক্ষকে তুষ্ট না করতে পারার দোষে। কত অজস্র পায়েল কাপাডিয়া এ শহরে প্রতি দিন স্ক্রিপ্ট ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে অন্য কাজের সন্ধান করেন, শুধু মাত্র নামী প্রযোজক কিংবা জনপ্রিয় অভিনেতা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, এ চিত্রনাট্য ‘পাবলিক’ দেখবে না বলে। অথচ যখন কোনও পায়েল কিংবা অনসূয়া জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের মেধায়, যোগ্যতায় সাফল্য ছিনিয়ে আনেন, এই অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালকেরাই ওঁদের সাফল্যের ছাতার তলায় নিজের অস্তিত্ব খোঁজেন। আবার এঁরাই প্রতিদিন খুন করেন পায়েল কাপাডিয়া, অনসূয়াদের। অন্তত সুযোগ খোঁজেন, যাতে কোনও ব্যতিক্রম জিতে না যায়!

সব দেখেশুনে বড্ড হাসি পাচ্ছে। বাঙালি বরাবরের ‘হিপোক্রিট’, কাঠিবাজ। এই সব পরিচালকেরা তো আরও। নতুনদের নিয়ে ছবি বানাবেন, এঁদের ধাতে নেই। অনসূয়া, পায়েল কান চলচ্চিত্র উৎসবের আগে কলকাতায় থাকলে এঁদের হাতযশে সবার প্রথমে বাতিল হতেন। হেনস্থার শেষ থাকত না। সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। এখন ওঁদের আচরণ দেখুন! এই আচরণ সাধারণের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। তাঁরা অনসূয়া, পায়েলদের মতো কাউকে এ ভাবে শিখর ছুঁতে দেখলে তাই আপ্লুত হন। চারপাশের চাপ-চাপ কালোর মধ্যে আলোর খোঁজ পান। ভাবেন, তাঁরাও নতুন দিশা দেখতে চলেছেন। একই সঙ্গে বাঙালি আগে প্রাদেশিক। তারপর ধাপে-ধাপে উঠে আন্তর্জাতিক। তাই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সেঞ্চুরিই করুন বা জামা খুলে খালি গায়ে সেটা গ্যালারিতে ওড়ান— বাঙালি মুগ্ধ! একই কাজ মহেন্দ্র সিংহ ধোনি করলে ততটাও মাথাব্যথা নেই। সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। তাঁকে নিয়ে ছবি। তাঁর ছবির নাম বা চরিত্র নিয়ে ছবি। ইদানীং, অতি ব্যবহৃত হওয়ায় তাঁর সমসাময়িক পরিচালকেরা উঠে আসছেন। এটাই হচ্ছে অনসূয়াকে নিয়ে। কারণ, তিনিও বাঙালি এবং কলকাতার মেয়ে।

ক্রমশ, এই তালিকায় যুক্ত হয়ে পড়ছেন সেই সব পরিচালকেরাও। তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, এঁরা ক’টা নতুন ভাবনার ছবি করেছেন? নতুনদেরই বা তাঁদের ছবিতে কতটা পরিসরে সুযোগ দিয়েছেন? আবারও বলব, দেননি। কারণ, ওঁরা ছবি নিয়ে, চরিত্র নিয়ে পরীক্ষা করতে ভয় পান। একই ভাবে অনসূয়া এবং তাঁর মতো বাকিদের সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। কারণ, এঁরা আক্ষরিক ‘সুন্দরী’ নন। অনসূয়াও ‘ম্যাডলি বাঙালি’র পরেও কলকাতায় থেকে গেলে বড় জোর ছোট পর্দায় খলনায়িকার চরিত্র পেতেন। তার পর ফুরিয়ে যেতেন। একা অনসূয়া নন, তাঁর মতো আরও কত জন এ ভাবেই প্রতি মুহূর্তে হারিয়ে যাচ্ছেন! কেউ তার পরেও ভাল কিছু করে ফেললে তো কথাই নেই। যেনতেনপ্রকারেণ তাঁদের দাবিয়ে রাখার চেষ্টা। বরাবর নতুনদের নিয়ে কাজের সুবাদে আমি এঁদের খুব কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি, এঁরা কী ভাবে বঞ্চিত হন। এক বার এক প্রায় আনকোরা, অল্পবয়সি অভিনেতা তথাকথিত প্রথম সারির পরিচালককে একটা সংলাপ বলার ভঙ্গি দেখিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। বদলে তাঁকে কী শুনতে হয়েছিল? সেই নামী, পরিশ্রমী পরিচালক নাকি সপাট বলেছিলেন, ‘‘তোমায় দেখিয়ে দিলে কি আমি পয়সা পাব! তোমায় পয়সা দেওয়া হচ্ছে। কী ভাবে সংলাপ বলবে তার দায় তোমার।’’ একই কথা পায়েলের ক্ষেত্রেও। পায়েলের কাজ, তাঁর ছবি বিনোদন দুনিয়ায় এখনও ভিন্ন গ্রহের প্রাণীর মতোই ব্যতিক্রমী।

এ রকম অসংখ্য অনসূয়া, পায়েল আছেন। যাঁরা একটু সুযোগ পেলে এ ভাবেই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করতে পারেন। কিন্তু সুযোগ পেলে তো! ভেবে অবাক লাগছে, যাঁরা আজ প্রশংসা করছেন তাঁরা তো অনেক সুযোগ পাচ্ছেন, পেয়েছেন। তাঁরা কেন এই মঞ্চে আজও পৌঁছতে পারলেন না? এখানেই পরিষ্কার, আমরা এখনও কুয়োর ব্যাঙ! আমরা চেনা গণ্ডিতে, জানা মানুষদের পিঠ-চাপড়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। অজয় দেবগন অভিনীত ‘ময়দান’ ছবিতে সেই গল্পই স্পষ্ট। ছবিতে অজয় এক জন ভারতীয় ফুটবল প্রশিক্ষক। তিনি উপর মহলকে সন্তুষ্ট করেননি বলে, সবাই তাঁকে টেনে নামাতে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। তাতে দেশ চুলোর দোরে গেলেও সমস্যা নেই! নিজে দেখেছি, কলকাতার দুই জাতীয় পুরস্কারজয়ী অভিনেতা অনেক দিন কোনও ছবিতে কাজ পাননি। বসে থেকেছেন। আজ যাঁরা প্রশংসা করছেন, ছবি তুলছেন অনসূয়ার সঙ্গে, তাঁরা কাজ দেননি তাঁদের। সহ-অভিনেতারাও তাঁদের হয়ে কোনও দিন কাউকে বলেননি। সব দেখেশুনে তাই বাকি অনসূয়া, পায়েলদের বলব, আপনারা ওঁদের জন্য গর্বিত না হয়ে, গর্বের কারণ হয়ে উঠুন।

নামীদামি পরিচালক, অভিনেতাদেরও অনুরোধ, পরের গর্বে গর্বিত হওয়ার মধ্যে কোনও সাফল্য নেই। বরং যাঁরা আগামী দিনে অনসূয়া বা পায়েল হয়ে উঠতে পারেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ান। এঁরা প্রতি দিন স্টুডিয়োপাড়ায় ভিড় জমান। ছোট পর্দায় ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করে চলে যান। কিংবা ভিড়ের মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। এঁদের আবিষ্কার করুন। এঁদের প্রতিভা কাজে লাগান। নতুন কিছু উপহার দিন। জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্তরে সম্মান আপনারাও পেতে পারেন। বাঙালি ফের ছবি দেখতে প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tathagata Mukherjee Anasuya Sengupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE