প্রয়াত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
রবীন্দ্রগানের জগতে শিল্পী হিসেবে সুমিত্রা সেনের অবস্থান নির্ণয় এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সমসাময়িক শিল্পীদের সঙ্গে সুমিত্রার গায়নশৈলীর পার্থক্য, কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য তিনি স্বকীয়, কেন তিনি ততটা প্রচার পেয়েছিলেন অথবা পাননি, তা-ও এই লেখার বিচার্য নয়। মঙ্গলবার সকালে ৮৯ বছর বয়সে শিল্পী প্রয়াত হওয়ার পর মনে হচ্ছে এই লেখার বিষয়বস্তু হওয়া উচিত প্রয়াত এক শিল্পীর অন্দরমহলের কাহিনি। হয়তো এটা নিছক সমাপতন, কিন্তু এই পরিসরে একটি তথ্য উল্লেখ করতে হবে— ঠিক ১২ বছর আগে ৩ জানুয়ারি প্রয়াত হন সুচিত্রা মিত্র।
জীবনসায়াহ্নে কয়েক মাস ধরে নিজের বাড়িতে বসে সুমিত্রা যে গল্প বলেছেন, অতীত-যাপন করেছেন— সেখান থেকে পেশাদার এবং একই সঙ্গে সরল-সোজা এক শিল্পীর ছবি ফুটে ওঠে। অনেকেই বলেন ‘পেশাদার’ হতে গেলে অনেক ‘ত্যাগ’ করতে হয়। ঘোরতর ‘সংসারী’ হয়ে ‘পেশাদার’ হওয়া যায় না। সুমিত্রা জীবন দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছেন, কিচ্ছু ‘ত্যাগ’ না করেও শিল্পী হওয়া যায়, ঘোরতর ‘সংসারী’ হয়ে দুই কন্যা মানুষ করেও ‘পেশাদার’ হওয়া যায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র কিংবা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গান করা যায়। স্বামী, দুই কন্যা, তাদের পড়াশোনা, নিজের চাকরি ইত্যাদি সামলে শিল্পী হওয়া যায়। এখানেই অনন্য সুমিত্রা।
যে যুগের কথা পরের প্রজন্ম জানতে পারে দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্ৰ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীর জীবনকাহিনি বা কথাকণিকা-নির্ভর আখ্যানের মধ্যে দিয়ে, সেই সোনালি যুগ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা দেয় আদ্যন্ত কলকাতায় মানুষ সুমিত্রার জীবন-কথার মাধ্যমে। যেখানে দেবব্রত, কণিকা, সুচিত্রা, ঋতু, সাগর, চিম্ময় বা দ্বিজেনের মতো ব্যক্তিত্ব সুমিত্রার সহশিল্পী হয়ে শুধু থেকে যান না, কখনও শিক্ষক, কখনও বন্ধু, কখনও গুণমুগ্ধ, কখনও বা সহকর্মী রূপে ধরা দেন।
ভাবীকাল কখনও প্রশ্ন তুলতে পারে, শিল্পী হিসেবে সুমিত্রার প্রাপ্তি কী? নিছক তথ্য বলবে, ১৯৫১ সালে কুমারী সুমিত্রা দাশগুপ্ত নামে প্রথমে দু’টি নজরুলগীতি (‘গোঠের রাখাল বলে দে রে’, ‘বেদনার বেদী তলে’) রেকর্ডিংয়ের মধ্যে দিয়ে শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ। নজরুলগীতি ছাড়াও পল্লিগীতি (জিপসিগান, ধামাইলগান, পালাগান, বিয়েরগান), আধুনিকেরও রেকর্ড রয়েছে। এই সব গান ভারতীয় সঙ্গীতের অমূল্য সম্পদ। পাঠকের কাছে অনুরোধ, এই গানগুলি না শুনে থাকলে, এক বার অন্তত শুনে দেখা যেতে পারে। ইউটিউবে মিলবে। কারণ, সেই সব গানে সুমিত্রাকে অন্য ভাবে চেনা যাবে। তখন সুমিত্রার কণ্ঠস্বর এমন ছিল, যার সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র গীতা দত্তের। যদিও জীবনসায়াহ্নে অশীতিপর শিল্পী নিজে মনে করেছিলেন, ‘‘এই গানগুলোর প্রতি জাস্টিস করতে পারিনি।’’ এই উক্তির মধ্যে হয়তো লুকিয়ে আছে প্রকৃত শিল্পীমনের চিরকালীন অতৃপ্তি।
পরে অবশ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি। সে কথা মাথায় রাখলে মনে হয়, ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রগানের রেকর্ড না থাকাটা সঙ্গীতজগতের অপূরণীয় ক্ষতি। সারা জীবনে শুধু রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করেছেন দেড়শোরও বেশি। শিল্পী হিসেবে ষোলোটি ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্লে-ব্যাক করেছেন। উত্তমকুমারের অনুরোধে ১৯৬০ সালে ‘শুন বরনারী’ ছবিতে গানের মধ্যে দিয়ে যার শুরু। সন্তোষ সেনগুপ্তের পরিচালনায় ‘শ্যামা’, ‘শাপমোচন’, ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘বর্ষামঙ্গল’, ‘বসন্ত’ বা ‘মায়ার খেলা’ (পরিচালনা, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)-র মতো নৃত্যনাট্য ও গীতিনাট্যে গান তাঁকে স্বকীয় আসনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। গীতি আলেখ্য ‘যায় দিন শ্রাবণ দিন যায়’-এও তাঁর কণ্ঠ শোনা যায়। কাজ করেছেন উস্তাদ আলি আকবর খান, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, রবীন চট্টোপাধ্যায়, ভি বালসারা, তিমির বরণ, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা সতীর্থ এবং সহপাঠী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো বহু সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে। ‘কোমল গান্ধার’-এর জন্য ঋত্বিক ঘটক ছবির সঙ্গীত পরিচালক জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রকে বলেছিলেন সুমিত্রার কণ্ঠ ব্যবহার করার কথা। পঙ্কজকুমার মল্লিকের পরিচালনায় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র গানে (মাগো তব বীণে সঙ্গীত)-র মধ্যে দিয়ে তো এখন ইতিহাসে সুমিত্রা। এখনও প্রতি বছর দেবীপক্ষের শুরুতে মহালয়ায় যাঁর কণ্ঠ চাইলেই বাঙালি শুনতে পারেন রেডিয়োতে। জীবনভর অবদানের জন্য পেয়েছেন ‘সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি’ পুরস্কার-সহ নানা স্বীকৃতি।
৩০ এপ্রিল ১৯৮০ সালে দেবব্রত বিশ্বাসের লেখা একটি চিঠির কথা উল্লেখ করতে হয়। দেবব্রত লিখেছেন, ‘‘সুচরিতাসু সুমিত্রা দিদিমণি, এইমাত্র আপনার চারটি গান বেতারে শুনলাম। (১) (‘কথা ভুলে গেছি’), (২) আমি যত বার (এখানে উল্লিখিত গানটি হল: ‘তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা/আমি যত ভার জমিয়ে ভুলেছি/ সকলই হয়েছে বোঝা।’), (৩) ‘মেঘ বলেছে, যাব যাব’, (৪) ‘আমারে কি (কে) নিবি ভাই’। দারুণ বললে কম বলা হয়। আপনার গানের ভাব ও ভঙ্গি আমার হৃদয়কে তীব্র নাড়া দিয়েছে। মনে হচ্ছিল, যেন আমিই গাইছি— আপনার গানে আমার নিজেকে খুঁজে পেলাম। শরীর খুব খারাপ তাই আমি আর গাইতে পারি না। অন্যান্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে আমি এতটা বিচলিত হই না। এত লিখলাম বলে কিছু মনে করবেন না। কারণ, আমি না লিখে থাকতে পারলাম না। আপনার আরও উন্নতি হোক। এগিয়ে যেতে থাকুন। আন্তরিক শুভেচ্ছা ও নমস্কারাস্তে আপনাদের জর্জদা।’’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জগতে সুমিত্রার গ্রহণযোগ্যতার দলিল এই চিঠি।
এ তো নিছক কেজো তথ্য। কিন্তু তার বাইরে যা রয়ে যায়, তা হল অধ্যাপক এবং পরিপূর্ণ গীতরসিক বাবার স্নেহচ্ছায়ায় শৈশব, কৈশোর কাটিয়ে বিয়ের পর নানা কাজের মধ্যেও জারি রেখেছিলেন সঙ্গীতচর্চা। স্বামী অনিলকুমার সেনের আন্তরিক সাহায্য সেখানে অবশ্যই ছিল। কিন্তু, শ্বশুরবাড়ির দায়দায়িত্ব সামলানো, দুই কন্যা মানুষ করা এবং সেই সঙ্গে নিজের পেশাগত জগতে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার পথ করে নেওয়া মোটেই সহজ ছিল না। ঘরে এবং বাইরে সামঞ্জস্য রেখে চলার উদাহরণ হতে পারেন সুমিত্রা। কন্যাদের পড়াশোনা, গান শেখানো এবং পেশাদার হিসেবে একাধিক দায়বদ্ধতা রক্ষা সমান তালে চলেছে। কোথাও কোনও রকম আপস না করে।
এ কথা সবাই জানেন, পেশাগত জগতের সর্বত্র যেমন রাজনীতি থাকে, গানবাজনার দুনিয়ায় তা বেশি বই কম অনুভূত হয় না। কিন্তু সে-সব থেকে চিরকাল দূরে থাকা পছন্দ করেছেন সুমিত্রা। এ জন্য হয়তো তাঁর রেকর্ড করা গানের সংখ্যা কিছু কম। যা নিয়ে প্রবীণ শিল্পীর আক্ষেপ ছিল, ‘‘ইন্ডাস্ট্রি হয়তো আমার কণ্ঠ আরও একটু বেশি ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু কেন হয়নি, তা জানি না। রেকর্ডগুলো তো বিক্রি হতো...। তা হলে?’’ (ঋণ: স্মৃতিসুধায় সুমিত্রা সেন (২০১৬), দে’জ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy