স্ট্রেচারে করে যখন ওঁকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হচ্ছে তখনও বকর-বকর করে যাচ্ছেন, হাসছেন, ডাক্তারদের সঙ্গে ইয়ার্কি করছেন! নার্স আর থাকতে না-পেরে অবাক হয়ে বললেন, ‘‘সত্যি-সত্যি আপনার একটুও নার্ভাস লাগছে না? ভয় করছে না?’’ হাসতে-হাসতেই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘ভয় করবে কেন? সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ থেকেই তো আমার জীবনে সব ভয় চিরকালের মতো কেটে যাওয়ার কথা।’’
শ্রী জীবনে ফিরে এসেছেন বিপুলভাবে। মাস দেড়েক আগে ১৭ ফেব্রুয়ারি হইহুল্লোড় করে, সানাই-টানাই বাজিয়ে, যাবতীয় আচার পালন করে, আত্মীয়স্বজন নেমন্তন্ন করে বিয়ে করেছেন। শ্বশুরবাড়ির সদর দরজায় আলতা-পায়ের ছাপ দিয়ে সংসারে জাঁকিয়ে বসেছেন। শ্বশুরমশাইয়ের এখন বৌমার হাতে রান্না করা পাঁঠার মাংস ছাড়া মুখে রোচে না। রান্না করতে বৌমার যাতে কষ্ট না-হয় তার জন্য নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রান্নাঘরে পাখা লাগিয়েছেন। বৌমা তিন দিন বাপের বাড়ি এসে থাকলেই এখন শ্বশুর-শাশুড়ির মন-কেমন।
মনে হতেই পারে, এতে আলাদা কী এমন আছে যার জন্য খবরের কাগজে লিখতে হবে? এমন কতই হয়। কিন্তু শ্রী-র কাহিনি ঠিক এতটা সোজা বা সহজ নয়। একে ঠিক শ্রী-র একার গল্প বললেও ভুল হবে। শ্রী-কে কেন্দ্র করে এ হল কলকাতার এক আটপৌরে বাঙালি পরিবারের সমাজকে ঝাঁকিয়ে দেওয়ার ইতিবৃত্ত।
সামাজিক বিপ্লবের মৌখিক বুকনি অনেকেই দিতে পারেন, কিন্তু এই ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েও কলকাতার ক’টা পরিবারের সত্যিকারের হিম্মত রয়েছে বাড়ির বড় ছেলেকে পুরোপুরি মেয়ে হয়ে উঠতে সাহায্য করার? সেই রূপান্তরিত মেয়েকে নিজের বড় ছেলের বৌ হিসাবে আদর করে বরণ করে নিয়ে একসঙ্গে থাকার ধক-ও বা রয়েছে কত জনের? শ্রী ঘটক মুহুরি-র ক্ষেত্রে সেই নজিরবিহীন সাহস দেখিয়েছে তাঁর পরিবার।
শ্রী-এর ‘পুরুষবেলা’র নাম ছিল অন্য। শ্রী হল তাঁর পরবর্তী মেয়েবেলার পরিচয়। শারীরিক ভাবে শ্রী এখন ‘শ্রী’ থেকে ‘শ্রীমতী’ হয়েছেন। আর এই পরিবর্তনে তাঁর নিজের লড়াইয়ের থেকে তাঁর পরিবারের যুদ্ধ কিছু কম কঠিন ছিল না।
সেই লড়াই লড়েও চোখে কী অসম্ভব ভালবাসা আর গলায় দুরন্ত দৃঢ়তা নিয়ে শ্রী-য়ের স্বামী সঞ্জয় মুহুরি (যিনি তাঁর ছোটবেলার সহপাঠীও বটে) মন্তব্য করেছিলেন ‘‘বিষয়টা সবার পক্ষে হজম করা কঠিন। আমার বউ কিছু দিন আগেও শরীরে ছেলে ছিল, এটা খবরের কাগজে বেরোলে কী পরিমাণ চর্চা হবে সেটা আমি জানি। অফিস-পাড়া সর্বত্র আরও নানারকম রসালো আলোচনা চলবে। আমাকে দেখলে অনেকের গুজগুজ ফুসফুস আর কৌতূহল আরও বাড়বে। তবু আমি চাই, শ্রীয়ের জীবন ওঁর মতো আরও অনেকে জানুক। তাঁরাও নিজের শর্তে বেঁচে থাকার সাহস পাক।’’
তুমুল আত্মবিশ্বাস আর নিয়ন্ত্রিত আবেগে শ্রীয়ের মা পূর্ণিমা ঘটক বলছিলেন, ‘‘শ্রী-য়ের বিয়েতে আমি কোনও স্ত্রী-আচার, কোনও নিয়ম, অনুষ্ঠান বাকি রাখিনি। ছেলে হয়ে জন্মেছিল বটে কিন্তু এখন তো ও আমার বড় মেয়ে। কেনাকাটা, গয়না গড়ানো, জল সইতে যাওয়া, সারারাত মেহন্দি পরা, নাচ, আইবুড়ো ভাত সব হয়েছে বিয়েতে। সব্বাইকে নিমন্ত্রণ করেছি। সবাই এসেওছিলেন।’’ বলছিলেন, ‘‘এ তো ঘরে লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। শ্রী তো আকাশ থেকে পড়েনি বা মাটি ফুঁড়ে বেরোয়নি। ওর মতো আরও যারা আছে তারাও কারও না কারও সন্তান। এই পৃথিবীতে, এই সমাজে যুগ-যুগ ধরে ওরা আছে। তা হলে মানতে না-চাওয়া কেন?’’
সল্টলেট বৈশাখীর সরকারি আবাসনে বড় হয়েছেন শ্রী। বাড়ির বড় ছেলে। তখন নাম অন্য ছিল। বাবা সরকারি চাকুরে। বাড়িতে বাবা-মা-ছোট বোন আর প্রায় সমবয়সী ছোট কাকা। সে সময়ে মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না। ছিল না কেবল চ্যানেল। মানুষের ‘জানা’-র জগৎটা অনেক ছোট ছিল। রূপান্তরকামীদের অস্তিত্ব, আন্দোলন, জীবন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলেন শ্রী নিজে এবং তাঁর আশপাশের মানুষেরা। কিন্তু শরীরটা ছেলের হলেও একটু বড় হওয়ার পর থেকে শ্রী আপনা থেকেই নিজেকে মেয়ে বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন। আবাসনে মেয়েরাই ছিল তাঁর বন্ধু। নিজেকে অস্বাভাবিক না-ঠেকলেও চারপাশের মানুষের চোখে সেটা ধরা পড়েছিল। তখন ক্লাস ফোর-ফাইভ। সিঁড়ির নীচের ঘুপচি-তে আবাসনের কিছু-কিছু বড় ছেলে আচমকা জাপটে ধরত। চুমু খেত। তাঁর মেয়েলি স্বভাব আর হাবভাব নিয়ে সমস্যা শুরু হল বাড়িতে-স্কুলেও। মস্করা, আলোচনা, মন্তব্য, ঠেঁস, বকুনি— ক্রমশ নিজের ভিতরেই একটা বদ্ধ কুঠুরিতে আটকে যাচ্ছিল শ্রীয়ের সত্তা।
কেষ্টপুর সমরপল্লীতে নিজেদের একতলার ছোট্ট-সাজানো ফ্ল্যাটে বসে পূর্ণিমাদেবী শোনাচ্ছিলেন, ‘‘ও যখন ফোর-ফাইভে পড়ে, ও যে অন্যরকম সেটা বুঝতে শুরু করলাম। আমাকে প্রথম সরাসরি বলেছিল আমার ছোট দেওর। ও আমার কাছেই মানুষ। এক দিন আমায় বলল, ‘‘বৌদি, রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে তো এইরকম মানুষ ছিল। ও সে রকম। তোমরা কেন বুঝছ না? ওকে ওর মতো থাকতে দাও। যত তাড়াতাড়ি এটা মেনে নেবে, ওর পাশে থাকবে, তত ভাল।’’ আমার স্বামীও সব বুঝতেন। চুপ করে থাকতেন। আত্মীয়দের নিয়ে সমস্যা হত। একটা সময় পর সমস্ত পারিবারিক উৎসব, অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করেছিলাম। তবে শ্রী-র বিয়েতে সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছি। বেশিরভাগই এসেছেন এবং কোনও সমস্যা তৈরি করেননি।’’
শ্রী-য়ের কথায়, তাঁর মা এবং সঞ্জয়—এই দু’জন না থাকলে কবে, কোথায় ভেসে যেতেন। ক্লাস এইটে নানা ঝামেলায় বিডি স্কুল ছেড়ে কেষ্টপুরের অনামী স্কুলে ভর্তি হতে হল। তখন বয়ঃসন্ধি শুরু। শারীরিক-মানসিক-পারিপার্শ্বিক টানাপড়েনে তিনি দিশেহারা, একা। নতুন স্কুলে এসে ভাগ্যক্রমে সহানুভূতিশীল কিছু স্যর পেলেন, পেলেন দুই বন্ধুকে। তাদের এক জন ক্লাসের ফার্স্ট বয় আর অন্য জন এই সঞ্জয়। ভালবাসা হাতড়ে বেড়ানো শ্রী বন্ধুত্ব আর ভালবাসা-র মধ্যে গুলিয়ে ফেলে মনে-মনে ফার্স্ট বয়টির প্রেমে পড়লেন এবং একটা সময়ে ধাক্কা খেলেন। সেই সময় হাতটা শক্ত করে ধরলেন সঞ্জয়। তখন কোনও প্রেমটেম ছিল না। ক্রমশ অনেকগুলো বছর পাশাপাশি অনেক চড়াই-উতরাই কাটিয়ে কখন যেন বন্ধুত্ব, মায়া-মমতা-সহানুভূতি-প্রেম সব একাকার হয়ে গেল। দু’জনে দু’জনকে পড়তে পারলেন স্পষ্টভাবে। বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন। কঠিন সিদ্ধান্ত। এটা বছর আড়াই আগের কথা।
শারীরিক ভাবে মেয়েতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেন শ্রী। পুরো খরচটাই দিলেন সঞ্জয়। ‘‘অসম্ভব কঠিন একটা প্রক্রিয়া। যেমন শরীরে যন্ত্রণা হয় তেমনই মানসিক ভাবে ছিন্নভিন্ন হতে হয়। বাড়ির সাপোর্টটা এইসময় ভীষণ-ভীষণ দরকার। আমাকে ক্রমাগত মা আর সঞ্জয় সামলে গিয়েছে। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় একটা সময় থেকে মেয়েদের পোশাকে বাইরে বেরোনো শুরু করতে হয়। তখন মারাত্মক টিটকিরির মুখে পড়তাম। বেরোতে চাইতাম না। মা তখন আমাকে সাহস দিয়ে বলতেন, খুব সমস্যা হলে আমি যেন মা-কে ফোন করি। মা গিয়ে আমাকে উদ্ধার করে আনবে।’’— মুখ নিচু করে একটানা বলে যাচ্ছিলেন শ্রী।
অপারেশনের পরে সবচেয়ে বড় টেনশন ছিল হবু শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নিয়ে। প্রথমে নেগেটিভ ছিল সবকিছু। কিন্তু অনড় ছিলেন সঞ্জয়। তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফিরিয়ে আনতে মারাত্মক চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন আত্মীয়-বন্ধুরা। নড়াতে পারেননি। তাঁদের প্রতি কোনও ক্ষোভ না রেখেই বরফ ঠান্ডা মাথার ছেলে বলেন, ‘‘আমি বাড়ির বড় ছেলে। আমার ক্লাসের বন্ধু হিসাবে শ্রী-কেও আমার বাড়িতে সবাই ছোটবেলা থেকে দেখেছেন প্যান্ট-শার্ট পরা একটা ছেলে হিসাবে। হঠাৎ করে আপনার বাড়ির ছেলে যদি বলে যে, সে তার এক পুরুষ বন্ধুকে সামাজিক ভাবে বৌ করে আনতে চায় তা হলে আপনি কি প্রথমে সহজভাবে নেবেন? ’’
সঞ্জয় বলে যাচ্ছিলেন, ‘‘রূপান্তর ব্যাপারটা হজম করতে এই প্রজন্মেরই অসুবিধা হয়, আমার বাবা-মা তো আগের প্রজন্মের মানুষ। বরং আমি অনেক ভাগ্যবান যে, আমার বাড়িতে শেষপর্যন্ত সবাই শ্রী-কে বুকে টেনে নিয়েছেন। আমার প্রত্যাশার থেকে বেশি স্নেহ আর সন্মান দিয়েছেন।’’ জীবন যে তার জন্য এত আনন্দ লুকিয়ে রেখেছিল, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় শ্রী-র। ‘‘মাঝে মাঝে মনে হয়, স্বপ্ন দেখছি না তো? এত কেয়ারিং বর, এত ভাল শ্বশুর-শাশুড়ি-দেওর। আত্মীয়রা নেমন্তন্ন করছে। অফিস কলিগরা একসঙ্গে বেড়াতে যেতে বলছে। এত সন্মান পাইনি আগে কখনও।’’
জামাইকে নিয়ে একইরকম আপ্লুত শ্রী-র মা-বাবা। ‘‘কপাল করে এমন ছেলে পেয়েছি। কী ভাবে আমাদের ভাল রাখবে সবসময় সেই চিন্তা।
রোজ খোঁজ নেবে, দেখা করে যাবে। শ্রী-কে এত যত্ন করে যা আমরাও করিনি।’’
কলকাতার এক প্রান্তে আপাত সাধারণ দুই পরিবারের গতভাঙা-বলিষ্ঠ পদক্ষেপে শ্রীময় হয়ে উঠছে একজোড়া জীবন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy