(বাঁ দিক থেকে) পাওলি দাম, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, টোটা রায়চৌধুরী, রানা সরকার। গ্রাফিক্স: সনৎ সিংহ।
রাতারাতি বদলে যাচ্ছে বিনোদন দুনিয়া! মালয়ালম ছবির দুনিয়া তোলপাড় হেমা কমিটির রিপোর্টে। কমিটির সাফল্যে অনুপ্রাণিত বলিউড। খবর, মহারাষ্ট্র সরকার এমনই একটি কমিটি গড়ার পথে। পিছিয়ে নেই টলিউডও। অভিনেত্রী থেকে টেকনিশিয়ান— সকলের জন্য এ বার এখানেও তৈরি হতে চলেছে নারী সুরক্ষা কমিটি। হেমা কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন অভিনেত্রী ঋতাভরী চক্রবর্তী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তাঁর আবেদন, বাংলা বিনোদন দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেক নারী যাতে সুরক্ষিত থাকে, হেনস্থা হওয়ার পরে যাতে ভীত না হয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারে, আইনি পথে যাতে বিচার পায়— তার জন্য একটি কমিটি তৈরি হোক। একই ভাবনায় ভাবিত টলিউডও। একাধিক পদক্ষেপের কথা জানিয়ে টেলি অ্যাকাডেমি, ইমপা, আর্টিস্ট ফোরাম, ফেডারেশনের সভাপতির উদ্দেশে খ্যাতনামী নায়িকা-অভিনেত্রী, টেকনিশিয়ান, প্রযোজিকা-সহ বিনোদন দুনিয়ায় কর্মরত বিভিন্ন স্তরের মহিলাদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি চিঠি তৈরি হয়েছে। ‘নারীসুরক্ষা কমিটি’ গড়ার আবেদনও করা হয়েছে সেই চিঠিতে।
অর্থাৎ, এত দিন যা গুঞ্জন বা টলিউডের অন্দরের চর্চা বলে ধরা হত সেটা বাস্তবে ঘটে, প্রমাণিত। বিষয়টি নিয়ে কী বক্তব্য বাংলা বিনোদন দুনিয়ার?
জানতে আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করেছিল সুদীপ্তা চক্রবর্তী, পাওলি দাম, রানা সরকার, ফিরদৌসল হাসান, টোটা রায়চৌধুরীর সঙ্গে। সুদীপ্তা খুশি এই পদক্ষেপে। তাঁর কথায়, “আজ হোক কাল হোক, প্রতিবাদ যে শুরু হল এতেই ভাল লাগছে। গত আট দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছিল। গত চার দিন ধরে চিঠির বয়ান তৈরি হয়েছে। তার পর এই পদক্ষেপের। খুব দরকার ছিল এই পদক্ষেপ।” অভিনেত্রী-শিক্ষিকার আরও দাবি, তাঁর কাছে নতুন প্রজন্মের অনেক মেয়ে অভিনয় শিখতে আসেন। তাঁরা তাঁদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার কথা সুদীপ্তাকে জানান। স্বাভাবিক ভাবেই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে ভয় পাচ্ছেন তাঁরা। অভিনেত্রীও বুঝে পান না, তাঁদের কী উত্তর দেবেন! তাঁর আশা, এই কমিটি তৈরি হলে এই প্রজন্ম হয়তো একটু হলেও আশ্বস্ত হবেন।
কিছু দিন আগে পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে এক মহিলাকে হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন প্রযোজক রানা সরকার। পরে যদিও তিনি সেই বক্তব্য সরিয়ে নেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অভিনেত্রী সে প্রসঙ্গও জানিয়েছেন। তাঁর আফসোস, প্রযোজক এগোলেও বিনোদন দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত মেয়েরা এগোতে ভয় পান। বুঝতে পারেন না, তাঁরা কতটা সুরক্ষিত। বাধ্য হয়ে গোপনে বিষয়টি মিটিয়ে নেওয়ার পথে হাঁটেন তখন। যাঁকে নিয়ে এত কথা সেই রানা কী বলছেন? আনন্দবাজার অনলাইনের কাছে তিনি বিষয়টি স্বীকার করেছেন। বলেছেন, “কিছু করার নেই। এটাই টলিউডের অন্দরের আসল ছবি। কাজ হারানোর ভয়ে, আরও হেনস্থা হওয়ার ভয়ে আক্রান্ত অভিনেত্রীরা মুখ খোলেন না। এতে যে পরোক্ষে অপরাধীদের মদত দেওয়া হয়, সেটাও বোঝেন না তাঁরা। কারণ, প্রতিবাদ যত কম হবে ততই অপরাধী অন্যায় করার সাহস পাবে।”
‘নারী সুরক্ষা কমিটি’ তৈরি হলে বিনোদন দুনিয়ার প্রত্যেক নারী সাহস করে সেখানে অভিযোগ জানাতে পারবেন? রানার জবাব, “সকলে জানেন, আইন কখনও আক্রান্তের নাম প্রকাশ্যে আনে না। তার পরেও কিসের ভয়? আমি অন্তত বুঝতে পারি না।” তাঁর আফসোস, এ ভাবে যত দিন নারী নীরব থাকবে অন্যায় ততই বাড়তে থাকবে। এ-ও জানিয়েছেন, তাঁর বিরুদ্ধেও যদি কারও এই ধরনের কোনও অভিযোগ থাকে, কমিটিতে জানাতে পারেন। তাঁকে ডেকে পাঠানো হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই আলোচনায় যোগ দেবেন।
চিঠিতে যে সমস্ত নায়িকা-অভিনেত্রী স্বাক্ষর করেছেন পাওলি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আনন্দবাজার অনলাইন যোগাযোগ করতেই তিনি কথা শুরু করেছেন সাধুবাদ জানিয়ে। তাঁর বক্তব্য, “এই অভিযোগ আজকের নয়। যুগ যুগ ধরে নারী অত্যাচার, হেনস্থার শিকার। হেমা কমিটির রিপোর্ট সেই অন্ধকারে যেন দিশা দেখাল।” পাশাপাশি পর্দার ‘মাধবীলতা’ এ-ও জানাতে ভোলেননি, গত ৯ অগস্ট থেকে রাতের ঘুম উড়েছে তাঁর। সরকারি হাসপাতালে এক তরুণী চিকিৎসকের নির্যাতন-মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তিনি এবং সমগ্র নারী জাতির জন্য একুশ শতকে এসে নিরাপত্তা চেয়ে, অন্যায়ের প্রতিকার চেয়ে পথে নামতে হচ্ছে। আলাদা কমিটি গড়ার কথা ভাবতে হচ্ছে। একজন নারী হিসাবে তাঁর কাছে এর থেকে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে?
বাংলা বিনোদন দুনিয়ার মেয়েরা হেনস্থার শিকার। তাঁদের সুরক্ষা চেয়ে কমিটি গড়ার আবেদন। এবং অভিযোগের আঙুল পুরুষদের দিকে। তাই কি চিঠিতে কেবল মহিলাদের সই? সেখানে কোনও পুরুষ অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক সই করেননি। তাঁরা কি নারীর পাশে নেই? প্রশ্ন রাখা হয়েছিল টোটার কাছে। তাঁর দাবি, “নারী সুরক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে আমি সব সময় নারীর পাশে আছি ও থাকব। তাই মন থেকে চাইছি, এই ধরনের কমিটি গড়া হোক। চাইছি, শুধু খ্যাতনামীরাই নন, ইন্ডাস্ট্রিতে যাঁরা নতুন, তাঁরাও যেন এই কমিটি থেকে উপকৃত হন। নিজে দেখেছি, অনেক সময় ওঁরা আলাদা ওয়াশরুম বা পোশাক ছাড়ার জন্য আলাদা ঘরও পান না! বিশেষ করে মহিলা জুনিয়র আর্টিস্ট বা পর্দার মহিলা নৃত্যশিল্পীরা এই অন্যায়ের শিকার।” টোটা সঙ্গে এ-ও জানিয়েছেন, তাঁর থেকে এখনও কেউ সই চায়নি। চাইলে অবশ্যই তিনি সই করবেন।
পাশাপাশি তাঁর দাবি, “অনেক সময় নারীও নারীকে হেনস্থা করে। তুলনায় নতুনদের অন্যায় ভাবে ব্যবহার করে পুরনোরা। সে দিকটাও দেখতে হবে। একই সঙ্গে যেন আইনের অপব্যবহার না হয়। ঠিক যে ভাবে একটা সময়ে নারী সুরক্ষার জন্য তৈরি ৪৯৮-এ ধারার অপব্যবহার করেছিলেন বেশ কিছু নারী। যার জন্য শীর্ষ আদালত সেই আইন প্রণয়নের বিষয়ে কিছু বদল আনতে বাধ্য হয়েছিল।” অনেক সময় রক্ষকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ থাকে নারীর। তাঁরাই হয়তো কমিটির মাথায় বসেন। সে ক্ষেত্রে ন্যায় আসবে? এ প্রসঙ্গে টোটা হেমা কমিটির উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তাঁর দাবি, “রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই অগ্নিগর্ভ বিনোদন দুনিয়া। মালয়ালম ইন্ডাস্ট্রিতে অভিযুক্তদের পদত্যাগের হিড়িক দেখেই সেটা নিশ্চই অনুমান করতে পারছেন!” তাঁর উদাহরণ, শ্রীলেখা মিত্র অভিযোগ জানানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেরলের সরকারি সংস্থা ‘কেরালা চলচ্চিত্র অ্যাকাডেমি’ থেকে পদত্যাগ করেছেন দক্ষিণী পরিচালক রঞ্জিত। অভিনেতার উপলব্ধি, মানুষের ঘুম ভাঙছে। বাংলায় এ রকম কমিটি তৈরি হলে সেখানেও অন্যায় দমন করা সম্ভব হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy