Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ক্রিকেটের পঞ্চকন্যা

ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ মাতাচ্ছে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দৈল। মিতালি রাজের নেতৃত্বে তারা পৌঁছে গিয়েছে সেমিফাইনালে। কারা আছেন এই সাফল্যের দৌড়ের নেপথ্যে? পাঁচ কন্যাকে নিয়ে অজানা কাহিনি... ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ মাতাচ্ছে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দৈল। মিতালি রাজের নেতৃত্বে তারা পৌঁছে গিয়েছে সেমিফাইনালে। কারা আছেন এই সাফল্যের দৌড়ের নেপথ্যে? পাঁচ কন্যাকে নিয়ে অজানা কাহিনি...

মিতালি রাজ

মিতালি রাজ

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৭ ০০:২২
Share: Save:

মিতালি রাজ

ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের সচিন তেন্ডুলকর। এ নামেই ডাকা হয় মিতালিকে। কিন্তু তিনি নিজে কি এই নামকরণ পছন্দ করেন? মনে হয় না। বিশ্বকাপ শুরুর সময়েই এক সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, আপনার পছন্দের পুরুষ ক্রিকেটার কে? একটুও না ভেবে মিতালির স্ট্রেট ড্রাইভ— কখনও কোনও পুরুষ ক্রিকেটারকে জিজ্ঞেস করেছেন তাঁর সবচেয়ে পছন্দের মহিলা ক্রিকেটারটি কে?

মিতালির এই জবাব ভাইরাল হয়ে যায়। আর এক বার তিনি হইচই ফেলে দিলেন। ক্যামেরায় ধরা পড়ল, ব্যাট করতে যাওয়ার আগে মিতালি বই পড়ছেন। ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বই পড়তে ভালবাসতেন রাহুল দ্রাবিড়। তাঁকেও কখনও ব্যাট করতে যাওয়ার আগে বই পড়তে দেখা যায়নি। মিতালিকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে বলেছিলেন, ‘‘ব্যাটিং মনঃসংযোগের ব্যাপার। বই পড়লে সুবিধে হয়।’’

মিতালির বয়স ৩৪। নানা রঙের পালক ইতিমধ্যেই লেগে গিয়েছে ভারত অধিনায়কের মুকুটে। মেয়েদের ওয়ান ডে ক্রিকেটে বিশ্বের সর্বোচ্চ রান স্কোরার হলেন এই বিশ্বকাপেই। প্রথম মেয়ে হিসেবে পেরিয়ে গিয়েছেন ছ’হাজার রানের গণ্ডি। চলতি টুর্নামেন্টে ভারতের পক্ষে এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ স্কোরারও। অধিনায়কত্বের দিক থেকে মেয়েদের ‘ক্যাপ্টেন কুল’ তিনি। তাঁর নেতৃত্বকে ভারতের সেমিফাইনালে ওঠার অন্যতম প্রধান কারণ ধরা হচ্ছে। ব্যাটসম্যান হিসেবে মিতালির সাফল্যের মূলে ফুটওয়ার্ক। কোথা থেকে পাওয়া সেই ফুটওয়ার্ক? না, ক্রিকেটে আসার আগে মিতালি ছিলেন ক্লাসিকাল ডান্সার। ভরতনাট্যম থেকে ভারত অধিনায়ক— রূপকথার মতোই উত্থান তাঁর!

আরও পড়ুন:

রং, সুর অভিনয় নিয়ে ‘জগ্গা জাসুস’ একটা জমজমাট কার্নিভাল

ঝুলন গোস্বামী

চলতি বিশ্বকাপে হয়তো দারুণ কিছু করে উঠতে পারেননি এখনও। তবে চাকদহ এক্সপ্রেসকে বাদ দিয়ে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের কোনও কাহিনিই লেখা সম্ভব নয়। দাদাদের সঙ্গে বাড়ির পিছনের উঠোনে হাত ঘোরানো দিয়ে শুরু। কে জানত সেই মেয়েই একদিন মহিলা ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী হবে! চাকদহ থেকে ক্রিকেট কিটব্যাগ নিয়ে ভিড় ট্রেনে ঠেলাঠেলি করে তাঁর কলকাতার কোচিং সেন্টারে এসে নিজেকে তৈরি করাটা ক্রিকেট সাধনার সেরা উদাহরণ।

পারবেন কি ঝুলনরা কাপ জিততে? এই প্রশ্ন এখন ভক্তদের মনে ঘুরছে। এ বারের বিশ্বকাপ যে মহিলা ক্রিকেটকে আরও অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গেল, সন্দেহ নেই। আরও তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল ভারতীয় শিবির থেকে। বিশ্বকাপে খেলতে নামার আগে গোটা দল শপথ নিয়েছে, কাপ জিততেই হবে। কোনও বিশেষ কারণ? হ্যাঁ, আছে। সম্ভবত এটাই শেষ বিশ্বকাপ মিতালি এবং ঝুলনের। যাঁরা কি না ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের গাওস্কর-কপিল দেব। ঝুলনরা নিজেরা দেখতে চান, তাঁদের সংগ্রহে একটি বিশ্বকাপ রয়েছে। তেমনই দলের জুনিয়ররা কাপ জিতে দুই ‘দিদি’র অবদানকে সম্মান জানাতে চাইছেন।

একতা বিস্ত

এ বারের বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ জেতানোর নায়িকাকে বাদ দিয়ে কী ভাবে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের কাহিনি লেখা সম্ভব? উত্তরাখণ্ডের আলমোরার মেয়ে একতার জীবনকাহিনিও অসাধারণ। তাঁর বাবা কুন্দন সিংহ বিস্ত ভারতীয় নৌসেনায় হাবিলদারের চাকরি করতেন। অবসরের পরে তিনি চায়ের দোকান খোলেন, যাতে মেয়ের ক্রিকেট খেলার শখ পূরণ হয়। ছেলেদের সঙ্গে খেলে নিজের পারফরম্যান্সে উন্নতি ঘটিয়েছেন একতা। তাঁদের এলাকায় ছেলেদের সঙ্গে একটি মেয়ের খেলা দেখতে মানুষের ভিড় জমে যেত। কিন্তু বাবার অতটা স্বচ্ছল অবস্থা ছিল না যে, সংসারের খরচ মিটিয়ে তিনি মেয়েকে ক্রিকেটের দামী সরঞ্জাম কিনে দিতে পারবেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাঁচটি উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরার পুরস্কার পেয়েছিলেন একতা। আর বাবা গর্ব করে বললেন, ‘‘আমরা সাধ্য মতো সমর্থন করে গিয়েছি। মেয়ে আজ দেখিয়ে দিল, আমরা ভুল করিনি।’’

স্মৃতি মান্ধানা

মনে করা হচ্ছে, মিতালি এবং ঝুলন সরে যাওয়ার পরে মুম্বইয়ের ২০ বছর বয়সি এই ক্রিকেটারই হবেন দলের চালিকাশক্তি। আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের জন্য এবং ওপেন করেন বলে অনেকে তাঁকে মহিলাদের বীরেন্দ্র সহবাগ বলে ডাকে। সহবাগেরও বিখ্যাত টুইট আছে এই নিয়ে— ‘স্মৃতি প্রথম স্মৃতি। দ্বিতীয় সহবাগ নয়। প্রত্যেক দেশবাসীর গর্ব’।

মান্ধানার ক্রিকেটে আসাটা ভাইয়ের হাত ধরে। ভাই যেতেন ক্রিকেট অনুশীলনে। মান্ধানা যেতেন সঙ্গে। খেলা দেখতে দেখতেই ক্রিকেটের প্রেমে পড়ে গেলেন। তাঁর কিটব্যাগে এখনও একটা বিশাল ব্যাট পাওয়া যাবে। সেটা দিয়ে তিনি খেলেন না। কিন্তু সব সময় তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। রাহুল দ্রাবিড়ের অটোগ্রাফ করা সেই ব্যাট আসলে উপহার পেয়েছিলেন তাঁর ভাই। মহারাষ্ট্রের অনূর্ধ্ব ১৬ বিভাগে ভাই ভাল খেললে সংবাদপত্রে রিপোর্ট বেরোত। মান্ধানা সেগুলি সযত্নে কেটে রাখতেন। তার মধ্যেই এক দিন হঠাৎ ভাবনা এল— ‘আমিও এ ভাবেই ক্রিকেট খেলব, রান করব। আমারও নাম সংবাদপত্রে বেরোবে!’

মান্ধানা সব সময়ই সময়ের চেয়ে এগিয়ে। অনূর্ধ্ব ১৫ বিভাগে সুযোগ পান ৯ বছর বয়সে। অনূর্ধ্ব ১৯ খেলেন ১১ বছর বয়সে। মান্ধানার সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাহিনি ঘটল ১৫ বছর বয়সে। যখন তিনি চাইলেন বিজ্ঞান নিয়ে পড়বেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁর মা-ই বাধা দেন। বিজ্ঞান যে তাঁর মেয়ের জন্য নয়, সেটা বুঝে গিয়েছিলেন মান্ধানার মা। এখন যে কারণে মাকে ধন্যবাদ দেন ভারতের বাঁ হাতি ওপেনার।

তাঁকে ইতিমধ্যেই ডাকা শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন রানমেশিন হিসেবে। বিশ্বকাপেও শুরুর দিকের ম্যাচগুলোতে বড় ইনিংস খেলে তিনি কাপের স্বপ্ন বাড়িয়ে তুলেছেন। প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে করেন ৭২ বলে ৯০। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১০৮ বলে ১০৬ রানে অপরাজিত। এমনকী অস্ট্রেলিয়ায় ভাল খেলার পর ম্যাথু হেডেনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও পেয়েছেন স্মৃতি।

রাজেশ্বরী গায়কোয়াড়

নিউজিল্যান্ডকে চূর্ণ করে ভারতকে সেমিফাইনালে তুলল তাঁর বাঁ হাতি স্পিন। কে বলবে, এটাই বিশ্বকাপে তাঁর প্রথম ম্যাচ ছিল! একতার মতোই রাজেশ্বরীর উত্থানের পিছনেও তাঁর বাবা। রাজেশ্বরীর প্রথম প্রেম ক্রিকেট ছিল না। তিনি জ্যাভেলিন এবং ডিসকাস থ্রোয়ার ছিলেন। ভলিবলও খেলেছেন। কিন্তু ক্রিকেটে নিয়ে আসেন বাবা শিবানন্দ গায়কোয়াড়। এমনিতে গায়কোয়াড় পরিবারে খেলার চল বেশ ভাল মতোই রয়েছে। রাজেশ্বরীর ছোট বোন রামেশ্বরী কর্নাটকে ক্রিকেট খেলেন। বড় দিদি ভুবনেশ্বরী হকি খেলোয়াড়। এক ভাই ব্যাডমিন্টন, ভলি খেলেন। অন্য জন খেলাতে না থাকলেও তবলায় পারদর্শী। চিন্নাস্বামীতে আইপিএল ম্যাচ দেখতে গিয়ে সাংঘাতিক হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন শিবানন্দ। তাই রাজেশ্বরীর ক্রিকেটের পিছনে প্রধান ভূমিকা থাকা তাঁর বাবাই এই সাফল্য দেখতে পেলেন না। কর্নাটকের বীজাপুরে ফ্রি কোচিং ক্যাম্প চালাতেন বাসবরাজ। সেখানেই তাঁর বাবা ভর্তি করে দিয়েছিলেন রাজেশ্বরীকে। তবে তখন তিনি জোরে বল করতেন। বাসবরাজ এখনও মনে করতে পারেন, ‘‘ক্যাম্পে ২৮০ জন ক্রিকেটারের মধ্যে মাত্র ৩ জন বোলার ছিল। তার মধ্যে ছিল রাজেশ্বরী। তবে তখন বাঁ হাতে পেস বল করত।’’ কোচের পরামর্শেই পেস থেকে স্পিনে আসেন রাজেশ্বরী। মনে হয় না কেউ তা নিয়ে আর আক্ষেপ করছেন বলে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE